সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিলে পীত জ্বরের (ইয়েলো ফিভার) প্রকোপ অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে আটলান্টিক বনাঞ্চলের মিনে জেরাইস ও ইস্পিরিতো সান্তো এবং এদের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পীত জ্বরের সংক্রমণ শুরু হয় তীব্র আকারে। যথাযথ টিকাদান কর্মসূচির ব্যর্থতার দরুন পরবর্তী বছরের মে মাসের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ব্রাজিল জুড়ে। বিগত কয়েক দশকের মাঝে এটিই ছিল সবচেয়ে তীব্র প্রাদুর্ভাব। মাসখানেকের মাঝেই মৃতুর সংখ্যা ৪০০ ছাড়ায়।
ব্রাজিলের ঘন বনাঞ্চলে মশার বসবাস খুবই স্বাভাবিক বিষয়। পীত জ্বরের ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে থাকে মশা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পীত জ্বর প্রাইমেট থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রাজিলের বিভিন্ন বনাঞ্চলে গোল্ডেন লায়ন ট্যামারিন মাংকি (বানরের একটি প্রজাতি) থেকে মনুষ্য প্রজাতিতে পীত জ্বর ছড়িয়ে পড়ে খুব সহজেই। যদিও ভাইরাস ঘটিত এই জ্বরের বাহক মশা তবে বিদ্যমান অবস্থাকে আরও সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে মূলত মনুষ্য প্রজাতি। গাছপালা উজাড় করে মানুষ যত বেশি করে বনের আরও গভীরে বসতি গড়ে তুলছে, মানুষ এবং বানরের আবাসস্থলের পার্থক্য তত হ্রাস পাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার মাধ্যমে মানুষ আসন্ন মহামারিগুলোকে আরও ভয়ঙ্কর রূপ দিতে যাচ্ছে।
টিকাদান কর্মসূচির চ্যালেঞ্জ
ইয়েলো ভাইরাসের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে প্রায় এক শতাব্দী আগে অথচ আক্ষেপের বিষয়, পীত জ্বরকে নিয়ন্ত্রণে আনার মতো অবস্থায় পৃথিবী এখনও পৌঁছাতে পারেনি। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি টিকাদান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কার্যক্রমের আওতায় ব্রাজিলের ২১ কোটি জনগণের মাঝে অন্তত ৮ কোটিকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বেশ কিছু পৌরসভায় আশাব্যাঞ্জক ফলাফল পেলেও (৯৫% সাফল্য) বড় বড় শহরগুলোতে বহু কষ্টেসৃষ্টেও ৫০% অধিবাসীকে টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
অধিকাংশ ব্রাজিলিয়ান জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে তাদের সরকারকে অবিশ্বাস করে থাকেন। ব্রাজিলের রাজনীতিতে দুর্নীতির শেকড় এতটাই তীব্র যে দেশটির নাগরিকদের পক্ষে সঠিক ও কার্যকরী কোনোকিছুর প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। যদিও সকলকে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়, তাতে নাগরিকদের অনাস্থা জ্ঞাপনের যুক্তি ছিল এই যে, এই টিকা প্রদান মূলত তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবে করা হচ্ছে না বরং এতে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ও সরকারের লাভ হবে বলেই এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এবং ফলাফল হিসেবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
দুর্নীতি ও আস্থাহীনতার পাশাপাশি আরেকটি বড় কারণ ছিল গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ছড়াছড়ি। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব কথা। টিকা প্রদানকে কেন্দ্র করে যেসব বিভ্রান্তি ছড়ায় তার অধিকাংশই হয়ে থাকে অতীতের কোনো কর্মসূচিকে ঘিরে তৈরিকৃত বানোয়াট তথ্য। আর জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো সম্প্রতি কাজ করে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্রাজিলের প্রেক্ষাপটে হোয়াটসঅ্যাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণত মানুষের হোয়াটসঅ্যাপ কন্টাক্ট লিস্টে পরিচিতজনরাই বেশি থাকেন। এতে করে পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীর কাছ থেকে একটি ভুল তথ্যের মেসেজও যদি আসে মানুষ সেটিকে খুব দ্রুতই সত্য বলে বিশ্বাস করে নেয়।
বেশ কিছু গুজবের মাঝে অন্যতম ছিল ভাইরাসের মিউটেশন ঘটার কারণে টিকার আর কোনো কার্যক্ষমতা থাকবে না। এই গুজবটি এতটাই প্রকট আকারে ছড়িয়ে পড়ে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে বাধ্য হয়। এতে বলা হয় যে ভাইরাসের মিউটেশন টিকার কার্যকারিতার উপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। এগুলোর পাশাপাশি অব্যবস্থাপনাও অনেকাংশে দায়ী টিকাদান কর্মসূচির ব্যর্থতার জন্য।
বানরকে টিকা প্রদান
অব্যবস্থাপনা, গুজব ছড়ানো, আস্থাহীনতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ব্রাজিলের টিকাদান কর্মসূচি যে সামগ্রিকভাবে সফল হয়নি এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। বিষয়টাকে একটু খতিয়ে দেখা যাক। ব্রাজিলের জনসংখ্যা প্রায় ২১ কোটি। ২১ কোটি নাগরিকের প্রত্যেককে টিকাদান করা অবশ্যই একটি কষ্টসাধ্য কাজ। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে দুর্নীতি, অনীহা, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নানাবিধ কারণ। বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করলে ২০১৭ সালের প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সমীক্ষানুযায়ী ব্রাজিলে বানর (ট্যামারিন) আছে প্রায় ২,৬০০টি। যেহেতু বাহক মশা হয়ে বানর থেকে মানুষে পীত জ্বরের ভাইরাসটি আসতে পারে তাই বানরকে যদি টিকা দান করে আগে থেকেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তোলা যায় তাহলে সংক্রমণ রোধের একটি পরোক্ষ অথচ কার্যকর উপায় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
এই কার্যক্রমের আওতায় বনের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতিটি বানরের শরীরে একটি মাইক্রোচিপ সংযুক্ত থাকে এবং জিপিএস ডিভাইসের মাধ্যমে তাদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা যায়। এই নজরদারির কাজটি করে থাকেন গবেষকদের একটি দল। অন্য আরেকটি দল হাতে বানানো কাঠের একটি ফাঁদে কলার কাদি রেখে বানরের দলকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। বানরের দল থেকে একটি একটি করে সদস্য কলার লোভে খাঁচার মাঝে প্রবেশ করতে থাকে। একের পর এক খাঁচার দরজা বন্ধ হতে থাকে এবং প্রতিটি খাঁচায় একেকটি বানর আটকা পড়ে যায়।
এরপর একদিনে যতগুলো বানর এভাবে ধরা সম্ভব হয় সবগুলোকে নিয়ে গবেষকদল তখন তাদের ল্যাবে ফিরে আসেন। প্রথমেই তারা যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে বানরগুলোকে একের পর এক অচেতন করে ফেলেন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। প্রতিটি চেক আপে ওজন, তাপমাত্রা ইত্যাদি তথ্য তাদের আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারের বিপরীতে রেকর্ড করে রাখা হয়। এছাড়াও তাদের শরীর থেকে রক্ত, মল, এবং থুথুর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয় যে তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক আছে কি না।
এর পরবর্তী ধাপে আসে টিকাদানের বিষয়টি। বানরের উদরের নিম্নাংশ থেকে সামান্য কিছু লোম ফেলে দিয়ে সেখানে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে টিকাদানের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এরপর বানরগুলো জেগে উঠার আগেই তাদেরকে আবার বনে অবমুক্ত করে দিয়ে আসা হয় এবং তাদের প্রতি স্নেহের চিহ্ন হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণ কলার কাদি তাদের ঠিক পাশেই রেখে আসা হয়। আগামী বছর দুয়েকের মাঝে কনজার্ভেশন বায়োলজিস্টদের প্রত্যাশা যে তারা প্রায় ৫০০ বানরকে টিকাদান সম্পন্ন করতে পারবেন।
সংরক্ষিত হোক জীববৈচিত্র্য
মনে রাখা দরকার যে, বানরকে টিকাদান কর্মসূচি আদতে একটি পরোক্ষ পদক্ষেপ। সমস্যার গোড়ার কথা ভুলে যাওয়ার একেবারেই সুযোগ নেই। যে বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার সেটি হলো- জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে মানুষ এবং বনে বসবাসকারী প্রাণীদের মাঝে দূরত্ব যত কমবে পরবর্তী মহামারির সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে এবং ভয়াবহতাও হবে আরও বেশি। আর এর পাশাপাশি যেহেতু ইতোমধ্যে বানরকে টিকাদান কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে তাই আশা করা যায় যে তাদেরকেও অন্তত নিকট ভবিষ্যতে সংক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে না।