কোনটি আগে আসে, আনন্দ নাকি হাসি? খুবই সাদামাটা একটি প্রশ্ন এটি। ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো জটিল কিছুই নয়। কেননা সাধারণ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষই জানে আনন্দ ও হাসির পার্থক্য। এবং আগে যে মানুষ কোনো বিষয়ে আনন্দিত হয়, এবং তারপর সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তাদের মুখে হাসির রেখা উদ্ভাসিত হয়, সে কথাও কারো অজানা নয়।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো: আগে আনন্দ, পরে হাসি, এই ব্যাপারটা কি সব সময়ের জন্যই ধ্রুব সত্য? কখনোই কি এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটা যাবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই দাবি করতে পারেন, আনন্দিত না হলে হাসবো কেন খামোকা! হ্যাঁ, এমন দাবিতে কোনো ভুল নেই। কোনো কারণ ছাড়া কেউ কেন হাসতে যাবে? বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই অকারণে হাসিকে পাগলামির লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে, যদি বলি, কোনো কারণ ছাড়াই হাসার পেছনেও কোনো কারণ থাকতে পারে? কথাটা হেঁয়ালির মতো শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু একটি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল এ কথাই জানাচ্ছে। সাধারণ অর্থে হাসির কার্যকারণ হিসেবে আনন্দকে বোঝানো হয়ে থাকলেও, চাইলে কেউ বিনা আনন্দেই হাসতে পারে। এমন হাসির পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো মস্তিষ্ককে ধোঁকা দেয়া, এবং বিষণ্ন বা দুঃখী মনকে আনন্দিত করে তোলা।
আমেরিকার মনোবিদরা প্রায় ৫০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেছেন, মানুষের মৌখিক অভিব্যক্তি তাদের আবেগীয় পরিবর্তনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে কি না। এমআরআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দীর্ঘ এক গবেষণার মাধ্যমে তারা চূড়ান্তভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, হাসলে মানুষ আরো আনন্দ বোধ করে, ভুরু কুঁচকে থাকলে আরো দুঃখ বোধ করে, এবং মুখ গোমড়া করে থাকলে আরো রাগান্বিত বোধ করে।
কেন এমনটি হয়ে থাকে? এর কারণ হলো, মানুষ যখন কোনো নির্দিষ্ট মৌখিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, তখন তার মুখের পেশিসমূহে ওই অভিব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত কিছু সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কে ওই অভিব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট আবেগের বার্তা পৌঁছে যায়। মস্তিষ্কে তখন একই ধরনের আরো রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটে, যা মানুষের মধ্যে ওই ধরনের আবেগের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মৌখিক অভিব্যক্তির সাথে মানব মস্তিষ্কের গভীর যোগসাজশ আছে, এবং মস্তিষ্ক মৌখিক অভিব্যক্তিকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। একজন ব্যক্তি হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই একটু হাসলো, কিন্তু মস্তিষ্ক ধরে নেবে ব্যক্তিটির সাথে হয়তো কোনো আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে, তাই সে ওই ব্যক্তির আনন্দের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। একই ধরনের ঘটনা রাগ, হতাশা, ভয় প্রভৃতি আবেগের ক্ষেত্রেও ঘটবে। অর্থাৎ একবার কোনো ব্যক্তি সামান্য রাগ বা হতাশা বা ভয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ফেললে, তার মধ্যে ওই আবেগটি আরো বেড়ে যাবে।
এবার তাহলে ফিরে যাওয়া যাক সেই শুরুর প্রসঙ্গে, যেখান থেকে আমরা এই আলোচনা শুরু করেছিলাম। কেন কোনো কারণ ছাড়াই একজন মানুষ হাসবে, কিন্তু অন্য কোনো আবেগের অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে না? কারণটা খুবই সহজ। একমাত্র আনন্দই একটি ইতিবাচক আবেগ, বাকি সকল আবেগই নেতিবাচক। ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখার জন্য তাই আনন্দবাচক হাসিরই প্রয়োজন আছে, অন্য কোনো অভিব্যক্তির নয়।
ধরা যাক, আপনার হয়তো কোনো কারণে মনটা খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু সেই মন খারাপের কথা ভাগ করে নেবার মতো কেউও এই মুহূর্তে আপনার সাথে নেই, যাতে করে আপনার মনটা একটু হালকা হবে। এখন তাহলে আপনার কী করণীয়? মুখ গোমড়া করে রাখা, কিংবা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকা? না, ভুলেও অমন কাজ করবেন না। একাকী অবস্থায় এমন নেতিবাচক অভিব্যক্তি বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ আপনার মনকে আরো বিষণ্ণ, দুঃখিত করে তুলবে। তার চেয়ে আপনি বরং একটু হাসতে পারেন। মন খারাপ অবস্থায় মুখে হাসি আনা কিছুটা কষ্টকর বটে, কিন্তু একবার যদি মুখে হাসি এনে মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করা যায়, তাহলে আপনার দুঃখবোধ অনেকটাই কমে যেতে পারে।
হাসির গুণাগুণের বিবরণ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। হাসি কেবল দুঃখ দূর করে মানুষের মনকে চাঙ্গা ও আনন্দিতই করে না। পাশাপাশি হাসির মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে আরো বেশ কিছু উপকার পাওয়া যায়। কী সেগুলো? চলুন, জেনে নিই।
- কোনো ব্যক্তি যখন হাসতে থাকে, তখন তার মাথায় নেতিবাচক চিন্তা আসার সম্ভাবনা কম থাকে। মস্তিষ্ক একবার কোনো কারণে উৎফুল্ল হয়ে উঠলে, সে চায় লম্বা সময় ধরে যেন সেই উৎফুল্লতায় কোনো ছেদ না ঘটে। তাই সাধারণ অবস্থায় খারাপ লাগার মতো অনেক বিষয়কেও সে পাশ কাটিয়ে যায়, কিংবা বলা ভালো, হেসেই উড়িয়ে দেয়।
- একজন ব্যক্তি যখন হাসিমুখে থাকে, তখন তাকে অনেক বেশি আন্তরিক ও বন্ধুভাবাপন্ন বলে মনে হয়। এতে করে আশেপাশের মানুষদের মনে তার ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়, এবং তারাও তার সাথে আন্তরিক আচরণ করতে থাকে। ধরুন, আপনি এমন একটি পার্টিতে গেছেন, যেখানে কাউকেই চেনেন না। অমন পরিস্থিতিতে যদি মুখ ভার করে থাকেন, কেউ কিন্তু যেচে পড়ে আপনার সাথে কথা বলতে আসবে না। ফলে আপনার অস্বস্তি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে। কিন্তু আপনি যদি মুখটা হাসি হাসি করে রাখেন, কেউ না কেউ ঠিকই আপনার সাথে কথা বলতে শুরু করবে, ফলে আপনি একজন কথা বলা ও সময় কাটানোর সঙ্গী পেয়ে যাবেন।
- যেকোনো জটিল পরিস্থিতিতে একজন হাসিমুখের ব্যক্তির কোনো তুলনা হয় না। ধরা যাক, কোনো একটি সমস্যা নিয়ে হয়তো সকলেই অনেক বেশি চিন্তিত। সবার মুখ গোমড়া, কিংবা ভুরু কোঁচকানো। কেউ নিজে তো কোনো সমাধান করতে পারছেই না, বরং অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে আরো হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। কিন্তু সেই গ্রুপে যদি এমন একজন থাকে, যে অমন জটিল পরিস্থিতিতেও হাসছে বা হাসিমুখ করে রেখেছে, তাহলে তার নিজের পক্ষে যেমন সমস্যার সমাধান বের করা সহজ হয়ে যায়, তেমনই অন্যরাও বুকে বল পায়, নতুন উদ্যমে সমাধান খোঁজায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
- একটি হাসিই পারে সম্ভাব্য বিশাল বড় যুদ্ধকে এক নিমেষে থামিয়ে দিতে। মনে করুন, আপনার আর আপনার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেধেছে। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণে পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে যে, খানিকক্ষণের মধ্যেই হয়তো আপনাদের বিচ্ছেদ ঘটে যেতে পারে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে আপনি দেখতে পেলেন, আপনার ভালোবাসার মানুষটি হাসছে। না, বিদ্রূপের নয়, শতভাগ আন্তরিক হাসি, যে হাসি হৃদয়ে শীতল হাওয়া বইয়ে দিতে পারে। তেমন একটি হাসি দেখার পরও কি আপনি পারবেন ঝগড়া চালিয়ে যেতে? আপনার কি মন চাইবে না আপাতত ঝগড়া বন্ধ করে তার সাথে সন্ধিস্থাপন করতে, এবং পরবর্তীতে দুজনেরই রাগ কমে গেলে, ঠাণ্ডা মাথায় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করতে?
- হাসি মানুষের মস্তিষ্কে যে অসাধারণ প্রশান্তি এনে দেয়, তার কোনো নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও খুঁজে পাওয়া ভার। একদল ব্রিটিশ গবেষকের মতে, একটি হাসি মানুষের মনে সেই পরিমাণ ইতিবাচক উত্তেজনার সৃষ্টি করে, যে উত্তেজনা পেতে অন্যথায় তাকে ২০০০টি চকলেট বার খেতে হতো।
- হাসি মানুষের চেহারায়ও বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে আসে, এবং তা অবশ্যই ইতিবাচক অর্থে। আপনি যদি স্বাভাবিকভাবে থাকেন কিংবা মুখ গোমড়া করে থাকেন, তারচেয়ে যদি আপনি হাসিমুখে থাকেন, তবে আপনাকে অনেক কমবয়স্ক মনে হবে। এ কারণেই হয়তো হাসিকে বিবেচনা করা হয় তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে।
- সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাসি মানুষের গড় আয়ুও বাড়িয়ে দেয়। ২০১০ সালে ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল। গবেষণার নমুনা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল ১৯৫০-পূর্ববর্তী সময়ের কিছু মেজর লিগ বেসবল খেলোয়াড়ের কার্ড। গবেষণা করে দেখা গিয়েছিল, যেসব খেলোয়াড় তাদের ছবিতে হাসেননি, তারা গড়ে ৭২.৯ বছর বেঁচেছেন। আর যারা হেসেছেন, তারা বেঁচেছেন প্রায় ৮০ বছর।
এই লেখাটি পড়ার পর হাসির মাহাত্ম্য সম্পর্কে নিশ্চয়ই আর কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। হাসি এমন একটি জিনিস, যার জন্য আপনার পকেট থেকে টাকা খসাবে না, মূল্যবান সময়ের অপচয় হবে না, এমন খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হবে না। অথচ এর বিনিময়ে আপনি নিজে যেমন অনেক সুফল পাবেন, তেমনই আপনার আশেপাশের মানুষদেরকেও খুশি করতে পারবেন। তাই প্রতিদিন অকারণে হলেও একটু তো হাসাই যায়, তাই না?
তবে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তাছাড়া এই লেখার ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করানোটাও ঠিক হবে না। হাসির মাধ্যমে সাধারণ দুঃখবোধ বা বিষণ্নতা দূর করা যায় বটে, কিন্তু কেউ যেন আবার মনে করবেন না যে এর মাধ্যমে চরম মাত্রার বিষাদ বা ডিপ্রেশনও দূর করা যাবে। তাছাড়া সকল পরিস্থিতিতে হাসাটাও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেউ হয়তো খুব বড় কোনো বিপদে পড়েছে, কিংবা আপনাকে তার দুঃখের বৃত্তান্ত শোনাচ্ছে, এমন অবস্থায় আপনি যদি তার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে কেবল হাসতে থাকেন, সেটি হবে খুবই অসংবেদনশীল একটি কাজ।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/