অর্ণব (ছদ্মনাম) এর বয়স ২৮, কিছুদিন আগেই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে প্রবেশ করেছে কর্মজীবনে। একটি বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মোটা বেতনে চাকরি করছে সে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান X ছাত্রজীবন ও কর্মজীবন- দু’ক্ষেত্রেই সফল বলা যায়, যার কারণে তাকে নিয়ে পরিচিতজনের গর্বের কোনো শেষ নেই।
তবে অর্ণবের মনে যে দুঃখ নেই, তা কিন্তু নয়। তার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে, তার নাকটা ভীষণ রকমের বড়, যা মুখের সাথে একেবারেই মানানসই নয়। নিজের এই অস্বাভাবিক ত্রুটির জন্য সে প্রায় চিন্তিত হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার বিশ্বাস, সে যখন বাইরে যায়, তখন মানুষ অবাক হয়ে তার নাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। লজ্জায় তাই সে একটি রুমাল দিয়ে সবসময় নিজের ‘বেঢপ’ নাকটা ঢেকে রাখে।
শেষপর্যন্ত পরিবারের সহযোগিতায় তাকে একজন শল্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি অর্ণবকে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সব পরীক্ষা করে জানান, অর্ণব যে মানসিক ব্যধিতে ভুগছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটির নাম বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি)।
বিডিডি কী?
শারীরিক গঠন প্রত্যেক মানুষেরই একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা তাকে অন্য সবার থেকে অালাদা ও অনন্য হিসেবে উপস্থাপন করে। তাই নিজের দেহের শারীরিক গঠন নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই নানা স্বপ্ন ও প্রত্যাশা লুকিয়ে থাকে। কেউ লম্বাটে চেহারা পছন্দ করে, কারো পছন্দ ছোটখাট চেহারা। অনেকে পেশিবহুল শরীর গঠন করতে চায়, আবার অনেকে মেদহীন শরীরেই স্বস্তিবোধ করেন। কেউ কালো চুল ভালোবাসে, অাবার কেউ সোনালী। তবে এ কথা সত্য, বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের শারীরিক গঠন যেমন অাছে, তেমনটি নিয়েই স্বস্তিবোধ করেন।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মনে নিজের শরীরের গঠন নিয়ে অহেতুক চিন্তা এবং বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয়, যা একপর্যায়ে মানসিক চাপের আকার নেয়। ফলে মানুষটি নানা অবসেশন-কম্পালশনে ভুগতে শুরু করেন।
বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি) এমনই একটি মানসিক রোগ, যে রোগে আক্রান্তদের বিশ্বাস, তাদের শরীরের কোনো একটি অংশ পুরো শরীরের সাপেক্ষে ত্রুটিপূর্ণ; যদিও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই বা থাকলেও নগণ্য।
নিজেদের শরীরের এসব তথাকথিত গঠনগত অস্বাভাবিকতা ও ত্রুটির কারণে রোগী প্রচন্ড হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন এবং সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। কেউ কেউ এতটাই জেদী হয়ে ওঠেন যে, শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে হলেও তাদের চেহারার কাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে উঠেপড়ে লাগেন। ত্রুটি সারানোর যতই চেষ্টা তারা করুক না কেন, তাদের মনের ভুল ধারণার কোনো পরিবর্তন হয় না বললেই চলে।
ইতিহাস
ইতালীয় মনোবিদ এনরিকো মোর্সেলি ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম বিডিডির ওপর অালোকপাত করেন। তিনি একে ডিসমর্ফোফোবিয়া নামে অভিহিত করেন। এটি গ্রিক শব্দ ‘ডিসমরফিয়া’ থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ কুৎসিত। শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হেরোটোডাসের ইতিহাস গ্রন্থে।
এরপর অারেক ফরাসি মনোবিদ পিয়েরে জ্যানেত এই ব্যাধিকে ‘l’obsession de la honte du corps‘ বা ‘Obsessions of shame of the body’ নামে অাখ্যায়িত করেন এবং একে অবসেসিভ কম্পালসিভ নিউরোসিসের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৯৮০ সালে রোগটি ‘Atypical somatoform disorder‘ নামে অ্যামেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাস এর ৩য় সংস্করণে (DSM-II) স্থান পায়। ১৯৮৭ সাল থেকে এটি Body Dysmorphic Disorder নামে পরিচিত হতে থাকে।
বিশ্বখ্যাত পপ গায়ক মাইকেল জ্যাকসন বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকদের নিষেধ সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি মোট ১১ বার কসমেটিক সার্জারি করিয়েছিলেন। এছাড়াও ফ্রাঞ্জ কাফকা এবং সিলভিয়া প্লাথের মতো লেখকও এই রোগে অাক্রান্ত ছিলেন বলে জানা যায়।
কারণ
অন্যান্য মানসিক ব্যধির মতো বিডিডি-তে অাক্রান্ত হওয়ার পেছনে এককভাবে কোনো কারণকে চিহ্নিত করা যায় না। এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ।
শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা
পরিবার, সমাজ কিংবা বন্ধুমহলে কারো চেহারার গড়ন নিয়ে হাসাহাসি বা ব্যঙ্গবিদ্রূপ করাকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই ধরা হয়। যেমন- শ্যামবর্ণের কাউকে ‘কাইল্লা’ বা স্বাস্থ্যবান কাউকে ‘মোটকু’ বলে ডাকা। কিন্তু কাছের মানুষদের কাছ থেকে এ ধরনের অপমানের শিকার হয়ে মানুষের মনে তার নিজের সম্পর্কে একধরনের অসন্তোষ, হীনম্মন্যতা বা নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়, যা থেকে বিডিডি হতে পারে।
আত্মবিশ্বাসহীনতা
অাত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিজের সম্পর্কে নিচু ধারণা মানুষকে অস্বাভাবিক চালচলন, অত্যধিক শরীরচর্চা, বেশি বা কম পরিমাণ খাদ্যগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে, যা বিডিডির অন্যতম কারণ।
ব্যক্তিত্বজনিত বিকার
এমন অনেকেই অাছেন যাদের মধ্যে সবসময় নিজেকে অতিরিক্ত নিখুঁত প্রমাণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই মাত্রাতিরিক্ত পারফেকশনিজমের ফলে সৃষ্টি হয় অসহনীয় মানসিক উদ্বেগ, যা থেকে কেউ বিডিডি-তে অাক্রান্ত হতে পারেন।
অবসেশন-কম্পালশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
এই মানসিক সমস্যাকে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। ওসিডির ক্ষেত্রে যেমন বংশগত বা জৈবিক উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তেমনই বিডিডির ক্ষেত্রেও এহেন উপাদানের উপস্থিতি দেখা যায়।
বংশগতীয় প্রভাব
এর পেছনে জিনগত ফ্যাক্টরও কাজ করে। যেসব মানুষের রক্ত সম্পর্কের অাত্মীয় বিডিডিতে ভুগছেন, তাদের এই রোগটিতে অাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অন্যদের চাইতে বেশি।
উপসর্গ
- নিজের ক্রুটিপূর্ণ (!) শরীর ও চেহারার গড়ন নিয়ে মনে বারবার অহেতুক চিন্তার উদয় হওয়া।
- ঘন ঘন আয়নায় নিজেকে দেখার প্রবণতা।
- পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব কিংবা কাছের মানুষের কাছ থেকে শরীরের ত্রুটিযুক্ত অংশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে নিজের বদ্ধমূল ধারণা যাচাই করা।
- অন্যের মুখ থেকে সান্ত্বনা ও আশ্বাসের বাণী শুনতে উন্মুখ হয়ে থাকা।
- অন্যদের সঙ্গে নিজের ত্রুটিযুক্ত (কাল্পনিক) অংশের তুলনা করা। যেমন- নাক, ঠোঁট, চোখ, ব্রেস্ট (সাধারণত নারীদের ক্ষেত্রে), নিতম্ব, পুরুষাঙ্গ (পুরুষের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি।
- নিজের সম্পর্কে হীনম্মন্যতার বোধ জাগ্রত হওয়া।
- একটু পর পর রাগান্বিত এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া।
- মানসিক অস্থিরতার জন্য কাজের দক্ষতা হ্রাস পাওয়া।
- নিজের চেহারার গড়নের জন্য মনে অস্বস্তি এবং ভয়ের জন্ম হওয়া।
- বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের ইচ্ছা হ্রাস পাওয়া।
- লজ্জা ও সংকোচে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
জটিলতা
এই রোগের ফলে সৃষ্ট জটিলতাগুলো হলো
ক. বিষণ্ণতা
খ. আত্মহত্যার প্রবণতা
গ. শুচিবাই
ঘ. সোশ্যাল ফোবিয়া
চিকিৎসা
বিডিডির চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এসব পদ্ধতিকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. সাইকোথেরাপি
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (সিবিটি): এই দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে বিডিডি রোগীর মনে লুকিয়ে থাকা ত্রুটিপূর্ণ শারীরিক গঠনের বদ্ধমূল বিশ্বাসকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়।
সাইকো এডুকেশন: রোগী ও তার পরিবারকে বিডিডি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাইকোথেরাপি এবং ওষুধের ভূমিকা, উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
ফ্যামিলি থেরাপি: সাপোর্টিভ সাইকোথেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।
এছাড়াও রয়েছে শিথিলায়ন বা রিলাক্সেশন ট্রেনিং।
২. ওষুধ
যদি রোগী সাইকোথেরাপির মাধ্যমেও কোনো সুফল না পায়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সেরোটোনিন স্পেসিফিক রিঅাপটেক ইনহিবিটর রোগীর অবসেসিভ চিন্তা ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ফলাফল প্রদর্শন করে।
মূলত ওষুধ ও সাইকোথেরাপি দুটো চিকিৎসা একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব হলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।