পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় উঁচু-নিচু রুক্ষ পাহাড়, মেঘাচ্ছন্ন গাছ, মাটির নিচে ফসিল থেকে শুরু করে বহুমূল্যবান রত্নে সমৃদ্ধ এক গহীন পাহাড়ী বনাঞ্চল মাহেঞ্জ। সেখানে শত শত বছর ধরে বাস করে আসছেন ওয়াপোগোরো আদিবাসীর জনগোষ্ঠী। হাজার বছর ধরে তাদের এই জীবনযাপন বাকি পৃথিবীর পুরোপুরি অগোচরে ছিল। ১৯৫৯ সালে সেই বিচ্ছিন্ন জনপদে লুইস জিলেক আল নামে নরওয়ের এক চিকিৎকের পদার্পণের পরই বহির্বিশ্ব ওয়াপোগোরোদের সম্পর্কে জানতে পারে।
লুইস জিলেক তখন মাত্র ২৮ বছরের এক তরুণী। সদ্য মেডিকেল কলেজ পার হওয়া জিলেক সিদ্ধান্ত নেন তিনি মাহেঞ্জ পাহাড়ে একটি ক্লিনিক স্থাপন করবেন। এরপর তিনি সেখানে রোগী দেখা শুরু করতেই একটি অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলেন। প্রায় প্রতিদিনই দুই বছর বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের লোকজন শরীরে মারাত্মক পোড়া নিয়ে তার কাছে আসতে শুরু করেন। এদের মধ্যে অনেকের শরীরে কয়েক বছর ধরে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া হওয়ার কারণে শরীরে গোলাপি রঙের ক্ষত তৈরি হয়েছে। শরীরে এই ক্ষত নিয়েই অনেকে অল্প বয়সে মৃত্যুবরণও করেছেন। একবার এমনই এক মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েশিশু এসেছিলো জিলেকের কাছে, যার রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। ফলে মৃত্যু ঘটে মেয়েটিরও!
এরপর লুইস জিলেক যখন এর রহস্য উদঘাটনে বের হলেন, তখন তিনি লোকজনের মধ্যে ভয় ও এড়িয়ে চলা লক্ষ করলেন। এমনকি যেসব শিশু আক্রান্ত হয়েছে তাদের নিকটাত্মীয়রাও কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করলেন। একসময় লুইস জিলেক বুঝতে পারলেন, তার কাছে আসা রোগীরা সম্ভবত খিঁচুনি বা মৃগী রোগে আক্রান্ত। তারা এই রোগকে সোয়াহিলি ভাষায় বলেন ‘কিফাফা’, যার অর্থ ছোট মৃত্যু। এই রোগে আক্রান্তরা অনেকে বিভিন্ন স্থানে পড়ে গিয়ে মারা যান। কখনো তাদের চুলার পাড়ে, আবার কখনো নদীতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিফাফায় আক্রান্ত রোগীরা ‘রিভার ব্লাইন্ড’ হয়ে যান। যার কারণে অনেকে নদী বা পুকুরে পড়ে থাকতেন।
তবে রহস্যের এখানেই শেষ নয়। কিফাফায় আক্রান্ত শিশুরা খর্বাকৃতির, বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা এবং অদ্ভুত আচরণ নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। তাদের মধ্যে আরো একটি সমস্যা হলো মাথা নাড়ানো বা ঝিমুনি। দিনে অনেকবার তারা চোখ বন্ধ করে বুকের ওপর মাথা নিয়ে বারবার ঠুকতে থাকেন। এই রোগে কয়েক বছর ভোগার পর অল্প বয়সেই অনেকে মারা যান। লুইস জিলেক আল সেই সময় পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে মাথা নাড়ানোর রোগ সম্পর্কে জানতে পারেন। তবে সেই রোগও কিফাফা কি না, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
এখন পর্যন্ত রোগ সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
এখন পর্যন্ত পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে মানুষের মাথা নাড়ানো সমস্যার কোনো রহস্য খুঁজে বের করতে পারেননি। পূর্বে এই রোগকে বিরল এবং একধরনের বিভ্রান্তিকর মৃগীরোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সর্বশেষ গবেষণা থেকে মনে করা হচ্ছে কিফাফা সম্ভবত কোনো নিউরো ডিজনেরেটিভ রোগ। যা একইসাথে পারকিনসন ও আলঝেইমার রোগের সমন্বয়। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানসিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
মাহেঞ্জে এই রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন কল্পনাপ্রসূত মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। সেখানকার যারা কিফাফায় আক্রান্ত হয়েছেন, তারা নিজেরাই এর পূর্বলক্ষণ পেয়েছেন। অনেকের মতে, এই রোগের আগে কিছু কিছু ব্যক্তি চোখ বন্ধ করে নিজেদের শরীর পরিষ্কার করেন। এবং পানির মধ্যে কাঁধ পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখেন। এরপর তারা চোখ খুলে দেখেন, পানি রক্তের মতো টকটকে লাল হয়ে গেছে। তবে এই মতবাদ বা প্রচলিত গল্পের সাথে অনেক চিকিৎসকই একমত নন।
তবে কিফাফার গবেষণা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি কোনো জিনগত রোগ নয়। ওরেগন ইনস্টিটিউট অব অকুপেশনাল হেলথ সায়েন্সের নিউরোলজিস্ট পিটার স্পেনসার কিফাফা সম্পর্কে বলেন,
এই রোগটি যদিও পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু এটি এমন এক রোগ, যা কখনো আসে, আবার চলে যায়। ১৯৯৭ সালে উত্তর উগান্ডায় এই রোগটি দেখা যায়। ২০০০ সাল পর্যন্ত থাকার পর আর দেখা যায়নি। ফলে আপনি এই রোগকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জেনেটিক ডিজঅর্ডার বলতে পারবেন না। কারণ তেমন লক্ষণ এর মধ্যে নেই।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কিফাফায় আক্রান্ত রোগীদের মাথা নাড়ানোর কারণ সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে গুয়াম দ্বীপের এক রহস্যময় রোগের সাথে মিল দেখতে পান। যদিও গুয়াম দ্বীপ আফ্রিকা মহাদেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে। তবে সেখানেও এক আধিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস, যারা চামোরো নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অনেকেই ১৯০৪ সাল থেকে এক রহসম্যয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে শুরু করেন। চিকিৎসকরা এর নাম দেন ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্কোরোসিস পারকিনসিনোজম ডিমেনশিয়া কমপ্লেক্স (এএলএস-পিডিসি)। স্থানীয়ভাবে এটি লাইটিকো-বডিগ নামে পরিচিত। গুয়াম দ্বীপে একাধিক মানুষ পেশী ক্ষয়ের কারণে মৃত্যুবরণ করার পর সেখানকার চিকিৎসকরা একে রহস্যময় রোগ হিসেবে অভিহিত করেন। পঞ্চাশের দশকে রোগটি পুরো গুয়াম দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে মৃত্যুর বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গুয়ামের সেই রহস্যময় রোগের দুটি প্রকার ছিল। একটি হলো ল্যাটিক, যা এএলএস নামক নিউরো ডিজনেরেটিভ রোগের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই রোগে পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কয়েক দশক ভুগেছেন। আরেক প্রকার হলো বডিগ, যার কিফাফায় আক্রান্ত রোগীদের মাথা নাড়ানোর সাথে মিল রয়েছে। এই রোগ মূলত ডিমেনশিয়া ও পারকিনসনের সম্মিলিত আক্রমণ। তবে গুয়াম দ্বীপ এবং মাহেঞ্জ পাহাড়ের অধিবাসী জনগোষ্ঠীর রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখনো সফল হতে পারেননি।
কিফাফা রহস্যের কোনো কিনারা পাচ্ছেন না গবেষকরা
কিফাফা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবচেয়ে অস্বাভাবিক দিকটি হলো মাথা নাড়ানো। চিকিৎসকরা এর কারণ নির্ণয়ের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তারা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তারা যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে বের করতে সক্ষম হননি। কয়েক বছর আগে ইসরায়েল ও জার্মানিতে হাম হওয়ার পর মাথা নাড়ানোর সমস্যা ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা হামের সাথে কিফাফার সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাননি।
অল্প বয়সে হাম হলে সাবঅ্যাকুইট স্কোরোসিং প্যানেনসেপালাইটিস (এসএসপিই) নামক এক বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রোগেও মাথা নাড়ানোর সমস্যা হয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা হয়ে থাকে। এই রোগের সাথে কিফাফার সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন। কিফাফায় আক্রান্ত উগান্ডার লোকজনদের নিয়েও বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল উগান্ডার গৃহযুদ্ধ। আশির দশক থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এখানে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। যেখানে কলেরা, হাম ও রুবেলার মতো রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক গবেষক মনে করেন, এই রোগগুলো থেকেই কিফাফার উৎপত্তি ঘটতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
এক গবেষণায় কিফাফায় আক্রান্ত অনেক রোগীর শরীরে এপস্টাইন বার নামক একধরনের ভাইরাস খুঁজে পান চিকিৎসকরা। এই ভাইরাস মস্তিষ্কে প্রবেশ করে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এই তথ্য থেকে একদল চিকিৎসা বিজ্ঞানী ধারণা করেন, এপস্টাইন বার ভাইরাসের কারণে কিফাফা আক্রান্ত রোগীদের মাথা নাড়ানো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু মাইকেল পোলানেন নামক একজন গবেষক কিফাফা রোগে মারা যাওয়া উগান্ডার এক শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, তার মস্তিষ্কে এপস্টাইন ভাইরাসের কোনো উপস্থিতি নেই। ফলে এই রোগের জন্য এপস্টাইন ভাইরাসকে দায়ী করা যায় না।
গুয়াম দ্বীপের চামোরো আধিবাসীদের মাথা নাড়ানো রোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাদের খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে নজর দেওয়া হয়। তারা সাধারণত সাইক্যাড নামক একধরনের ফার্ন উদ্ভিদের বীজ খেয়ে থাকেন। এই উদ্ভিদ ডাইনোসর যুগের সময়কালের। এর মধ্যে বিএমএএ নামক এক ধরনের টক্সিন থাকে, যার ফলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে গবেষণায় উঠে আসে।
আফ্রিকার যে অঞ্চলগুলোতে কিফাফার দেখা মিলেছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তারা পুষ্টিকর কোনো খাবারই পান না। উগান্ডায় গৃহযুদ্ধের সময় গৃহহীন মানুষজন অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার পর খাদ্যসংকটে ভুগেছেন। সেই সময় তারা যেন তেন খাবার খেয়েছেন। বিশেষ করে মোল্ড মেইজ ও কীটনাশক দেওয়া বীজ। পরবর্তীকালে এদের মধ্যে অনেকেই কিফাফা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এরপরও চিকিৎসকরা এই খাবারগুলোকে কিফাফার কারণ হিসেবে নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে মাথা নাড়ানোর এই সমস্যা পূর্ব আফ্রিকাকে মানবিক সংকটে ফেলেছে। এর কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার না হলে ভবিষ্যতে আরো অনেকের জীবনহানি ঘটবে।