নীল চোখের মানুষদেরকে সচরাচর চোখে না পড়লেও তাদের দেখা পাওয়া কিন্তু একেবারেই অসম্ভব নয়। নীল চোখের সাথে ককেশীয় বংশগোত্রের একটি অদ্ভুত মিলবন্ধন রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের চোখের রঙের ভিত্তিতে পরিচালিত এক জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যমতে দুই ধরনের মানুষের চোখের রঙ নীল হতে পারে।
- সুদূর অতীত কোনো পূর্বপুরুষ থেকে জেনেটিক পরিবর্তনের ফসল হিসেবে।
- দৃষ্টিজনিত কোনো চোখের রোগের (যেমন-অকুলার অ্যালবিনিজম) ফলে পিগমেন্ট পরিবর্তনের কারণে।
কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের ক্ষেত্রে নীল চোখের আদিকথা
কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের ক্ষেত্রে নীল চোখের বিষয়টি মূলধারার চোখের রঙের ইতিহাস থেকে আলাদা কিছু নয়। এক্ষেত্রে সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে-
সুদূর অতীতের একটা সময়ে পৃথিবীর সব মানুষের চোখের রঙ মূলত পিঙ্গলবর্ণের ছিল।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স আইবারগ এবং ড্যানিশ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত তার দলের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে-
চোখের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল কোনো রঙের অস্তিত্বের ইতিহাস মূলত এখন থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগের।
এই গবেষণা অনুসারে, আই বারগ এবং তার দল বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৮০০ জন নারী-পুরুষ চিহ্নিত করেন এবং তাদের প্রত্যেকের ‘চোখের ধরণ এবং প্রজাতির’ উপরে বিস্তারিত গবেষণা করেন। ফলাফল হিসেবে তারা দেখতে পান যে এই নীল চোখের অধিকারী মানুষদের চোখের ডিএনএ’র পর্যায়ক্রম প্রায় একই রকম। এক্ষেত্রে তারা একটি সাধারণ সম্বন্ধ খুঁজে পান। তাদের তথ্যানুসারে-
নীল চোখের অধিকারী/ অধিকারিণী প্রতেকেই তাদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ১০ হাজার বছর আগের দক্ষিণ- পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত আদিম কোনো জেনেটিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য বহন করছেন।
এই সম্পর্ক অনুসারে, কারও যদি নীল চোখ থেকে থাকে সেক্ষেত্রে সে হয়তো হলিউড তারকা ম্যাট ডেমন অথবা এলিজা উডের সাথে প্রাচীন কোনো জেনেটিক বন্ধনের আত্মীয়তায় আবদ্ধ! নীল চোখের অধিকারী প্রতেকেই অতীত কোনো বংশ-গোত্রীয় সম্পর্কে যুক্ত।
অন্যান্য সব মানুষের মতোই কৃষ্ণবর্ণের কোনো মানুষ জেনেটিক পরিবর্তনের ফসল। কিন্তু কৃষ্ণবর্ণের ক্ষেত্রে এই বিবর্তনটি ইউরোপ থেকে আসার কারণেই এই বর্ণের কোনো শিশুর ক্ষেত্রে নীল চোখের দেখা পাওয়া বেশ কঠিন। আবারো, কৃষ্ণবর্ণের কোনো শিশুর জন্মের সময় যদি ‘অক্যুলার অ্যালবিনিজম’ জনিত কোনো চোখের সমস্যা থেকে থাকে তবে সেক্ষেত্রে শিশুটির চোখের রঙ নীল হতে পারে।
জেনেটিক পরিবর্তন
আমাদের চোখের মধ্যে ‘মেলানিন’ নামের একধরনের বাদামী পিগমেন্ট থাকে। এই মেলানিন পিগমেন্টের OCA2 জিনের পরিবর্তনের কারণেই মূলত চোখের রঙে একটি নীল পরিবর্তন আসে।
এ সম্পর্কে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোষ এবং আণবিক মেডিসিন’ বিভাগের অধ্যাপক হান্স আইবারগ আরও বলেন-
মানবজাতির সবাই একসময় পিঙ্গলবর্ণের চোখ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অনেকের ক্রমোজোমে OCA2 জিনের বিবর্তনের কারণে চোখের রঙে একটি পরিবর্তন এসেছে এবং ফলশ্রুতিতে তারা পিঙ্গলবর্ণের চোখ নিয়ে জন্মগ্রহণ করার সক্ষমতা হারিয়েছে।
এক্ষেত্রে জেনেটিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে পিঙ্গল বর্ণের চোখের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় একটি ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের অনেকের চোখের আইরিশে মেলানিনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি ‘ঋণাত্মক পরিবর্তন’ সাধিত হয়েছে। একদমই কম মেলানিনের কারণে অনেক শিশুর ক্ষেত্রে পিঙ্গল বর্ণের চোখ সৃষ্টি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ফলাফলস্বরূপ কিছু শিশু নীল চোখ চোখ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
চোখের সমস্যা
স্বাভাবিক জিনগত পরিবর্তন ছাড়াও অন্যান্য কিছু চোখের সমস্যার কারণে শিশুদের ক্ষেত্রে নীল চোখের বিষয়টি দৃশ্যমান হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান যে দুটি সমস্যা গবেষণায় উঠে এসেছে, তা হচ্ছে-
- ওয়্যারডেনবারগ সিন্ড্রোম
- অকুলার অ্যালবিনিজম
চোখের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত সমস্যা দুটির কোনো একটি থেকে থাকলে পিগমেন্টেশনে পরিবর্তন আসে এবং ফলশ্রুতিতে ছয়টি ভিন্ন-ভিন্ন ‘জিন বিশিষ্টের’ কারণে চোখের রঙে পরিবর্তন আসে। এই ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে পিগমেন্ট উৎপাদন কোষের ‘বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন’ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, OCA2 জিনের কারণে অনেক কম পিগমেন্ট সৃষ্টি হয় এবং পিঙ্গল রঙের চোখের বদলে উজ্জ্বল নীল রঙের চোখ উৎপন্ন হয়।
ওয়্যারডেনবারগ সিন্ড্রোমজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে সাধারণত পিগমেন্টের ক্ষেত্রে কোনো অভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি ‘শ্রুতি সমস্যা এবং হেটেরোক্রোমরিয়া’র সাথে সংশ্লিষ্ট। অক্যুলার অ্যালবিনিজমের ক্ষেত্রে অন্যান্য সব অ্যালবিনিজম সমস্যার মতোই মারাত্মক ‘দৃষ্টি সম্বন্ধীয় সমস্যা’ দেখা দেয়। এই সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলোর প্রতি চোখের সংবেদনশীলতা এবং চোখের অস্বাভাবিক আলোড়ন।
বেশিরভাগ নীল চোখের মানুষগুলো কেন ইউরোপবাসী?
আগেই বলা হয়েছে, পৃথিবীর সংখাগরিষ্ঠ মানুষের চোখের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে পিঙ্গল রঙ দেখা যায়। বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকার সিংহভাগ মানুষের চোখের রঙ হচ্ছে পিঙ্গল। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে চিত্রটি একটু ভিন্নই বটে। পৃথিবীতে মানুষের চোখের রঙের ক্ষেত্রে যত রকম তারতম্য দেখা যায় তার বেশিরভাগ উদাহরণ মোটামুটিভাবে ইউরোপেই। নীল চোখের অধিকারী অধিকাংশ মানুষই ইউরোপবাসী। বস্তুতপক্ষে, পৃথিবীতে চোখের রঙ্গের ভিত্তিতে যত বিচিত্র চোখের মানুষ আছেন তার ৮০ শতাংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা। বিশেষ করে এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডের বাসিন্দা।
নীল চোখের ক্ষেত্রে মিউটেশন বা বিবর্তনের উৎসটি এসেছে মূলত ইউরোপ থেকেই। ঠিক এই কারণেই আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বেশিরভাগ নীল চোখের মানুষই ইউরোপবাসী।
এক্ষেত্রে অন্য একটি প্রস্তাবনাও কিন্তু ফেলে দেবার নয়
সাধারণভাবে বলা হয়, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আদি ইউরোপবাসী সচরাচরভাবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে থাকেন। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা ববাবরই তাদের ‘ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে’ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আবার, ইউরোপের কোনো সুদর্শন নীল নয়নধারী পুরুষ পৃথিবীর অনেক মেয়ের কাছেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন। এতে করে একদিকে যেমন আদি ইউরোপে নীল চোখের আধিক্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় ঠিক তেমনিভাবে ইউরোপ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করা পুরুষদের পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে নীল চোখের সন্তান সম্ভাবনাটিও বেশ বেড়ে যায়।
নীল চোখ কি একটি প্রজন্মের ক্ষেত্রে বাদ পড়তে পারে?
নীল চোখ শুধু একটি প্রজন্ম নয় বরং একাধিক প্রজন্মের ক্ষেত্রে বাদ পড়তে পারে। পরিবারের কারও যদি নীল চোখ থেকে থাকে তবে সেক্ষেত্রে এই নিশ্চয়তা কখনোই পাওয়া যাবে না যে তার ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের অবশ্যই কেউ নীল চোখের হবে। পিতা-মাতা উভয়েরই যদি নীল চোখ থেকে থাকে তবে পরবর্তীতে তাদের ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্মের কেউ পিঙ্গল অথবা হ্যাজেল রঙের চোখও পেতে পারে। তবে পরবর্তী বংশানুক্রমে অবশ্যই নীল চোখের দেখা পাওয়া যেতে পারে। বিষয়টি পুরোপুরিভাবে বিবর্তন এবং জিনকেন্দ্রিক।
সবথেকে অপ্রচলিত চোখের রঙ কোনটি?
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের চোখের রঙ পর্যালোচনা করে এই বিষয়টি পরিস্কারভাবে গবেষণায় উঠে এসেছে যে, মানুষের চোখের ক্ষেত্রে সবথেকে অপ্রচলিত রঙটি হচ্ছে সবুজ। পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চোখের রঙ হচ্ছে সাধারণভাবে পিঙ্গল বা কৃষ্ণ। অন্যদিকে, পৃথিবীর প্রায় ২ শতাংশ মানুষের চোখের রঙ হচ্ছে সবুজ। নীল চোখের ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি হচ্ছে ৮ শতাংশ।
নীল চোখের কৃষ্ণবর্ণ বিখ্যাত কয়েকজন তারকা
- মাইকেল ইলি
- স্টিফেন বেলফন্ট
- ক্রিস উইলিয়ামস
- ডেনিস ভাসি
- জেসি উইলিয়ামস
Featured Image- pcdn.co