মানসিক স্বাস্থ্য: সুরক্ষা ও সচেতনতা

রাস্তা ধরে ছুটছেন এক শতছিন্ন পোশাক পরিহিত উষ্কখুষ্ক চুলের ব্যক্তি। তার পেছনে পাগল পাগল বলে হৈ হৈ করে তেড়ে যাচ্ছে পাড়ার ছেলেরা। কারো হাতে ঢিল, কারো হাতে লাঠি। বেশ কয়েকটা ঢিল চোখের পলক পড়তে না পড়তেই উড়ে গেলো উদভ্রান্তভাবে দৌড়াতে থাকা লোকটির দিকে।

আশাপাশের মানুষদের তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকে মজা দেখতে রাস্তার পাশে জমা হয়েছেন। কেউ কেউ তো রীতিমত চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন ছেলেদের। তাদের হয়তো মনে নেই যে মানুষটিকে পাগল বলে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়া হচ্ছে তিনিও মনুষ্য প্রজাতিরই সন্তান, কোনো পরিবারেরই একজন। সঠিক চিকিৎসা আর সেবা পেলে তার পক্ষেও হয়তো সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। কিন্তু সমাজের চাপেই তারা হারিয়ে যান।

ঘটনাটি কাল্পনিক। তবে আমরা কি বলতে পারবো চোখের সামনে কখনো এরকম কিছু দেখিনি? অথবা কেউ না কেউ কোনো না কোনো সময়ে যোগ দেইনি পাগল বলে কাউকে উত্যক্ত করার দলে?

এ তো গেল কেবল একধরনের রোগীর কথা। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া আত্মহত্যার প্রবণতা, বিশেষ করে পরীক্ষার ফলাফল মনমত না হলে সমাজ আর পরিবারের হাতে নিগৃহীত হবার ভয়ে আত্মহত্যা তাও কিন্তু মানসিক অবস্থার ভঙ্গুর দশা নির্দেশ করে। বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা বা অ্যানক্সাইটি ইত্যাদি মানসিক সমস্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কোভিড অতিমারির প্রভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।

২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট (NIMH) কর্তৃক পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে আমাদের দেশে আঠার বছর ও তদুর্ধ্ব মানুষের মধ্যে ১৮.৭% কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে ষাট বছরের উপরে যারা তাদের মধ্যে এই হার সবথেকে বেশি, ২০.২%।

শুধু আত্মহত্যার কথা বিবেচনায় নিলেও পরিসংখ্যান খুব ভালো নয়। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে গড়ে প্রতি বছর ১০০০০ মানুষ আমাদের দেশে এই চরম পথ বেছে নেন, যারা আত্মহত্যায় সফল হন না তাদের কথা তো ধরাই হয়নি। দেখা গেছে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়সই ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। 

বাংলাদেশে মানসিক সমস্যার প্রকোপ কম নয়; Image Source: banginews.com

পরিপার্শ্বিক নানা কারণে সারা বিশ্বেই মানসিক স্বাস্থ্য এখন চরম উদ্বেগের বিষয়। শারীরিক রোগের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা ভুলেই গেছি যে মনও শরীরের অংশ, একে ভালো রাখতে না পারলে কেবল শরীরের রোগ সারিয়ে সুস্বাস্থ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই মনের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।

কিন্তু কীভাবে আমরা তা করতে পারি? বেশ কিছু কাজ এখানে করা যায়। নিয়ম করে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো, ঘুমের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করা, পরিমিত ব্যয়াম, নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, ক্যাফেইন যুক্ত অথবা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় পান সীমিত করা ইত্যাদি শরীরের পাশাপাশি মাথাও ঠাণ্ডা করে।

তবে মনের পরিচর্যার বড় একটি উপায় মানুষের সঙ্গ। সামাজিক প্রাণী আমরা, সুতরাং অন্যান্যদের সাথে মেলামেশা, কথা বলা এসব না করতে পারলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। যদিও মুখোমুখি সাক্ষাৎই এক্ষেত্রে সবথেকে কার্যকর, তবে কোভিড অতিমারি আমাদের নতুন বাস্তবতা বা নিউ নরম্যালের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

নানাভাবে প্রকাশ পেতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা; Image Source: healthdirect.gov.au

কিন্তু আমাদের তো প্রযুক্তি আছে। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি ব্যবহার করে সবসময়েই আমরা সংযুক্ত থাকতে পারি। প্রযুক্তিকে যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আখেরে লাভ আমাদেরই। তবে সংযুক্ত থাকার নামে ২৪ ঘণ্টা ফোনে বা ল্যাপটপে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা কিন্তু মনকে ভালো না করে খারাপের দিকে ঠেলে দিতে পার। তাই পরিমিতবোধের দরকার আছে।

সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষতিকর হতে পারে; Image Source: news.sky.com

মনকে সতেজ রাখার জন্য মাঝে মাঝে একঘেয়ে রুটিনে বৈচিত্র্য আনা উচিত। এর মানে হতে পারে ছুটির দিনে কোথাও থেকে ঘুরে আসা। দূরে কোথাও যেতে হবে এমন কোন কথা নেই, নতুন করে নিজের চেনা শহরটাকে দেখার চেষ্টাও কিন্তু বৈচিত্র্যের সন্ধান দিতে পারে। সবসময় যে ঘুরতে যেতে হবে এমন কোন কথাও নেই। আমরা এমন কিছু করার চেষ্টা করতে পারি যা কালেভদ্রে করা হয়। হয়তো ঘরটা পরিষ্কার করা, কম্পিউটার আর ফোন বন্ধ করে একটু হেঁটে আসা।

খুঁজে বের করতে হবে কী আমাদের আনন্দ দেয়। সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, বই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা কোনটা আমাদের মনকে উদ্দীপ্ত করে। হয়তো সবগুলোই। যেটাই হোক দৈনন্দিন ব্যস্ততার বাইরে এই সময়টুকু করে নিতে হবে। হাসতে হবে প্রতিদিন, সেটা হতে পারে কোন কৌতুক পড়ে অথবা মজার কোনো সিনেমা দেখে বা মজার কোনো  মানুষের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে। মুখটাকে বাংলা পাঁচের মত বানিয়ে রাখলে মনটাও সেরকমই রয়ে যাবে। 

জীবনে অন্তত একবার হলেও চেষ্টা করা দরকার নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যেতে। সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো জায়গায় ইন্টারনেট আর ডিজিটাল পৃথিবীকে সাময়িকভাবে ত্যাগ করে ঘুরে আসা গেলে মস্তিষ্ক হবে অনেক চনমনে। তবে একাজ করতে গেলে নিরাপত্তার বিষয়টা আগে অবশ্যই নিশ্চিত করে নিতে হবে।

নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনে হয় তার প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ইত্যাদি তার সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়টি আমাদের সমাজে এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। মানসিক রোগীকে আমরা অনেকেই পাগল বলে ধরে নিই, অথচ মানসিক সমস্যার ব্যাপ্তি আরো অনেক বড়।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নেয়া যেতে পারে বিভিন্ন পদক্ষেপ; Image Source: pradhipayoga.com

মানসিক ব্যাধি নিয়ে প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারের কারণে অনেকেই কিন্তু তাদের রোগ নিয়ে কথা বলতে ভয় পান। বহু মানুষ আছেন যারা জানেন তাদের মানসিক চিকিৎসা দরকার হতে পারে, কিন্তু সমাজ কি বলবে এই চিন্তায় তারা পিছিয়ে যান, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার আর ফলশ্রুতিতে সেই সমাজই। 

বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় বিষয় যেটা বলা হয় তা হলো এই বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা। দরজা জানালা আটকে চোখ বন্ধ করে থাকলে এই সমস্যা পালিয়ে যাবে না, বরং আরো বাড়বে। কথা বলতে হবে, শুনতে হবে। নিজেকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মনে হলে আলোচনা করতে হবে বিশ্বস্ত কারো সাথে। তিনি হতে পারেন আত্মীয়, বন্ধু বা অন্য কোনো শুভানুধ্যায়ী। বিশ্বস্ত ব্যক্তিটির মূল কাজই হবে একজন মনোযোগী শ্রোতার, তাকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনোভাবেই মানসিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষটি তার কোনো কথায় আঘাত না পান।

স্মরণ রাখা দরকার যে আমাদের দেশে এই খোলামেলা কথা বলার সংস্কৃতি এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া অনেক সময়েই রোগী পরিচিত কারো সাথে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। সেক্ষেত্রে সরাসরি মানসিক চিকিৎসক বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলরদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব।

আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি এনজিও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। ‘কান পেতে রই’ কাজ করে আত্মহত্যার চিন্তা করছেন এমন লোকদের নিয়ে, ‘মনের বন্ধু’ উদ্বেগ বা অ্যানক্সাইটি, ‘মনের ডাক্তার’ আর ‘মনের যত্ন মোবাইলে’ এদের ফোকাস অতিমারির জন্য সংঘটিত মানসিক অবসাদ নিয়ে। তাদের হেল্পলাইনে ফোন দিয়ে কাউন্সেলরদের পরামর্শ নেয়া সম্ভব।

শারীরিক আর মানসিক স্বাস্থ্য দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একটি খারাপ হলেই বিপদ। শারীরিক রোগে যেমন চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এখানে লজ্জার কিছু নেই, মন থাকলে রোগ থাকতেই পারে।

This is a Bengali language article about Mental Health. Necessary references are mentioned below. 

References

  1. Building Better Mental Health. HelpGuide.
  2. Hasan, M. T., Anwar, T., Christopher, E., Hossain, S., Hossain, M. M., Koly, K. N., Saif-Ur-Rahman, K. M., Ahmed, H. U., Arman, N., & Hossain, S. W. (2021). The current state of mental healthcare in Bangladesh: part 1 - an updated country profile. BJPsych international, 18(4), 78–82. https://doi.org/10.1192/bji.2021.41
  3. Henderson, C., Evans-Lacko, S., & Thornicroft, G. (2013). Mental illness stigma, help seeking, and public health programs. American journal of public health, 103(5), 777–780.
  4. Online and tele-counselling services to seek mental health support from, Daily Star

Feature Image © Adobe Stock

Related Articles

Exit mobile version