২০০৮ সালের ঘটনা এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক নারীকে ভর্তি করা হলো নিকটস্থ হাসপাতালে। যিনি ভর্তি হলেন, তিনি একজন ফিলিপাইনি গৃহিনী, বয়স তেপ্পান্ন ছাড়িয়েছে। রোগীর স্বজনেরা জানালেন, রোগী নানা অসংলগ্ন অাচরণ করে তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপারটি হলো, রোগী বারবার নিজেকে মৃত দাবি করে মর্গে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন এবং বারবার ৯১১ এ ফোন করবার জন্য চেঁচামেচি করছেন।
যখন হাসপাতালে রোগীর সাক্ষাৎকার নেয়া হলো, তখন তিনি অাতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, তার নিজের কাছে নিজেকে মৃত বলে মনে হচ্ছে। তাই তিনি চাইছেন, তাড়াতাড়ি সমাধিস্থ হতে, যাতে এই জ্যান্ত লাশ হয়ে ঘুরে ফিরবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
রোগী অারো জানালেন, ফিলিপাইনে থাকার সময় থেকেই তিনি তীব্র বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন, যার জন্যে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টও সেবন করছেন। তবে সেগুলো কোন ব্র্যান্ডের এবং সেগুলোর ডোজই বা কতটুকু, তা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলেন না।
চিকিৎসকেরা অারো একটি ব্যাপার লক্ষ করলেন- রোগী দীর্ঘদিন ধরে ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া না করার কারণে শীর্ণকায় হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন একই পোশাক পরে থাকবার ফলে সেটি জীর্ণদশা ধারণ করেছে। রোগীর ভাষ্যমতে, “মৃত মানুষের খাবার কিংবা পোশাকের প্রয়োজন হয় না”।
রোগীর এই অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং অাচরণ চিকিৎসকদের একটি দিকেই ইঙ্গিত করলো। রোগী এক অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনে ভুগছেন। এই অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনের নাম কটার্ড সিনড্রোম।
কটার্ড সিনড্রোম কী?
কটার্ড সিনড্রোম এমন একটি অসুস্থতা বা মেডিক্যাল কন্ডিশন, যাতে অাক্রান্ত হলে রোগী মনে করতে শুরু করেন, তিনি অাসলে মারা গেছেন। মাঝে মাঝে রোগী এও ভাবতে শুরু করেন যে তার শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অস্তিত্ব তিনি অনুভব করতে পারছেন না। অনেকসময় তিনি নিজেকে অমর হিসেবেও দাবি করতে পারেন। এই ব্যাধির অাবিষ্কার ১৮৮০ সালে, প্রখ্যাত ফরাসি নিউরোলজিস্ট জুলস কটার্ডের হাত ধরে। একে কটার্ড ডিল্যুশনও বলা হয়ে থাকে।
অনেকসময় রোগীর চালচলনে নিজেকে মৃত জাহির করার প্রবণতাটা এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে, রোগীকে দেখে অাপাতদৃষ্টিতে জ্যান্ত লাশ বলে মনে হয়। তাই এ রোগকে অনেকে ‘দ্য ওয়াকিং কর্পস সিনড্রোম’ বলেও অভিহিত করে থাকেন।
ইতিহাস
কটার্ড যেভাবে এই অদ্ভুতুড়ে রোগটির সন্ধান পেলেন, সে কাহিনীটিও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। জানা যায়, তেতাল্লিশ বছর বয়স্কা একজন সম্ভ্রান্ত নারী তার নিয়মিত রোগী ছিলেন, যিনি প্রায়ই কটার্ডের কাছে বিভিন্ন অাজব অাজব উপসর্গ নিয়ে হাজির হতেন। এই রহস্যময় রোগীর নাম ছিলো মাদামোয়াজেল এক্স।
কখনো কখনো মাদামোয়াজেল বলতেন, তার এমনটা মনে হচ্ছে যে তার কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অাবার কখনো কখনো জানাতেন, তিনি তার ইন্দ্রিয়গুলোকে অনুভব করতে পারছেন না।
মাদামোয়াজেলের মনে হতো, তার পেটের মধ্যে কোনো নাড়িভুড়ি নেই, তাই ক্ষুধা লাগলে খাবার খেতে হবে, এই প্রয়োজন তিনি অনুভব করতেন না। এই লাগামহীন জীবন-যাপনের কারণে কটার্ডের এই রহস্যময় রোগী একসময় মারা যান।
কটার্ড এই অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনকে অভিহিত করেন, ‘delire des negations’ নামে। তবে রোগটিকে কটার্ড সিনড্রোম নামে সর্বপ্রথম অভিহিত করেন সেগলাস, ১৮৮৭ সালের দিকে। এর কিছু বছর পরে রেজিস রোগটিকে ‘delire de cotard’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং দেখান যে, রোগটির সাথে বিষণ্নতা ছাড়াও অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের সম্পর্ক রয়েছে।
শ্রেণিবিন্যাস
সর্বপ্রথম ল্যুডেট এবং মার্টিনেজ অদ্ভুতুড়ে এ ব্যাধিটির শ্রেণিবিন্যাসের দিকে মনোযোগ দেন। এরপর ১৯৬৮ সালে সাভেদ্রা ডিপ্রেসিভ, মিক্সড এবং সিজোফ্রেনিক; এই তিনটি প্রকরণের কথা উল্লেখ করেন।
তবে ১৯৯৫ সালে ব্যেরিয়স এবং ল্যুক একে তিনটি প্রকরণে বিভক্ত করেন, যা কেস স্টাডি এবং প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যাধির প্রথম শ্রেণিবিন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। এগুলো হলো,
- উদ্বেগ, অপরাধবোধ এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশনের মতো উপসর্গবিশিষ্ট সাইকোটিক ডিপ্রেশন
- হাইপোন্ড্রিয়াক এবং নিহিলিস্টিক ডিলিউশনের মতো উপসর্গবিশিষ্ট কটার্ড সিনড্রোম টাইপ 1.
- বিষণ্নতা, অমরত্বের বিভ্রান্তি এবং অাত্মঘাতী প্রবণতার মতো উপসর্গবিশিষ্ট কটার্ড সিনড্রোম টাইপ 2.
কটার্ড সিনড্রোমের বিভিন্ন পর্যায়
কটার্ড সিনড্রোমের উপসর্গগুলো খুবই বৈচিত্র্যময় এবং তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। ১৯৯৯ সালের এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় গবেষক ইয়ামাডা কস্তুরাগি ও তার সহকর্মীরা এই রোগটির তিনটি দশা বা পর্যায় বের করতে সক্ষম হন, যা সে বছরের Acta Psychiatrica Scandinavica জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এগুলো হলো:
- সংক্রমণ পর্যায়: এই পর্যায়ের অপর নাম Germination Stage. এ দশায় রোগী মনমেজাজের ঘনঘন তারতম্য ঘটতে দেখা যায়। বিষণ্নতা, রোগে অাক্রান্ত হয়ে যাওয়ার ভয় কিংবা যথাযথ চিকিৎসার পরেও রোগ থেকে মুক্তি না পাবার অাশঙ্কা রোগীর মনকে ঘিরে ধরে।
- পরিস্ফুটন পর্যায়: এটি Blooming Stage নামেও পরিচিত। কারণ এই পর্যায়ে রোগী রোগের প্রধান উপসর্গগুলো অনুভব করতে শুরু করেন। যেমন জীবিত থেকেও নিজেকে মৃত মনে করা কিংবা নিজেকে একেবারেই অমর হিসেবে কল্পনা করা। এর সাথে সাথে উদ্বেগ এবং ভীতিও দেখতে পাওয়া যায়।
- ক্রনিক পর্যায়: এই পর্যায়ে রোগী তীব্র বিষণ্নতায় অাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার অাবেগ-অনূভূতিতে অসামন্জস্য দেখা দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি প্যারানয়ায় ভুগতে পারেন।
উপসর্গ
কটার্ড সিনড্রোমের প্রথম এবং প্রধান উপসর্গ হলো নিহিলিস্টিক মনোভাব। এই মনোভাবের মূল কথা হলো, জীবনের কোনো মানে নেই, কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই। যারা কটার্ড সিনড্রোমে ভোগেন, তারা মনে করেন এই পুরো পৃথিবীটাই একটা ভ্রম বা কল্পনা, এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
কটার্ড সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই অাক্রান্ত হন অাকণ্ঠ বিষণ্নতায়। ২০১১ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কর্টাড সিনড্রোমে অাক্রান্ত রোগীদের ৮৯ শতাংশই বিষণ্নতাকে তাদের অন্যতম উপসর্গ বলে স্বীকার করেন। প্রাপ্ত একশোটির মতো কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত এ ফলাফলে অন্যান্য প্রধান উপসর্গগুলো হলো, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব (৬৯ শতাংশ), উদ্বেগ (৬৫ শতাংশ), অপরাধবোধজনিত বিভ্রান্তি (৬৩ শতাংশ), নিজেকে অমর মনে করা (৫৫ শতাংশ) এবং হাইপোকন্ড্রিয়াক ডিলিউশন (৫৮ শতাংশ)।
বিষণ্নতার কারণে এই সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক ‘কোথাও কেউ নেই’ ধরনের মনোভাব। যার কারণে তারা নিজেদের জীবন এবং অস্তিত্বকে তুচ্ছ এবং অর্থহীন মনে করতে শুরু করেন।
নিজেকে তুচ্ছ ও অস্তিত্বহীন ভাববার প্রবণতা প্রভাব ফেলে তাদের জীবনযাপনেও। অনেকেই হারিয়ে ফেলেন জীবনের লক্ষ্য। উদ্দেশ্যহীন ও ভবঘুরে জীবনযাপনই তাদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাড়ায়।
এ রোগের রোগীরা গোসল না করেই কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। অনেকে নখ-চুল কাটা বন্ধ করে দেন। কারণ তাদের কাছে নিজ নিজ দেহ তো ‘মৃত’! অনেকে তো অারো এক কাঠি সরেস! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার পর শৌচকর্মটি পালন করতে অনীহা দেখা যায় তাদের মধ্যে।
অনেক রোগীর কাছে মনে হয়, তারা তাদের হাত-পা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছেন না। যদিও সাধারণ মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেগুলো বিকল বা অবশ হয়ে যাবার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।
রোগ নির্ণয়
এই অদ্ভুতুড়ে রোগটি শনাক্ত করাটাও বেশ জটিল একটি ব্যাপার। কেননা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান একে রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। সে কারণেই এটি নির্ণয় করার নেই কোনো সুনির্দিষ্ট উপায়।
কোনো ব্যক্তি ওয়াকিং কর্পস সিনড্রোমে ভুগছেন কিনা, তা নির্ণয় করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো রোগীর ইতিহাস এবং উপসর্গ পর্যালোচনা। এছাড়াও বেশ কিছু পরীক্ষা রয়েছে, যা দ্বারা রোগটির উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়,
- সিটি স্ক্যান (কম্পিউটেড টমোগ্রাফি স্ক্যান)
- এমঅারঅাই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং)
- স্পেকট (সিঙ্গেল ফোটন ইমিশন কম্পিউটেড টমোগ্রাফি)
- ইলেক্ট্রোসেফালোগ্রাম
জটিলতা
কেউ যদি হঠাৎ করেই নিজেকে মৃত মনে করতে শুরু করে দেন, তাহলে ব্যাপারটি তার অাপনজনদের কাছে খুব একটা সুখকর হবে না। কেননা নিজেকে মৃত মনে করবার এই মানসিকতা রোগীকে অাক্ষরিক অর্থেই জম্বিতে পরিণত করে, সেটি অাশেপাশের মানুষদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়ায়।
কটার্ড সিনড্রোমের রোগীরা গোসল কিংবা কাপড়-চোপড় পরিধান করা বন্ধ করে দেন, এর ফলে তাদের চর্মরোগ দেখা দেয়, পরিচিতরা তাদের থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। এটি রোগীর একাকিত্ব এবং বিষণ্নতাকে অারো বাড়িয়ে তোলে।
পাশপাশি খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করায় তাদের স্বাস্থ্য দুর্বল হতে শুরু করে। অনেক রোগী তো খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়ার কারণে অকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।
যারা কটার্ড সিনড্রোমের রোগী, তাদের মধ্যে ঘন ঘন অাত্মঘাতী হয়ে উঠবার প্রবণতা দেখা দেয়। এর কারণ হলো তারা মনে করেন, তারা অাসলে মারা গেছেন এবং তাদের অাত্মা ভুল মানুষের শরীরে বন্দী হয়ে অাছে। তাই দেহ নামের এই কল্পিত কারাগার থেকে মুক্তি পেতে অনেকে অাত্মহত্যাকে বেছে নেন।
চিকিৎসা
ওষুধ
বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিক, মুড স্ট্যাবিলাইজার ওয়াকিং কর্পস সিনড্রোম নিরাময়ে কাজে দেয়। উপসর্গগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে এ রোগের উপশম হতে পারে। যাদের বাইপোলার ডিসঅর্ডার অাছে, তাদের ক্ষেত্রে মুড স্ট্যাবিলাইজার কাজে দিতে পারে।
ইলেক্ট্রো-কনভালসিভ থেরাপি
অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট এবং অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগস ব্যবহারের পাশাপাশি ইলেক্ট্রো-কনভালসিভ ট্রিটমেন্ট কটার্ড সিনড্রোমের লক্ষণগুলো প্রশমনে ভূমিকা রাখে। ২০০৯ সালের এক কেস স্টাডি গবেষণায় দেখা যায়, এই রোগে অাক্রান্তদের মধ্যে ওষুধের চেয়ে ইলেক্ট্রো-কনভালসিভ থেরাপি প্রয়োগ বেশি কার্যকর।
এই থেরাপিতে রোগীর মাথায় ইলেক্ট্রোড সংযুক্ত করে সেটির মাধ্যমে খুব ক্ষীণ মাত্রায় তড়িৎচালনা করা হয়। ইলেক্ট্রোডের মাধ্যমে এই মৃদু বৈদ্যুতিক শক প্রদান রোগীর মস্তিষ্কের বার্তা অাদান-প্রদান প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে এবং নিষ্ক্রিয় অঞ্চলগুলোকে সক্রিয় করে তোলে।
চিকিৎসা প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা রোগের উপসর্গের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। যথাযথ চিকিৎসায় কিছু রোগী অারোগ্য লাভ করবার সম্ভাবনাই বেশি। তবে কেউ কেউ না খেতে খেতে মারাও যেতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে অাত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সেক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই কড়া পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।