মিসেস নীহারিকা রায়ের বয়স ৫৮ বছর। একটি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ান তিনি। বাসা থেকে অল্প কয়েক মিনিটের পথ তার কর্মস্থল। এতদিন হেটেই যেতেন। ইদানিং কেমন যেন দুপায়ে বল পান না তিনি, সারা শরীরে অবসন্নতা ঘিরে ধরে। দুদিন আগে বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে এতটাই দুর্বল বোধ করছিলেন যে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি! ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়তে হয়েছে। সেই শুরু। পা দুটো যেন তার দেহের ভার বহন করতে অসমর্থ। যখন তখন আচমকা মনে হয়, শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ শুষে নিয়েছে!
এর মধ্যে নতুন আরেক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সেদিন ক্লাসে ‘শেষের কবিতা’ পড়াচ্ছিলেন। পুরো বইটিই তার কণ্ঠস্থ। তাই বই টিচার্স রুমেই রয়ে গিয়েছিলো। পড়াতে পড়াতে আচমকা টের পেলেন, শেষের কবিতার কাহিনীটিই তার মনে পড়ছে না। তিনি ঘামতে শুরু করলেন। এ সব কী হচ্ছে তার? হঠাৎ করে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। তারপর শিক্ষার্থীদের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এ কী দেখছেন তিনি?
ছাত্ররা কই গেলো? কোথায় জানি তারা মুহুর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছে। তার বদলে সামনের বেঞ্চে সার বেধে বসে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ আর সত্যজিৎ রায়। মেয়েদের পাশে তাকাতেই দেখলেন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল আর লীলা মজুমদার মিটিমিটি হাসছেন! কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। ভয়ে আতঙ্কে ছুটে বেরিয়ে গেলেন নীহারিকা রায়। তারপর থেকে প্রায়ই হ্যালুসিনেশন হতে থাকলো তার। কবি সাহিত্যিকদের প্রায়ই চোখের সামনে দেখা শুরু করলেন তিনি। কখনো বেডরুমে কাজী নজরুল এসে বিদ্রোহী কবিতা আওড়ান, তো কখনো ঘরের সামনের বাগানে কবিগুরু গম্ভীরমুখে পদচারণা করতে করতে শেষের কবিতার কয়েক লাইন শুনিয়ে দেন!
আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কাজকর্ম শিকেয় উঠলো তার। শরীর শুকিয়ে যেতে থাকলো। রাত্রে ঘুম আসে না আর। সারারাত বিছানায় বসে থাকেন। বহু বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকরা রাত হলেই তার বিছানার পাশে এসে হাজির হয়। তিনি তাদের সাথে গল্প করেন। বাড়ির লোকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
আমাদের দেশে এমনিতেই মানসিক সমস্যা নিয়ে নানবিধ ট্যাবু আছে, কুসংস্কার আছে। কেউ সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে গেলে, একটি পাগল উপাধি লোকজন তার নামের সাথে যুক্ত করে দেয়। তাই সহজে কেউ সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হতে চায় না। তারাও প্রথমে সেদিকে গেলেন না। বাড়ির লোকেরা এক আত্মীয়ের পরামর্শে আর জোরাজুরিতে একজন ফকির-কবিরাজের কাছে তাকে নিয়ে গেলেন, সেখানে ঝাড়ফুঁক চলল মাসখানেক। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
অবশেষে বাধ্য হয়েই তারা একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে উপস্থিত হলেন। ওষুধও দেওয়া হলো, কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। এমন সময়ে সাইক্রিয়াটিস্ট সাহেব রোগীর লোকজনকে আবার ডাকলেন। তারপর বিস্তারিত রোগ বিবরণ খুঁটিনাটি সমেত আগাগোড়া শুনে একজন নিউরোলজিস্টের কাছে মিসেস রায়কে ‘রেফার’ করলেন, সাথে একটি চিরকুট লিখে দিলেন।
নিউরোলজিস্ট ডাক্তার চিরকুটটি পড়লেন। তারপর ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফি (Electroencephalography) এবং সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বিশ্লেষণ (Cerebrospinal fluid Analysis) করতে দিলেন। পরীক্ষায় ধরা পড়লো মিসেস রহমান ক্রোয়েটজফেল্ট-জ্যাকব (Creutzfeldt-Jakob) রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার মিসেস রায়কে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে আট মাসের মাথায় মিসেস রায় পরলোকগমন করলেন।
ক্রোয়েটজফেল্ট-জ্যাকব রোগ একটি জটিল স্নায়ুতন্ত্রের রোগ। প্রিয়ন কণার নাম কমবেশি সবাই শুনেছি। গরুর ম্যাড কাউ ডিজিজ, মানুষের কুরু, ভেড়ার স্ক্রাপি, ফেটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসমনিয়া’র মত প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টির পেছনে এরা দায়ী। তবে প্রিয়ন সবচেয়ে বেশি যে রোগটি ছড়ায় তার নাম ক্রোয়েটজফেল্ট-জ্যাকব ডিজিজ। এই রোগের কাহিনী বুঝতে হলে প্রিয়ন সম্পর্কে আমাদের কিছুটা জানা প্রয়োজন।
তবে প্রিয়ন কি সেটি বুঝতে হলে তার আগে আমাদের ভাইরাস জিনিসটি কী তা বুঝতে হবে! জীবের সমস্ত তথ্য সঞ্চিত থাকে নিউক্লিক এসিডে। এটি দু’ধরনের হতে পারে- ডিএনএ এবং আরএনএ। ভাইরাস হলো একটি প্রোটিন আবরণী দিয়ে ঢাকা এক টুকরো নিউক্লিক এসিড। যখন জীবকোষের ভেতরে থাকে, তখন এটি নিজের অসংখ্য কপি তৈরি করে চলে, মানে বংশবিস্তার করে। পাশাপাশি আর একটি কাজ করে এরা- রোগ সৃষ্টি। প্রিয়ন এই ভাইরাস থেকেও আরো এককাঠি সরেস। এদের কোনো জেনেটিক উপাদানই নেই! আছে শুধু একটি প্রোটিন কাঠামো। এরা যদি একবার আমাদের দেহে ঢুকে পড়ে তাহলে আর আমাদের রক্ষা নেই। কিন্তু এরা করে কী? চলুন এবার সেটাই জানা যাক।
ঘর যেমন ইটের পর ইট গেঁথে তৈরি করা হয়, তেমনি আমাদের দেহ প্রোটিন দিয়ে তৈরি। আর এই প্রোটিন তৈর হয় এমিনো এসিড দিয়ে। এমিনো এসিড সুতার মতো একটির মাথায় আরেকটি বসে বসে লম্বা আমিনো এসিড চেইন বা প্রোটিন তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, হিমোগ্লোবিনের আলফা চেইন তৈরি করতে হলে একশ ছেচল্লিশটি এমিনো এসিড লাগে। কিন্তু বিশাল লম্বা এমন এমিনো এসিড কোষীয় গঠনের জন্য উপযুক্ত নয়। এদের কাজে লাগাতে হলে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পেঁচিয়ে দলা পাকিয়ে তাকে ত্রিমাত্রিক কাঠামোতে রূপান্তরিত করতে হয়। একে বলা বলা হয় প্রোটিন ফোল্ডিং। আমাদের দেহে যত প্রোটিন আছে, সব আছে এই ত্রিমাত্রিক কাঠামোতে।
প্রিয়ন গিয়ে এখানেই আঘাত করে। এমিনো এসিডের ত্রিমাত্রিক রূপকে সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। তাকে আক্রমণ করে আবার লম্বা চেইন এ রূপান্তরিত করে ফেলে। এরপরেই সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ অবস্থার। ত্রিমাত্রিক রূপ থেকে চেইনে রূপান্তরিত প্রোটিন নিজেই একটি প্রিয়ন হয়ে যায়। ঠিক যেন কোনো এক জোম্বি মুভির মত। কিংবা নিউক্রিয়ার চেইন রিয়াকশনের মতো। একবার ক্ষয় হওয়া শুরু করলে ক্ষয় হতেই থাকবে। স্নায়ুতন্ত্রে চলতে থাকে প্রিয়নের এই ধ্বংসলীলা। দ্রুতগতিতে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে প্রোটিনের ধ্বংসপ্রক্রিয়া। এর ফলে ছোট ছোট ছিদ্র তৈরি হয়। স্পঞ্জের মতো ঝাঁঝরা হয়ে যায় মস্তিষ্ক। এজন্য প্রিয়ন দ্বারা সৃষ্ট রোগের সমষ্টিগত নাম ‘সংক্রামক স্পঞ্জের ন্যায় এনসেফালোপ্যাথি’ বা transmissible spongiform encephalopathies (TSEs)।
এটি এতটাই মারাত্মক যে শতকরা ৯০ ভাগ রোগী আক্রান্ত হওয়ার এক বছরের মাথায় মারা যায়। এটি একইসাথে বেশ বিরল এবং একটি ছদ্মবেশী রোগ। সাধারণত গড়ে প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে! যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত রোগীদের একটি বড় অংশই আসলে আলঝেইমারে আক্রান্ত নয়। তারা ভুল সিদ্ধান্তের শিকার। কারণ মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করে দেখা গেছে যে, ১-৩ ভাগ আলঝেইমার রোগীই আসলে ক্রোয়েটজফেল্ট-জ্যাকব রোগের শিকার।
অন্যদিকে আক্রান্ত রোগী প্রাথমিকভাবে স্মৃতিভ্রংশ বা বুদ্ধিবৈকল্যতা (Dementia) নিয়ে হাজির হয়। আস্তে আস্তে সে ‘ভুলে যাওয়া’ রোগে আক্রান্ত হয়। একইসাথে ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন দেখা যায়। একসময় তার মধ্যে হ্যালুসিনেশন দেখা দেয়। শরীরের মাংসপেশীতে একধরনের খিঁচুনিও হতে পারে। সেই সাথে উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, শুচিবায়ুগ্রস্থতা তাকে গ্রাস করে নেয়, যেগুলো একজন মানসিক রোগীর সাথেই বেশি মিলে যায়। তাই রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ রোগটি সম্পর্কে প্রথম বর্ণনা করেন জার্মান নিউরোলজিস্ট হ্যান্স গেরহার্ড ক্রুয়েটজফেল্ট এবং আলফোনস মারিয়া জ্যাকব। দুজনের নামে থেকেই রোগের নামকরণ করা হয়েছে। আক্রান্ত রোগীর ভাগ্য দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। অধিকাংশ রোগী রোগের লক্ষণ দেখার ৬ মাসের ভেতর মারা যায়। শতকরা ১৫ ভাগ রোগী ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
প্রিয়নের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে এটি আমরা আগেই জেনেছি! কিন্তু কিভাবে? আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে স্নায়ুতন্ত্রে এমিনো এসিডের ‘মিসফোল্ডিং’ এর জন্য এটি হতে পারে। সাধারণত যে প্রোটিন থেকে প্রিয়ন তৈরি হয় তাকে ‘প্রিয়ন প্রোটিন’ বলা হয়ে থাকে। কিছু কিছু মানুষের ‘প্রিয়ন প্রোটিন জিন’-এ মিউটেশন থাকে। ফলে প্রিয়ন তৈরি হয়। এর পরিমাণ ৫-১০ ভাগ।
বাইরে থেকেও আমাদের দেহে এই প্রিয়ন সংক্রামিত হতে পারে। কারণ এটি এতটা মারাত্মক যে তাপ দিলে এরা নষ্ট হয় না, এসিডে চুবালে ক্ষয় হয় না, রেডিয়েশন এদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। তাই বাতাসে ভেসে ভেসেও এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
প্রিয়ন কণা আছে এমন মাংস খেলে সেই মাংস থেকেও প্রিয়ন শরীরে ঢুকে পড়ে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের সাথে সাথে হয়ত কারো দেহে প্রিয়ন ঢুকে পড়েছে। কিংবা রক্ত সঞ্চালন করবেন? গ্যারান্টি কী! হয়ত চুপিচুপি আপনার দেহে ঢুকে পড়লো প্রিয়নকণা! চেক করবেন কিভাবে? ভাইরাস থেকেও ক্ষুদ্র এই কণা!
আর চিকিৎসা? সে আশা করেও বিশেষ লাভ নেই। কারণ এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসাই নেই। তবে মন্দের ভালো, কম বয়সে ক্রোয়েটজফেল্ট-জ্যাকব ডিজিজ সাধারণত প্রকাশ পায় না মানুষের দেহে। আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়সসীমা ৬০ বছর। এই রোগের হারও বেশ কম। ১০ লক্ষ মানুষে একজন! আপনি নিশ্চয়ই অতটাও দুর্ভাগা নন!
Feature Image: Protex Meds 24×7