পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) মূলত একটি দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক ব্যাধি। খুব ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতা, দুর্ঘটনা বা স্ট্রেসের সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই এই ব্যাধিতে ভুগে থাকেন, যার ফলাফলসমূহ প্রকাশিত হয় ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন বা ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে। পিটিএসডির আগের নাম ছিল শেলশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকরা দেশে ফেরার পর তাদের অধিকাংশের মাঝেই একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধরত অবস্থায় তারা যেসব অমানবিক, জঘন্য দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার কারণে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পরও তারা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে পারছিলেন না। সেই অকল্পনীয় অভিজ্ঞতার প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে যাবার পর আজও পিটিএসডির শিকার প্রধানত পুরুষরাই, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় পুরুষদের উপস্থিতি যথেষ্টই বেশি। অর্থাৎ প্রসঙ্গ যখন পিটিএসডি তখন অনেকটা অবধারিতভাবেই যুদ্ধ ও পুরুষ আলোচনার সিংহভাগ দখল করে নেয়।
পিটিএসডির কারণ হিসেবে যদি বলা হয় মাতৃত্বও দায়ী, খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে কি? সেরকম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির নিয়মে নারীরাই সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াটির সাথে জড়িত। এখানে বলে রাখা ভালো সন্তান জন্মদান বলতে আজকের এই আয়োজনে প্রতিবারই স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়াকেই নির্দেশ করা হবে। সন্তান জন্মদানের স্বাভাবিক যে নিয়ম সেটি যে বর্ণনাতীত কষ্টের সে নিয়ে আমাদের কারও মনেই লেশমাত্র দ্বিধা নেই। অর্থাৎ প্রসূতি মায়ের শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের কারও মনে কোনো সন্দেহের দোলাচল নেই। কিন্তু একজন নারীকে প্রায় নয় মাস গর্ভকালীন অভিজ্ঞতা শেষে একজন শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পর, তার যে মানসিক অবস্থা হয় সেটার খোঁজ কি আমরা রাখি?
সুপ্রিয় পাঠক, ঠিক এই জায়গাটিতেই মাতৃত্বের একটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, অনালোচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের প্রবেশ। মাতৃত্বজনিত পিটিএসডি। অর্থাৎ একটি বিষয় অন্তত এবার সুস্পষ্ট যে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসা পুরুষ সৈনিকদের পাশাপাশি গর্ভধারিণীরাও ভয়াল এক মানসিক ব্যাধির শিকার হন। নারীদের ক্ষেত্রে পিটিএসডি গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী দুই সময়েই হতে পারে।
সিটি ইউনিভার্সিটি অভ লন্ডনের কয়েকজন গবেষক একটি জরিপ পরিচালনা করেন মাতৃত্বকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে নারীদের মাঝে পিটিএসডির হার নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডেটাবেজ অনুসন্ধান করে তারা সর্বমোট ৫৯টি গবেষণাপত্র নির্বাচন করেন তাদের রিভিউ আর্টিকেলের জন্য। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করে নেওয়া দরকার। প্রিন্যাটাল বা আন্টিন্যাটাল বলতে সন্তান জন্মদানের আগের সময় এবং পোস্টন্যাটাল বলতে সন্তান জন্মের পরের সময়কে বোঝানো হয়ে থাকে। কমিউনিটি পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যমতে, প্রিন্যাটাল পিটিএসডির গড় প্রাদুর্ভাব ৩.৩% (95%, CI 2.44–4.54)। অন্যদিকে প্রসবজনিত পিটিএসডির গড় প্রাদুর্ভাব ৪.০% (95%, CI 2.77–5.71)। গবেষণায় যেসব নারীদের উচ্চ ঝুঁকির দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তাদের প্রিন্যাটাল পিটিএসডির গড় প্রাদুর্ভাব ছিল ১৮.৯৫% (95%, CI 10.62–31.43) এবং পোস্টন্যাটাল পিটিএসডির ক্ষেত্রে এই হার ছিল ১৮.৫% (95%, CI 10.6–30.38)। গবেষকরা তাদের কাজ সম্পর্কে এই উপসংহারে উপনীত হতে সক্ষম হন যে, গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে পিটিএসডির আদর্শ চিহ্নিতকরণ ও সুচিকিৎসার অভাব, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের অন্যতম কারণ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ৮০৩ জন নারী গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতার দরুন মৃত্যুবরণ করছেন। ১৯৯০ এর দিকে আমেরিকান সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশন পিটিএসডির নতুন সংজ্ঞায়ন করে। পূর্ববর্তী “মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি সীমার বাইরে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা” বাদ দিয়ে তারা নতুন করে প্রণয়ন করে “আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের অথবা তার পরিচিত কারও প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ শারীরিক কোনো অভিজ্ঞতার দরুন অসহায়, ভীত বা আতঙ্কিত বোধ করা”। এই নব্য সংজ্ঞায়নের মধ্য দিয়েই মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে মাতৃত্বজনিত পিটিএসডিকে বিশ্বব্যপী স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এরপর থেকেই মাতৃত্বের এই ভয়াবহ দিকটিকে সবাই আমলে নিতে আরম্ভ করে। বিশ্ব ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতি বছর ১৩০ মিলিয়ন শিশুর জন্ম হয়। এই হিসাব থেকেই সহজেই অনুমেয় যে, সন্তান জন্মদানকারী নারীদের কত বিশাল একটি অংশ পিটিএসডির সম্ভাব্য শিকার হতে পারেন!
এই অবধি যতটুকু আমরা আলোচনা করলাম তাতে পাঠকের মনে ধারণা হতেই পারে যে প্রসবই পিটিএসডির মূল কারণ। হ্যাঁ, একটি বিষয় অনস্বীকার্য যে, একজন মাকে যে প্রসব বেদনা সহ্য করতে হয় তা এককথায় অকল্পনীয় এবং অমানবিক তো বটেই। অর্থাৎ শারীরিক যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে একজন মানবশিশুকে পৃথিবীর আলো দেখানো অবশ্যই কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু পিটিএসডির মূল কারণ প্রকৃতপক্ষেই এই অমানুষিক শারীরিক যন্ত্রণা নয়। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একজন নারী সামগ্রিকভাবে কী রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে তিনি পিটিএসডিতে ভুগবেন কি না? প্রিন্যাটাল ও পোস্টন্যাটাল এই সম্পূর্ণ সময়কে তিনি কীভাবে অনুভব বা প্রত্যক্ষ করছেন সেটিই গর্ভধারণ, মাতৃত্ব, প্রসব ইত্যাদি সম্পর্কে তার পূর্ণাঙ্গ ধ্যানধারণা গড়ে দেয়। এই চিন্তা চেতনার ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতার উপর নির্ভর করে একজন নারী পিটিএসডির মতো মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন কি না।
মাতৃত্ব সম্পর্কে একজন গর্ভবতী নারীর চিন্তাধারা কীরকম হবে তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন:
- গর্ভকালীন ও প্রসবের সময়ে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু। তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে পুরোটা সময় কাটাচ্ছেন;
- পরিবারের সদস্যরা তার কতটা যত্ন নিচ্ছেন;
- আশেপাশের মানুষরা তার প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করছেন;
- ধাত্রীরা তার প্রতি কতটা আস্থাশীল থাকছেন এবং কতটা নিবিড়তার সাথে তার দেখভাল করছেন;
- একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জীবনে পিটিএসডি, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক রোগের ইতিহাস;
- কোনো নারীর শৈশবে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা।
পিটিএসডিকে বয়ে নিয়ে চলা এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। সাধারণত যেকোনো স্মৃতি মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে সঞ্চিত হয়ে থাকে। কিন্তু যদি অভিজ্ঞতাটি হয় ট্রমাটিক, তাহলে মানুষের মস্তিষ্ক ফাইট অর ফ্লাইট মুডে চলে যায়, এবং এর ফলে অ্যামিগডালা ক্রিয়াশীল হয়। অ্যামিগডালার কার্যক্রমের কারণেই সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতাটি অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী অঞ্চল হিপোক্যাম্পাসে সঞ্চিত না হয়ে মস্তিষ্কের প্রাথমিক অংশে স্মৃতি হিসেবে জমা হয়। ফলে যেকোনো ধরনের সম্পর্কিত ঘটনা দ্বারা মস্তিষ্ক পরিচালিত হয়ে সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।
যেসব নারী মাতৃত্বজনিত পিটিএসডিতে ভুগে থাকেন তাদের সামগ্রিক জীবনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যখন একজন নারী গর্ভধারণ করেন তখন তাকে চারপাশের মানুষ রাজকন্যা হিসেবেই অভিহিত করে থাকেন। তাদের সব চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা তখন মা হতে চলা নারীটিকে ঘিরেই থাকে। কিন্তু সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মায়ের অস্তিত্বের কথা যেন সবাই বেমালুম ভুলে যান। মুহূর্তের মাঝেই সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে নবজাতক। চারপাশের মানুষের এহেন অবহেলার দরুন পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে সদ্য মা হওয়া নারীটির নিজেরও যে সেবা-যত্ন দরকার সেই কথা উচ্চারণ করতে তিনি ভয় পান। এমন নানাবিধ কারণে একজন নারী যখন পিটিএসডির শিকার হন তখন এর ফলাফল হিসেবে তিনি নিজেরই অজান্তে জীবনসঙ্গীকে দূরে সরিয়ে দেন। তার এই দূরত্ব তৈরি করা ইচ্ছাকৃতই, আবার এ কথাও সত্য যে, পিটিএসডিতে ভুগতে থাকা একজন নারীর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ খুব কমই থাকে। এই সময়টাতে যে মানুষটিকে তার সবচেয়ে বেশি দরকার তার কাছ থেকেই তিনি দূরে সরে যান।
মাতৃত্ব একটি আশীর্বাদ। তবে সমগ্র পৃথিবীতে খুব কম মানুষই এটা অনুভব করতে পারেন যে, মাতৃত্বের যাত্রাটি মায়ের একার নয়। সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে গিয়ে একজন মা সুদীর্ঘ সময়ব্যপী যে তীব্র শারীরিক ও মানসিক ধকল সহ্য করেন তার অংশীদার হওয়াটা আশেপাশের মানুষের জন্য বোধ করি দায়িত্বের চেয়েও বেশি কিছু।
[প্রসূতি নারীর যত্ন কীভাবে করবেন? জানতে “গর্ভবতী, প্রসূতি ও নবজাতকের যত্ন” বইটি পড়ুন।]