নতুন করোনা ভাইরাস কভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় ২০ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি। মৃতের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এই রোগের লক্ষণ হচ্ছে গলা ব্যথা, কাশি, নাকে সর্দি, জ্বর ইত্যাদি। কিন্তু এসব লক্ষণ তো নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের অন্যান্য রোগেও দেখা যায়। তাহলে এর সাথে কভিড-১৯ এর পার্থক্য কী? সুতরাং শুধু লক্ষণ দেখে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানা যায় একটি নির্দিষ্ট শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসলেই জানা যায়, তিনি ওই রোগে আক্রান্ত। কী সেই বিশেষ পরীক্ষা?
পরীক্ষাটি হচ্ছে পলিমারেজ চেইন রিএকশন বা পিসিআর পদ্ধতি। পিসিআর পদ্ধতিটি হচ্ছে ডিএনএ সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র সংখ্যক ডিএনএ থেকে বিপুল পরিমাণ ডিএনএ সৃষ্টি করা হয়, যা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করা যায়। আশির দশকে ক্যারি মুলিস পিসিআর পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন।
পিসিআর পদ্ধতিতে ডিএনএকে চক্রাকারে উত্তপ্তকরণ ও শীতলীকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিমাণ ডিএনএ থেকে লক্ষ লক্ষ ডিএনএ তৈরি করা হয়। এরপর ফ্লুরোসেন্ট নামক একপ্রকার রঞ্জক পদার্থের মাধ্যমে বোঝা যায়, মিশ্রণে কী পরিমাণ ডিএনএ আছে। এর মাধ্যমে শরীরে জীবাণুর উপস্থিতি জানা যায় সঠিকভাবে।
তবে এর আগে করোনা ভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত করতে হলে এর জিনোম সংগ্রহ করতে হয়। জিনোম হচ্ছে সিংগেল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ। একে একধরনের এনজাইমের মাধ্যমে ডাবল স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ-তে রূপান্তর করা হয়। এই এনজাইমের নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ বা আরটি। এই প্রক্রিয়া ও পিসিআরকে একত্রে বলা হয় আরটি-পিসিআর (RT-PCR)।
বর্তমানে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমেই জানা যায়, কোনো রোগীর শরীরে কভিড-১৯ ভাইরাস আছে কি না। এটিই একমাত্র আদর্শ ও দ্রুত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে করোনার সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অন্যান্য জীবাণুর পার্থক্য করা যায়। তাহলে রোগীর শরীর থেকে কীভাবে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
প্রথম ধাপ হচ্ছে রোগীর নমুনা সংগ্রহকরণ। শ্বসনতন্ত্রের উপরিভাগের অংশ এবং নিম্নভাগের অংশ বা ফুসফুস থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। উপরিভাগের নমুনা সংগ্রহ করা হয় একটি বিশুদ্ধ প্লাস্টিকের নরম কাঠির সাহায্যে। একে বলা হয়ে ‘সোয়াব স্টিক’। এর মাধ্যমে জিহ্বা স্পর্শ না করে গলার পেছনের দিকে টনসিলের অংশ থেকে সোয়াব নিয়ে আসা হয়। এরপর নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে যে পর্যন্ত বাধা না আসে, সে পর্যন্ত সোয়াব স্টিক ঢুকানো হয়। তারপর ১০-১৫ সেকেন্ড কাঠিটি ঘুরিয়ে বের করে আনা হয়। দুই নাকের ছিদ্র থেকেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
নমুনা সংগ্রহের পর সোয়াব স্টিকটি একটি জীবাণুমুক্ত টেস্ট টিউবে নিয়ে সিল মেরে দেয়া হয়। এরপর একে ঠাণ্ডা বক্সে করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। নমুনাগুলো রাখতে হয় ৩৫-৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায়। পরীক্ষা করতে হয় চারদিনের মধ্যে।
সার্স এবং মার্স করোনা ভাইরাস শ্বসনতন্ত্রের নিম্নভাগের নমুনা থেকে সংগ্রহ করা হতো। তাই সম্ভব হলে এই অংশ থেকেও নমুনা সংগ্রহের কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে প্লুরাল ফ্লুইড, কফ এগুলো নমুনা হিসেবে একটি জীবাণুমুক্ত কৌটায় নেয়া হয়।
নার্স, চিকিৎসক কিংবা যে কর্মী নমুনা সংগ্রহ করেন, তাদের কিছু প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। তাদেরকে গাউন, দস্তানা, আই শিল্ড ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই।
পরীক্ষাগারে নমুনা আনার পর প্রথমে আরএনএ সংগ্রহ করা হয়। মানব কোষ, প্রোটিন, এনজাইম এগুলো থেকে আরএনএ-কে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই ধাপকে বলা হয় আরএনএ নিষ্কাশন। এই প্রক্রিয়া যদি হাতে করতে হয়, তাহলে নমুনার মধ্যে বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ যোগ করতে হয়। তারপর একে সেন্ট্রিফিউজ করলে অন্যান্য অংশ থেকে আরএনএ বিচ্ছিন্ন হয়। বর্তমানে বেশ কিছু কোম্পানি এক ধরনের কিট তৈরি করে, যাতে আরএনএ নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় সব উপকরণই পাওয়া যায়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমেও এই নিষ্কাশন করা যায়।
আরএনএ নিষ্কাশন করার পরের ধাপে এর সাথে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম যোগ করা হয়। এই এনজাইম আরএনএকে ডিএনএ-তে রূপান্তরিত করে। এরপর এই ডিএনএকে একটি টেস্টটিউবে রাখা হয়। টেস্টটিউবে নিউক্লিওটাইড, ডিএনএ নির্মাণকারী এনজাইম এবং একধরনের ক্ষুদ্র ডিএনএ’র অংশ মেশানো হয়। নিউক্লিওটাইড ডিএনএ এর একটি গাঠনিক অংশ। এর মধ্যে থাকে ডিএনএ’র চারটি বেসের যেকোনো একটি (অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন, সাইটোসিন), এক অণু শর্করা ও এক অণু ফসফরিক এসিড। নিউক্লিওটাইড ও এনজাইমের সাথে ক্ষুদ্র আরএনএ মেশানো হয় একে বলা হয় ‘প্রাইমার’।
প্রাইমারগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হয়, যেন এগুলো ভাইরাসের জিনোমের নির্দিষ্ট সিকুয়েন্স খুঁজে বের করে মিলিত হতে পারে। তারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ভাইরাসের জিনোমের সাথেই মিলিত হয়। অন্য কোনো অংশ যেমন মানবকোষ বা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ’র সাথে যুক্ত হয় না।
এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় একটি পিসিআর মেশিনে। এই মেশিনের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাপমাত্রা বাড়ানো হলে ডিএনএ’র ডাবল হ্যালিক্স ভেঙ্গে যায় এবং দুটি স্ট্র্যান্ড উন্মুক্ত হয়। যখন তাপমাত্রা কমানো হয়, তখন প্রাইমারগুলো উন্মুক্ত হওয়া ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের কাঙ্ক্ষিত স্থানে গিয়ে যুক্ত হয়। এভাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটি থেকে দু’টি ডিএনএ তৈরি হয়ে যায়।
এই চক্র ৩০-৪০বার সম্পন্ন করা হলে এক কপি ডিএনএ থেকে কোটি কোটি কপি ডিএনএ প্রস্তুত হয়। তখন এই ডিএনএ থেকে বিজ্ঞানীরা জীবাণুর ডিএনএ আছে কি না, তা সহজেই শনাক্ত করতে পারেন।
ডিএনএ শনাক্ত করার জন্য টেস্ট টিউবে ফ্লুরোসেন্ট রঞ্জক পদার্থ মিশ্রিত করা হয়। এর আভা দেখা যায় শুধুমাত্র ডিএনএ’র উপস্থিতি থাকলে। ডিএনএ’র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে নির্গত আলোর সংখ্যাও বেড়ে যায়। পিসিআর মেশিনে বিশেষ ধরনের আলো পরিমাপের যন্ত্র থাকে। এটি ফ্লুরোসেন্স প্যাটার্ন থেকে শনাক্ত করতে পারে কোন নমুনায় ভাইরাস আছে, কোন নমুনায় নেই। আপনার শরীরে যদি করোনা ভাইরাসের জীবাণু থাকে, তাহলে এর আরএনএ রূপান্তরিত হবে ডিএনএ-তে। তারপর এই ডিএনএগুলো ফ্লুরোসেন্স আলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করবে আপনার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি।
রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠাতে হয়। পরীক্ষাগার থেকে ফলাফল স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে আসে, তারপর রোগীর কাছে যায়। অস্ট্রেলিয়াতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা বা গড়ে পাঁচদিন সময় লাগে। অন্যান্য দেশেও এরকম সময়ই লাগে। সুতরাং, আমরা আজ যে তথ্য জানতে পারছি, তা আরো পাঁচদিন আগের। পাঁচদিন পর নতুন ফলাফল আসলে দেখা যায় আক্রান্ত রোগী আরো বেড়ে গেছে।
বর্তমানে অন্তত ২০টি কোম্পানি কাজ করছে ভাইরাস শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় নিয়ে আসার। এতে পাঁচদিনের জায়গায় আধঘণ্টায় ফলাফল জানা যাবে। ক্রিস্পর (CRISPR) ভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রেগনেন্সি টেস্টের মতো খুব দ্রুত ভাইরাসের ফলাফল জানার কথা বলা হচ্ছে। তবে এগুলো এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে।
এছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, রক্তে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি নির্ণয় করার পদ্ধতি। একে বলা হয় সেরোলজিক্যাল পদ্ধতি। এতে অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা যাবে কোনো ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু এখন সুস্থ আছেন। এটি পিসিআরের চেয়ে সস্তা এবং এতে রোগীও শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এটি পিসিআরের মতো উপযুক্ত নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ভাইরাসের আক্রান্তের চেয়ে বড় সঙ্কট ভাইরাস শনাক্তকরণের কিটের অভাব। কারণ এর ফলে জানা যাচ্ছে না, কেউ আদৌ ভাইরাসে আক্রান্ত কি না। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে চীন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া কিট দিয়ে পরীক্ষা করলেই হয়তো বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যাটা কেমন, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে।