হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে ইনহেলারের ভূমিকা

সাদেক সাহেব (কল্পিত নাম) কয়েকদিন ধরে অসুস্থ বোধ করছেন। রাতের বেলা মাঝে মাঝেই তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, হেলান দিয়ে বসে থাকলে একটু আরাম পাওয়া যায়। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের কথায় গেলেন চিকিৎসকের কাছে। তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানালেন- সাদেক সাহেবের হাঁপানি বা অ্যাজমা (Bronchial Asthma) হয়েছে।

সাদেক সাহেবের মতো অনেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন; Image Source: myupchar.com

সাদেক সাহেব স্বভাবতই ভয় পেলেন। তবে চিকিৎসক তাকে অভয় দিয়ে বললেন সঠিক চিকিৎসায় হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সাদেক সাহেবও মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করতে পারবেন। তাকে অবিলম্বে ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন।

সাদেক সাহেব কিছুটা আমতা আমতা করতে লাগলেন। তিনি শুনেছেন ইনহেলার ব্যবহার করা খুব কঠিন। একবার নিলে সারাজীবন নিয়ে যাওয়া লাগবে। ট্যাবলেট-ক্যাপসুল জাতীয় ওষুধ কি নেই?

আমাদের চারপাশে সাদের সাহেবের মতো কেউ না কেউ অবশ্যই আছেন, ইনহেলার নিয়ে যাদের ভীতি রয়েছে। এজন্য চিকিৎসক বলার পরেও অনেকে ইনহেলার ব্যবহার করতে চান না। অথচ হাঁপানি বা অ্যাজমার মোক্ষম চিকিৎসাই হলো ইনহেলার।

হাঁপানি

হাঁপানি বা অ্যাজমা শ্বাসতন্ত্রের একটি রোগ। আমাদের ফুসফুসে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে যাওয়া আর সেখান থেকে দূষিত বায়ু নিয়ে আসার জন্য যে রাস্তা, সেটা যদি কোনো কারণে সংকুচিত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে হাঁপানি দেখা দেয়। বাতাস যাওয়া-আসা ব্যহত হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম যা হয় তা হলো শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া। পাশাপাশি হাঁপানির রোগীদের শ্বাস টানার সময় কর্কশ একধরনের আওয়াজ পাওয়া যেতে পারে (Wheeze), কারো কারো কাশি আর বুকে চাপের মতো লক্ষণও দেখা যায়।   

শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে গেলে হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়; Image Source: lungdiseasenews.com

সাধারণত রাতের বেলায় এই সমস্যাগুলো বেশি প্রকাশ পায়। এজন্য অনেক হাঁপানি রোগীর প্রথম উপসর্গই থাকে শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুম ভেঙে যাওয়া, হেলান দিয়ে বসে থাকলে এর কিছুটা উপশম হয়। এই উপসর্গগুলো অবশ্য সবসময় থাকে না, বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখা দেয়। এই সময় রোগীভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

হাঁপানির নানা উপসর্গ; Image Source: bphc.org

বহু মানুষের রোগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বের প্রায় ২৬২ মিলিয়ন লোক হাঁপানিতে আক্রান্ত ছিল। একই বছর এই রোগে ভুগে মারা গেছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। শিশুরাও মুক্ত নয় এর থেকে, তাদের দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হাঁপানি।

হাঁপানি থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়; Image Source: istockphoto.com

বাংলাদেশে কী অবস্থা? ২০০২ সালের জাতীয় পর্যায়ের একটি গবেষণা ৪ মিলিয়ন শিশুসহ ৭ মিলিয়নের মতো হাঁপানি রোগী সনাক্ত করেছিল, অনুমান করা যায় যে এখন এই সংখ্যা আরো বেড়েছে।

চিকিৎসা কেন দরকার

শ্বাস নিতে না পারার কষ্ট যার হয়েছে সেই বোঝে। এর বাইরেও হাঁপানির রোগী সামাজিক আর পেশাগতভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হন। রোগের তীব্রতা বাড়লে মৃত্যুও হতে পারে।

চিকিৎসার অভাবে হাঁপানি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে; Image Source: infectiousdiseaseadvisor.com

হাঁপানি সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলার মতো ব্যবস্থা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো জানে না। তবে বর্তমানে যেসব ওষুধ পাওয়া যায় সেগুলোর সঠিক ব্যবহারে রোগের প্রকোপ কমিয়ে রাখা সম্ভব। হাঁপানির রোগীর অন্যতম অভিযোগই থাকে শ্বাসের সমস্যা নিয়ে। উপযুক্ত ওষুধে রোগীকে দীর্ঘদিন ভালো রাখা সম্ভব হয়, এবং যখন শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তৎক্ষণাৎ ওষুধ প্রয়োগ করলে সেটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। 

ইনহেলার

হাঁপানির বহু চিকিৎসা রয়েছে, তবে সবচেয়ে কার্যকর হলো ইনহেলার। কেন? কারণ হাঁপানির প্রধান কারণ শ্বাসনালীর সংকোচন। ইনহেলারের মাধ্যমে ওষুধ সরাসরি এই শ্বাসনালীতে প্রয়োগ করা হয়, ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের পথ প্রসারিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই রোগী শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি পান।

কিন্তু এই ইনহেলার কী? ইনহেলার নিজে কোনো ওষুধ নয়, বরং এর মধ্যে ওষুধ দেয়া থাকে গ্যাসীয়ভাবে। ইনহেলার চাপ দিয়ে মুখ দিয়ে টেনে নিতে হয় এই গ্যাস। গ্যাসীয় ওষুধ এরপর চলে যায় শ্বাসনালীতে, সেখানে রাস্তা প্রসারিত করে রোগীর কষ্ট উপশম করে।

ইনহেলার; Image Source: gponline.com

সাধারণত দু’ধরনের ইনহেলার বাজারে আছে। একটির মধ্যে যে ওষুধ থাকে তা শ্বাসকষ্টের সময় ব্যবহার করতে হয়, আরেক ধরনটি স্বাভাবিক সময়ে রোগী ব্যবহার করেন যাতে তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা বার বার না হয়। প্রথম ধরনটিকে বলা হয় ‘রিলিভার’ (Reliever) আর দ্বিতীয় ধরনকে ‘প্রিভেন্টার’ (Preventer)। প্রিভেন্টারের মধ্যে সাধারণত স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ থাকে।

হাঁপানি আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ইনহেলার সর্বোত্তম হলেও অনেকেই কিছুটা দ্বিধাবোধ করেন। এর কয়েকটি কারণ থেকে থাকতে পারে। ইনহেলার ব্যবহার করতে হয় কয়েকটি ধাপ মেনে। বাইরের অনেক দেশে রোগীকে ইনহেলারের উপর প্রশিক্ষণ দেয়ার আলাদা নার্স থাকে, যারা হাতে ধরে ব্যবহার বিধি শিখিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। কিছু কিছু হাসপাতাল আর চেম্বারে ব্যবস্থা থাকলেও দেশব্যাপী এর প্রচলন হয়নি। যদি রোগীকে ইনহেলার নেয়া শেখানো না হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিকল্প কিছু খুঁজবেন।  

ইনহেলার কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা রোগীর জানা দরকার; Image Source: nursingtimes.net

ইনহেলারে স্টেরয়েড নিয়েও অনেকের ভীতি থাকে। পত্রপত্রিকা বা মিডিয়াতে স্টেরয়েড সাধারণত নেতিবাচক খবরের অংশ হিসেবেই আসে। ফলে আমাদের মনেও স্টেরয়েড নিয়ে অনেক শঙ্কা কাজ করে। এর বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে বলেই আমরা জানি। সুতরাং হাঁপানিতে লম্বা সময় স্টেরয়েডযুক্ত ইনহেলার ব্যবহার করলে কী হবে সেটা নিয়ে রোগীর ভয় থাকে। এজন্য চিকিৎসক আর রোগীর মধ্যে খোলামেলা আলাপ হওয়া জরুরি, রোগীকে জানাতে হবে কেন ইনহেলারের বিকল্প নেই এবং স্টেরয়েডের ঝুঁকি কমাতে তিনি কী কী সতর্কতা অবলবম্বন করতে পারেন।

আরেকটি বড় কারণ হতে পারে মানসিক। যতই বলা হোক হাঁপানি অনিরাময়যোগ্য, রোগী তবুও মানসিকভাবে চান নিজেকে রোগ থেকে সুস্থ দেখতে। তার মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হওয়া অসম্ভব না যে যখন ইনহেলার ব্যবহার করতে হচ্ছে না তখন তিনি সুস্থ। এই বোধটুকু তার চাওয়া। কিন্তু সবসময় ইনহেলার ব্যবহার করলে তো সেটা সম্ভব নয়, তিনি যে অসুস্থ এটা সবসময়েই মনে পড়তে থাকবে।

এটা মাথায় নিয়েই চিকিৎসকের সাথে কথা বলা উচিত যে ইনহেলার ব্যবহার করতে হতে পারে এবং সম্ভবত তা সবসময়ের জন্যই। ঠিক কখন ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে তা চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন। শ্বাসকষ্টের সময় রিলিভার আর অন্যান্য সময় প্রিভেন্টার কী দিতে হবে সেটা তিনিই বলবেন। রোগীর রোগের গতিপ্রকৃতি বুঝে এই সিদ্ধান্ত দিতে হবে, যা বিভিন্ন রোগীর জন্য ভিন্ন হয়ে থাকে।

উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব; Image Source: medicalnewstoday.com

ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির মতো হাঁপানিও সারাজীবনের অসুখ। ফলে এর চিকিৎসা শুধু রোগী আর চিকিৎসকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদেরও দায়িত্ব আছে। হাঁপানির রোগীকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে পারলে চিকিৎসার সুফল যেভাবে পাওয়া যাবে, তিনি মনের দিক থেকে পর্যুদস্ত হয়ে পড়লে কিন্তু সেটা হবে না। স্মরণ রাখতে হবে- চিকিৎসক নির্দেশনা দেবেন, কিন্তু তা পালনের দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। সেটা পালন করতে হবে রোগীর নিজের এবং তার ঘরের মানুষকে।

This is a Bengali Language article about bronchial asthma. Necessary references are hyperlinked and also mentioned below.

References

  1. WHO (2020). Asthma
  2. Mims, J. W. (2015).Asthma: definitions and pathophysiology.International Forum of Allergy & Rhinology, Vol. 5, No. S1,pp. S2-S6.
  3. McDonald V. M., Hiles S. A., Jones K.A., Clark V. L. & Yorke J. (2018).Health-related quality of life burden in severe asthma . Med J Aust 2018; 209 (2): S28-S33.
  4. Hassan MR, Kabir AR, Mahmud AM, Rahman F, Hossain MA, Bennoor KS, Amin MR, Rahman MM. Self-reported asthma symptoms in children and adults of Bangladesh: findings of the National Asthma Prevalence Study. Int J Epidemiol. 2002 Apr;31(2):483-8.
  5. NHS (2021) Asthma Treatment
  6. Asthma & Allergy Foundation of America (2021): Asthma Medicines and Treatment

Feature Image: janprahar.com

Related Articles

Exit mobile version