ম্যাডিসন, উইসকনসিন, ১৯৩৩।
ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো এক শনিবার বিকেল।
সন্ধ্যা হয়নি, তবুও অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। পেঁজা তুলোর মতো ঝরে পড়ছে অবিশ্রান্ত তুষার। রাস্তাঘাট চলাচলের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদজনক। এর মধ্যেই ১৯০ মাইল দূর থেকে ম্যাডিসনের দিকে ছুটে আসছেন এক খামারি, এড কার্লসন। তার উদ্দেশ্য সেখানে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করা। কারণ জীবিকা নির্বাহের প্রধান সম্বল তার গবাদিপশুগুলো কী এক অজানা কারণে মারা যাচ্ছে। হঠাৎ করে রক্তপাত শুরু হয়, যা মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। এই রোগকে সুইট ক্লোভার ডিজিজ (sweet clover disease) বলে স্থানীয় পশু চিকিৎসকেরা নামকরণ করেছেন, কিন্তু তাদের উপর কার্লসনের আস্থা নেই।
চৌদ্দপুরুষ ধরে গরুকে সুইট ক্লোভার খাইয়ে আসছি, কিচ্ছু হয়নি! হঠাৎ করে এই জিনিস কীভাবে প্রাণঘাতী হয়ে গেল? কার্লসনের উত্তর চাই। তার জানা নেই, কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে কেউ নেই। তবে একই ভবনের অন্য একটি কক্ষে জ্বলছে আলো, সেখানে কাজ করছেন উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষক কার্ল লিঙ্ক আর তার অন্যতম ছাত্র উইলহেল্ম শোফেল। তাদের হাত ধরেই সূচীত হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম এক উদ্ভাবনের, যার অনুঘটক এই এড কার্লসন।
ওয়ারফেরিন
মানবদেহে প্রবাহমান রক্ত আমাদের জীবনশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের চলাচল বজায় রাখতে বেশ কিছু উপাদানের ভারসাম্য দরকার হয়। কিছু উপাদান কাজ করে রক্ত জমাট বাধতে, যাকে আমরা প্রোকোয়াগুলেন্ট (Procoagulant) বলে থাকি। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত হলে এরা ছুটে আসে, রক্ত জমাট করে দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। এগুলো না থাকলে সামান্য কাঁটাছেড়া থেকেই রক্ত পড়তে পড়তে আমাদের জীবনাবসান ঘটত। ভিটামিন কে’র বেশ বড় ভূমিকা আছে প্রোকোয়াগুলেন্ট তৈরি করতে।
কিন্তু শরীরে ভেতরে তো রক্ত প্রবাহমান রাখতে হবে। সেখানে প্রোকোয়াগুলেন্টকে বাধা দেয় যারা তাদের বলে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট (anticoagulant)। কোনো কারণে যদি শরীরের অভ্যন্তরে প্রোকোয়াগুলেন্টের ক্ষমতা বেড়ে যায় তাহলে কী হবে আন্দাজ করুন তো? আমাদের শিরা-উপশিরায় অপ্রয়োজনে রক্ত জমাট বেধে যাবে, ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিস্ক ইত্যাদি অঙ্গ। কারণ রক্তই আমাদের সমস্ত অঙ্গের জন্য অক্সিজেনসহ নানারকম রসদ বহন করে নিয়ে যায়। প্রোকোয়াগুলেন্টের আধিক্যে এই রক্ত জমাট বেধে স্ট্রোক, হৃদযন্ত্রের রোগসহ নানা রকম রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তখন চিকিৎসার জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট।
মানুষের জন্য প্রথম তৈরি অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ছিল হেপারিন, যা প্রয়োগ করা হতো শিরাপথে। তা একদিকে যেমন অস্বস্তিকর ছিল, অন্যদিকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম ছিল না। ফলে দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে প্রচলন হয়েছিল ওয়ারফেরিনের, যা মুখে খাওয়া যেত বিধায় রোগীদের জন্য সুবিধাজনক। পরবর্তীতে নতুন নতুন বিকল্প আবিষ্কারের সাথে ওয়ারফেরিনের ব্যবহার কমে গেলেও আজও এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যবহৃত একটি ওষুধ। কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধের প্রথম অনুমোদন ছিল ইদুরের বিষ হিসেবে!
সুইট ক্লোভার ডিজিজ
সুইট ক্লোভার একধরনের উদ্ভিদ। উত্তর আমেরিকার তৃণভূমিতে প্রচুর জন্মে এরা। সেখানে চড়ে বেড়ানো গবাদিপশুর জন্যও এটি অন্যতম খাদ্য। সুইট ক্লোভার শুকিয়ে খড় বানিয়ে খামারিরা জমা করেন শীতকালের জন্য। তাদের জীবন ও জীবিকার অন্যতম সংস্থান হতো পশুপালন করে, আর তাই পশুর খাদ্যের ব্যাপারে কোনো আপস করার সুযোগ নেই।
১৯২০ এর দশকে হঠাৎ করে উত্তর আমেরিকার তৃণভূমিতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ড্যাকোটা আর ক্যানাডার অ্যালবার্টার আশেপাশে অব্যাহতভাবে শরীর থেকে রক্তপাত হয়ে প্রচুর গরু মারা যেতে থাকে। অথচ তখন ঐ অঞ্চলে কোনো রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ছিল না। ফলে নজর পড়ল গরুর খাবারের দিকে। দুজন স্থানীয় পশু চিকিৎসক স্কফিল্ড আর রডারিক খামারিদের কাছ থেকে আসা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান শুরু করেন। তারা দেখতে পেলেন মারা যাবার আগে গবাদি পশুগুলির প্রধান খাবার ছিল সুইট ক্লোভার। আক্রান্ত হবার ১৫ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়, ৩০-৫০ দিনের মধ্যে পশুগুলো মারা যায়।
তারা আরো দেখলেন যে এই ঘটনা বেশি হচ্ছে যেখানে আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে সেখানে। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় সুইট ক্লোভারে পচন ধরে, যা সাধারণ অবস্থায় খামারিরা খাবার হিসেবে বাছাই করেন না। কিন্তু সময়টা এখন ভিন্ন। খামারিদের চলছে অর্থের সংকট, যা আসন্ন মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেশনে’র পূর্বাভাস দিচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সুইট ক্লোভার বাদ দিয়ে আলাদা করে গরুর খাবার কেনার সামর্থ্য অনেকেরই নেই।
স্কফিল্ড আর রডারিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে রক্তপাতের জন্য সুইট ক্লোভারই দায়ী, তবে কোনো জীবাণু এই ঘটনা ঘটাচ্ছে না। সম্ভবত সুইট ক্লোভারের মধ্যেই কোনো উপাদান সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে দেখা দিয়েছে এই রোগ, যাকে তারা বললেন সুইট ক্লোভার ডিজিজ। তবে স্কফিল্ড আর রডারিক এটাও দেখালেন যে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে পশুগুলোকে বাঁচানো সম্ভব। বাইরে থেকে রক্ত দিলে আর সুইট ক্লোভার খাদ্য তালিকা থেকে সরালে অনেক গরুই সেরে উঠছে। তবে ঠিক কোন উপাদান থেকে এই সমস্যার সৃষ্টি তা কেউই সে সময় বের করতে পারেননি। রডারিক নিজের গবেষণা প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করেন ১৯২৯ সালে, তখনো এই রোগ চলছিল।
এড কার্লসন
উইসকনসিনের ডিয়ার পার্ক এলাকা। সেখানে বাস করেন এড কার্লসন নামে এক খামারি। প্রতিবেশীদের মতো তার গরুগুলোও সুইট ক্লোভার ডিজিজে আক্রান্ত হতে শুরু করল। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে মারা গেল দুটি গরু। পয়লা জানুয়ারিতে রোগ দেখা দিল তার অন্যতম প্রিয় এক পশুর দেহে। এরপর এক শুক্রবারে আরো দুটি গরু তার চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সুইট ক্লোভার ডিজিজে কার্লসনের বিশ্বাস ছিল না। তিনি অনেক বছর ধরে তার গরুগুলোকে সুইট ক্লোভার খাওয়াচ্ছেন। এর জন্যেই যদি রোগ হতো তাহলে এতদিন কিছু না হলে আজ কেন এমন হবে?
কার্লসনের পরিচিতজনেরা পরামর্শ দিলেন তুমি বরং ম্যাডিসন শহরে যাও। সেখানে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সবথেকে ভাল জায়গা। গাড়িতে মৃত একটি গরু, দুধ রাখার পাত্রে আক্রান্ত গরুর সংগ্রহ করা রক্ত আর ১০০ পাউন্ডের মতো জমানো সুইট ক্লোভার নিয়ে প্রবল তুষারঝড় মাথায় নিয়ে তিনি বের হলেন।
কার্ল লিঙ্ক
কার্লসনের সাথে ম্যাডিসনে যাবার আগে চলুন একটু জেনে আসি আমাদের গল্পের মূল কুশীলব, কার্ল লিঙ্কের (Karl Paul Gerhard Link ) ব্যাপারে। তার জন্ম ১৯০১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের লাপোর্টে। বাবা জর্জ লিঙ্ক যাজক, আর মা ফ্রেডেরিকা গৃহিণী। তাদের দশ ছেলেমেয়ের মাঝে লিঙ্ক অষ্টম। ১৯১৮ সালে লাপোর্টের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুল সমাপ্ত করে তিনি উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত নেন। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। এক, উইসকনসিনেই তার পিতার জন্ম। দুই, মা ফ্রেডেরিকা উইসকনসিনের প্রথিতযশা আইনবিদ ও রাজনৈতিক বব লাফুয়েটের (Bob LaFoUette) প্রগতিশীল মতবাদের সমর্থক।
লিঙ্ক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক হলেও অর্থের কথা চিন্তা করে শেষপর্যন্ত বেছে নেন কৃষি রসায়ন বা অ্যাগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি, যাকে আমরা আজ বায়োকেমিস্ট্রি নামে ডাকি। ১৯২২ সালে ব্যাচেলর শেষ করে পরের বছর তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এর দুই বছরের মাথায় পিএইচডি করে নামের আগে ডক্টর উপাধিও যোগ করে ফেললেন। সে বছরেই স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজে নামকরা রসায়নবিদ স্যার জেমস ইরভিনের গবেষণাগারে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন তিনি।
কিন্তু ইরভিনের সাথে মতবিরোধের জেরে এক বছরের মাথায় সেখানে থেকে চলে গেলেন অস্ট্রিয়ার গ্রাজ শহরে। সেখানে ১৯২৬ সাল অবধি কাটালেন অধ্যাপক ফ্রিটজ প্রেগ্লের সান্নিধ্যে। প্রেগ্লের কাছ থেকে মাইক্রোকেমিস্ট্রির পাঠ নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে প্রফেসর পল কেরের সাথে কিছুদিন কাজ করেন লিঙ্ক। ইউরোপে থাকাকালীন প্রথমবারের মতো যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন তিনি, তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হতো ওয়েট প্লুরিসি। রোগ থেকে সেরে ১৯২৭ সালে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন লিঙ্ক। পরবর্তী বছর পদোন্নতি পেয়ে হলেন সহযোগী অধ্যাপক।
লিঙ্ক এবং সুইট ক্লোভার ডিজিজ
১৯৩২ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির প্রধান প্রফেসর গর্টনার লিঙ্ককে আমন্ত্রণ জানালেন সেখানে এসে কাজ করতে। মিনেসোটাতেও তখন সুইট ক্লোভার ডিজিজ দেখা দিয়েছিল, ফলে গর্টনার লিঙ্ককে অবহিত করলেন যে সেখানে যোগ দিলে এটি লিঙ্কের গবেষণার একটি বিষয় হতে পারে। গর্টনার নিজে রডারিকের বর্ণিত উপাদান সুইট ক্লোভার থেকে পৃথক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি লিঙ্কের কাছে গবেষণার সমস্ত ফলাফল তুলে ধরেন।
এদিকে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে উইসকনসিনের রাজধানী ম্যাডিসনে বসে লিঙ্ক কাজ শুরু করেন প্রফেসর ব্রিঙ্ক আর স্মিথের সাথে। তবে সুইট ক্লোভার ডিজিজ নিয়ে সরাসরি কাজ না করে তাদের লক্ষ্য ছিল কুমারিনমুক্ত (coumarin) একটি সুইট ক্লোভার প্রজাতি উদ্ভাবন করা। কুমারিন সুইট ক্লোভারে বিদ্যমান একটি রাসায়নিক উপাদান, যা এই উদ্ভিদের মিষ্টি গন্ধের কারণ। একইসাথে কুমারিনের জন্যই সুইট ক্লোভারে তৈরি হয় তিতকুটে ভাব। লিঙ্ক ও তার দলের উদ্দেশ্য ছিল উইসকনসিনের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত এমন একটি সুইট ক্লোভার জন্মানো, যাতে কুমারিন অত্যন্ত কম বা অনুপস্থিত থাকবে। কুমারিনের পরিমাণ বেশি এমন উদ্ভিদ খাবার পর সুইট ক্লোভার ডিজিজ হবার কথা লিঙ্কের জানা থাকলেও তখনো দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারেননি তিনি।
নতুন সম্ভাবনা
১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির তুষারঝড়ের ভেতর দিয়ে কার্লসন যখন ম্যাডিসনে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ভবনে এসে পৌঁছলেন তখন পুরো দালান অন্ধকার। ঝড়ের মধ্যে সবাই বাসায় চলে গেছে, আগুন পোহাতে পোহাতে প্রতীক্ষা করছে নতুন দিনের। কিন্তু কার্লসনের এতো বিলাসিতার সময় নেই। একটি মাত্র কক্ষে আলো জ্বলতে দেখে তিনি ছুটে গেলেন। সেখানে পাওয়া গেল লিঙ্ক আর তার ছাত্র শোফেলকে।
লিঙ্ক কার্লসনের বক্তব্য সহানুভূতির সাথে শুনলেন। তবে তৎক্ষণাৎ রডারিক আর স্কফেল্ডের পুরনো পরামর্শ ছাড়া আর কিছু তাকে দিতে পারলেন না। তোমার গরুকে সুইট ক্লোভার খাইয়ো না, আর আক্রান্ত হলে রক্ত দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করো। বিফল মনোরথে বিকাল ৪ টার দিকে বাড়ির পথ ধরলেন কার্লসন। রোগের কারণ নিয়ে উত্তর জানা হলো না।
লিঙ্কের জার্মান ছাত্র শোফেল রসায়নবিদ হিসেবে প্রথম শ্রেণির। কার্লসনের দুধের পাত্রে হাত ডুবিয়ে রক্ত পরীক্ষা করলেন তিনি। ১৯০ মাইল পাড়ি দিয়ে আসার পরেও সেই রক্ত রয়ে গেছে তরতাজা। কোনরকম জমাট বাধেনি। এ তো অসম্ভব! সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত লিঙ্ক আর শোফেল কাজ করলেন সেই রক্ত নিয়ে। এরপর লিঙ্ক যখন বাড়ি যাবেন শোফেল তার কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন। আজকের এই দিন আমাদের জীবনকে বদলে দেবে, ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তিনি।
লিঙ্ক তার ছাত্রদের নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেলেন পরের ৬ বছর। উদ্দেশ্য সুইট ক্লোভার থেকে খুঁজে বের করা সেই উপাদান, যা রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দিচ্ছে। এ কাজে তারা নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করলেন, যা তৈরির জন্য খরগোশ ব্যবহার করা হয়েছিল। স্মিথ, রবার্টস আর ক্যাম্পবেল নামে তিন ছাত্র তাদের মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। অবশেষে ১৯৩৯ সালের জুনে, বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বাজি বাজি করছে, তখন ক্যাম্পবেল একদিন সারারাত কাজের পর মাইক্রোস্কোপের নিচে খুঁজে পেলেন সেই বস্তু, যা কুমারিনের অক্সিডাইজড একটি রূপ। এর নাম ডাইকুমারল (Dicumarol)। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতে সুইট ক্লোভারের কুমারিন অক্সিডাইজড হয়ে ডাইকুমারলে পরিণত হয়, যা রক্তপাত ঘটায়।
দুই দিন পর পরিপূর্ণ একটি রিপোর্ট ক্যাম্পবেল তার শিক্ষক লিঙ্কের হাতে তুলে দিলেন। শোফেল ততদিনে শিকাগোতে আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের গবেষণাগারে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। লিঙ্ক তাকে টেলিগ্রাম করে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উত্তর পাঠান। প্রায় ২০০ শব্দের বিশাল তারবার্তায় তিনি লিঙ্কের দলের উপর পুরো বিশ্বাস ব্যক্ত করেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ
পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বেশ ভালো পরিমাণ ডাইকুমারলের দরকার। লিঙ্ক দায়িত্ব দেন মার্ক স্টাহম্যান (Mark Stahmann) নামে আরেক ছাত্রকে। স্টাহম্যান ১৯৩৬ সাল থেকে থিসিস করছিলেন। ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করলেও লিঙ্ক তাকে ডাইকুমারল বানানোর অনুরোধ জানালে তিনি কাজে লেগে পড়েন।কাঠের পিপার ভেতরে সুইট ক্লোভার পচিয়ে চার মাসের মাথায় প্রায় ১৮০০ মিলিগ্রাম ডাইকুমারল বানিয়ে ফেলেন তিনি।এরপর তিনি এবং চার্লস হুয়েবনার মিলে ডাইকুমারলের গঠন শনাক্ত করলেন। পরের কাজ ছিল রাসায়নিকভাবে ডাইকুমারল তৈরি করা। হুয়েবনার (C. F. Huebner) পয়লা এপ্রিল, ১৯৪০ সালে সেই কাজও সম্পন্ন করলেন। এর নয়দিন পর লিঙ্ক গবেষণার বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে কৃষি কলেজের ডিন ক্রিস্টেনসেনের কাছে পত্র লিখলেন।
ডাইকুমারল নিয়ে গবেষণা চালাতে কিন্তু খরচ হচ্ছিল প্রচুর অর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের বাইরে ছিল এই টাকা, যা সংস্থান করছিল উইসকনসিন অ্যালামনাই রিসার্চ ফাউন্ডেশন, সংক্ষেপে ওয়ার্ফ (Wisconsin Alumni Research Foundation/WARF)। ১৯৪১ সালে তারা এই ডাইকুমারল প্যাটেন্ট করে নেয়।
ইঁদুরের বিষ
চিকিৎসকদের হাতে গবেষণার সমস্ত ফলাফল তুলে দেন লিঙ্ক। তিনি এটাও উল্লেখ করেছিলেন যে ভিটামিন K ব্যবহার করে ডাইকুমারলের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব। তবে বিভিন্ন কারণে সেই কথা তৎকালীন চিকিৎসক সমাজ গ্রহণ করেনি। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিলেন, যেমন নিউ ইয়র্কের চিকিৎসক শেফার্ড শ্যাপিরো, ক্যানাডার টাউনসেন্ড আর মিলস, সুইডেনের লেহম্যান ইত্যাদি।
১৯৪২ সালের দিকে ইঁদুর মারতে ডাইকুমারলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন লিঙ্ক আর শোফেল। তারা দেখলেন যে গরুর মতো ইঁদুরে রক্তপাত ঘটাতে ডাইকুমারল ততটা কার্যকরী না। তবে ডাইকুমারল ব্যবহার করে প্রায় ১৫০টির মতো অনেকটা একই রকম গুণের উপাদান তৈরি করা হয়েছিল, প্রত্যেকটির ব্যাপারেই গবেষণা চলতে থাকে। কিন্তু অনেক ছাত্র আর গবেষক বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়ায় গতি ছিল খুব কম।
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে লিঙ্ক পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসেন। পরীক্ষায় জানা গেল তার নতুন করে যক্ষ্মা দেখা দিয়েছে। দুই মাস উইসকনসিনের জেনারেল হাসপাতালে কাটিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে তিনি লেকভিউ স্যানাটোরিয়ামে স্থানান্তরিত হন। সেখানে অফুরন্ত অবসরে ডাইকুমারল নিয়ে গবেষণার ফলাফল দেখতে দেখতে তিনি নতুন করে ভাবতে লাগলেন। এদিকে যুদ্ধ শেষ হলে ছাত্ররাও ফিরে আসতে থাকে। তাদের একজন, শ্লিল (L. D. Scheel) ৪০-৬৫ নম্বর উপাদান নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন, যেগুলো বানিয়েছিলেন ইকাওয়া নামে আরেকজন ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে।
শ্লিল ৪২-৬৩ নম্বরকে চিহ্নিত করেন শক্তিশালী অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট হিসেবে। ১৯৪৮ সালে এদের মধ্য থেকে ৪২ নম্বরকে লিঙ্ক বেছে নিলেন ইঁদুর মারার ওষুধ হিসেবে। দেখা গেল ৪২ নম্বর অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ব্যবহার করে ইদুরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ করা সম্ভব, যার পরিণতিতে ইঁদুরের মৃত্যু হবে। সে বছরেই ইঁদুর মারার বিষ হিসেবে অনুমোদন পেয়ে বাজারে এলো এই উপাদান। তখনো ওয়ারফ তাদের কাজে অর্থ সাহায্য করছিল। কাজেই লিঙ্ক নতুন এই বিষের নাম রাখলেন ওয়ারফেরিন। কুমারিনের থেকে রিন নিয়ে ওয়ারফের সাথে যোগ করে এই নাম দেন তিনি। অল্প সময়ের মাঝেই ইঁদুরের বিষ হিসেবে ওয়ারফেরিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আত্মহত্যার চেষ্টা ও নতুন দিগন্তের সন্ধান
১৯৫১ সালের এপ্রিলে ফিলাডেলফিয়া থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন লাভ লিঙ্কের সাথে যোগাযোগ করেন। তার এক সেনা ওয়ারফেরিন খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। পাঁচদিন ধরে ৫৬৭ মিলিগ্রাম ওয়ারফেরিন খেয়েও মরতে ব্যর্থ হয়ে বেচারা হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে রক্তপাত বন্ধে চিকিৎসকেরা ওয়ারফেরিনের প্যাকেটে লেখা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। রোগীকে রক্ত এবং ভিটামিন কে দিয়ে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ করে তোলা হয়।
এবার সবার টনক নড়ল। মানবশরীরে ওয়ারফেরিন ব্যবহারের প্রধান বাধা ছিল এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে অপর্যাপ্ত তথ্য এবং বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য কোনো প্রতিষেধক জানা না থাকা। লিঙ্ক বারবার ভিটামিন K-র কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা অনেকেই এতদিন তা আমলে নেননি। আত্মহত্যার চেষ্টা করা রোগী দেখে এবার তারা ধারণা করলেন মানব শরীরে ওয়ারফেরিন প্রয়োগ করা যেতে পারে, কোনো ঝামেলা হলে ভিটামিন K তো আছেই। হেপারিনের বিকল্প হিসেবে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট হিসেবে ওয়ারফেরিন মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে দিল এফডিএ ১৯৫৪ সালেই। পরের বছর সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ লিঙ্ককে জানানো হলো তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকেও ওয়ারফেরিন দেওয়া হয়েছে। মানুষের শরীরে ওয়ারফেরিন নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষাও শুরু হয়।
শেষ কথা
কার্ল লিঙ্ক মারা যান ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে। তবে ওয়ারফেরিন আবিষ্কারে তিনি ও তার নিবেদিত দলের অবদান আজো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। প্রাণঘাতী নানা রোগের চিকিৎসায় ওয়ারফেরিন বহুদিন ধরেই ছিল একমাত্র সহায়। আধুনিককালে নতুন ওষুধ আবিষ্কার হলেও এখনো অনেক জায়গায় ওয়ারফেরিনের ব্যবহার রয়ে গেছে। এজন্য এড কার্লসনকেও একটা ধন্যবাদ দিতে হবে। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারির সেই শনিবার যদি অফিস বন্ধ দেখে তিনি ফিরে যেতেন, লিঙ্কের ঘরে না ঢুকতেন, তাহলে কি ওয়ারফেরিনের গল্প এভাবে লেখা হতো?