গর্ভকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা তথা সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত দরকারি। কেননা, এসব খাদ্য উপাদান ভ্রূণের বিকাশ সাধনে ও পরবর্তীতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। অর্থাৎ মায়ের খাদ্যাভ্যাসেরই উপর নির্ভর করে শিশুর বিকাশ। সঠিক খাদ্য উপাদানের অভাবে সন্তান বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হতে পারে, যার একটি হলো এডিএইচডি।
এডিএইচডি হলো অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅকর্ডার। এটা একধরনের নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার। নাম থেকেই রোগটি সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা নেওয়া যায়। ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট’ হলো মনোযোগের অভাব এবং ‘হাইপারঅ্যাক্টিভিটি’ হলো অতিচাঞ্চল্য। এডিএইচডিতে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক শিশুদের মতো স্থির থাকতে পারে না এবং কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২.৫ ভাগ এই রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বেশিরভাগই হলো শিশু ও কিশোর-কিশোরী। সাধারণত সাত বছর বয়সে বা এর পরে শিশুদের মধ্যে এডিএইচডি আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়। বিশেষ করে কোনো শিশু স্কুলে যাওয়া শুরু করলে এই ব্যাপারটি বোঝা যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিএইচডি হঠাৎ করেই শিশুদের মধ্যে দেখা যায় না। মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের অভাব এবং কিছু উপাদানের অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্তই এই রোগের ক্ষেত্রে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
ওমেগা-৬ এবং ওমেগা- ৩
ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ এমন দুটি উপাদান যা একজন গর্ভবতী নারীর দরকার বটে। তবে এগুলোর আধিক্য ক্ষতিসাধন করে। ওমেগা-৬ এবং ওমেগা- ৩ হলো দীর্ঘ শৃঙ্খলিত পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড। এগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং কার্যকারিতায় সহায়তা করে থাকে। বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে গর্ভে থাকা ভ্রূণের সুস্থ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠনে এসব ফ্যাটি অ্যাসিড কাজ করে। ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ বিপরীত কাজ করে থাকে। ওমেগা-৬ দেহে উত্তেজক হিসেবে কাজ করলেও ওমেগা-৩ ঠিক এর বিপরীতে কাজ করে। ফলে এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো থেকে সুবিধা পেতে হলে এই দুটি অ্যাসিডের পরিমাণের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। আমাদের দেহে সরাসরি এসব ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম থাকে না। বিভিন্ন খাদ্য, যেমন- ডিম, কাজুবাদাম, আখরোট, সয়াবিন, স্যামন থেকে সাধারণত এসব অ্যাসিড তৈরির এনজাইম পাওয়া যায়।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, দেহে এসব অ্যাসিডের উপস্থিতি থাকা দরকার হলেও এই দুটি অ্যাসিডের অনুপাত বেড়ে গেলে একটি শিশুর এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে এর কারণ কোথাও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি। পরবর্তীতে আইএনএমএ প্রজেক্টে এই বিষয়টি নিয়ে আরো খতিয়ে দেখা হয়। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এডিএইচডি কোন ধরনের খাদ্য উপাদানের অভাবে হয় বা এর জন্য আর কোন কোন কারণ দায়ী তা খুঁজে বের করা। এই প্রজেক্টটি পরিচালিত হয় কয়েকটি স্প্যানিশ গ্রুপের মাধ্যমে। তারা চারটি স্প্যানিশ অঞ্চল, যেমন- কাতালোনিয়া, ভ্যালেনসিয়া, অস্চুরিয়াস ও বাস্ক কান্ট্রির ৬০০ শিশুকে নিয়ে প্রজেক্টটি পরিচালনা করে।
শিশুদের অ্যাম্বিলিক্যাল কর্ডের প্লাজমার নমুনা এবং শিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশ্ন করার মাধ্যমে প্রজেক্টটি সম্পন্ন হয়। আইএনএমএ প্রজেক্টে মূলত দু’সেট প্রশ্ন ছিল। একটি সেট পূরণ করে চার বছরের শিশুদের শিক্ষকেরা এবং আরেকটি সেট পূরণ করে সাত বছরের শিশুদের অভিভাবকেরা। গর্ভকালীন সময়ে একজন নারী কীরকম পরিবেশে ছিলেন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে নাকি সেটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এই প্রজেক্টের সাথে সংযুক্ত পর্যবেক্ষকেরা। আর শিশুদের মায়েদের বিশেষভাবে কিছু প্রশ্ন করা হয়।
রিপোর্ট অনুযায়ী, সাত বছর বয়সে এডিএইচডির লক্ষণসমূহ শতকরা ১৩ ভাগ বেড়ে যায় যদি ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ এর অনুপাত শতকরা ১ ভাগ বাড়ে। গবেষকদের মতে, চার বছর বয়সে এডিএইচডি শনাক্ত করা ভুল হবে। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুরও মানসিক উন্নতি ঘটতে একটু বেশি সময় লাগে। তবে এই অবস্থাকে এডিএইচডির অন্তর্ভুক্ত করলে চলবে না। তাই বিশেষজ্ঞরা চার বছরে এই পরীক্ষা না করে সাত বছর বয়সে এডিএইচডি পরীক্ষা করা ঠিক মনে করছেন।
এই প্রজেক্টের পর গবেষকেরা আরেকটি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে নজর দেওয়ার কথা বলেন। আর তা হলো, গর্ভকালীন সময়ে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। নিয়ম অনুসারে খাদ্য গ্রহণ করলে শুধু এডিএইচডিই নয়, বরং অন্যান্য রোগও প্রতিরোধ করা সম্ভব। এডিএইচডি প্রতিরোধে গর্ভকালীন সময়ে যেসকল খাদ্য উপাদান দরকার সেগুলোর কয়েকটি সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো:
প্রোটিন
যেসকল খাদ্য আমিষ জাতীয় উপাদানে সমৃদ্ধ (যেমন- ডিম, মুরগি ও হাঁসের মাংস, গরুর মাংস, শিম, বাদাম ইত্যাদি) সেগুলো এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। আমিষ জাতীয় খাদ্য দেহে নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করতে সহায়তা করে। নিউরোট্রান্সমিটার হলো একপ্রকার রাসায়নিক যা মস্তিষ্কের কোষগুলো পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নিঃসরণ করে থাকে। রক্তে শর্করা বেড়ে গেলে একজন ব্যক্তি অস্থির অনুভব করতে শুরু করে। এই শর্করাকে আমিষ জাতীয় খাদ্য প্রশমিত করে দেহের অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
জিংক, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম
জিংক নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে। ডোপামিনের প্রতি মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দিয়ে আরো বেশি মিথাইলফেনিডেট তৈরি করে। এই খনিজ পদার্থের অভাব থাকলে একজন ব্যক্তি কোনো কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারে না। ডোপামিন তৈরির ক্ষেত্রে লোহা জাতীয় খনিজ পদার্থও অবদান রাখে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, এডিএইচডি-তে আক্রান্ত শতকরা ৮৪ ভাগ শিশুর মধ্যেই আয়রনের অভাব রয়েছে। দেহে আয়রনের অভাব কগনিটিভ ডেফিসিট এবং এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ও পরিচিত আরেকটি খনিজ পদার্থের নাম হলো ম্যাগনেসিয়াম। এই ম্যাগনেসিয়াম জিংকের মতো নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করে। এসব নিউরোট্রান্সমিটার কোনো কাজে মনোযোগ দিতে কিংবা মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে সহায়তা করে থাকে।
জিংক, আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খনিজ পদার্থ সাধারণত হাঁস ও মুরগির মাংস, সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, খাদ্যশস্যতে পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে এই তিনটি খনিজের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তবে লোহা জাতীয় খনিজের সাথে একটি মাল্টিভিটামিন বা মাল্টিমিনারেল গ্রহণ করলে একটি শিশু এসব খনিজের প্রয়োজনীয় ডিআরভি (ডেইলি রেফারেন্স ভ্যালু) পায়।
উল্লেখ্য, মাল্টিভিটামিন বা মাল্টিমিনারেল হলো এমন একটি পিল বা বড়ি যেখানে প্রয়োজনীয় সকল ভিটামিন বা মিনারেল সঠিক পরিমাণ অনুযায়ী থাকে। কেউ সাধারণ নিয়মেই ঠিকমতো ভিটামিন বা মিনারেল না পেলে আলাদা করে এই মাল্টিভিটামিন বা মাল্টিমিনারেলের দরকার হয়। একজন গর্ভবতী নারী মাল্টিভিটামিন বা মাল্টিমিনারেল গ্রহণ করলে তা সেই নারীর পাশাপাশি তার সন্তানেরও ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি পূরণ করবে। তবে এই অভাব পূরণ করতে না পারলে পরবর্তীতে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে খাদ্যের প্রতি অনীহা দেখা দিতে পারে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রতিহত করতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুদেরকে তাদের দেহের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে মাল্টিভিটামিন বা মাল্টিমিনারেল দিতে হবে।
ভিটামিন-বি
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য ভিটামিন-বি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি জরিপ মতে, এমন কোনো শিশু যার ভিটামিন-বি এর ঘাটতি রয়েছে তাকে পরিমাণ মতো ভিটামিন-বি খাওয়ানো হলে তার আইকিউ নম্বর আগে থেকে বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধি সাধারণত ১৬ নম্বরের হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শিশুটির মানসিক উন্নতি ঘটেছে। তাছাড়া রাগ এবং অসামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় যদি দেহে পর্যাপ্ত ভিটামিন-বি থাকে। ভিটামিন বি-৬ মস্তিষ্কের ডোপামিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেয়।
সবশেষে বলা যায় যে, এডিএইচডির মতো রোগ থেকে শিশুদের বাঁচাতে হলে অবশ্যই গর্ভবতী নারীদের সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ঠিকমতো খাদ্য উপাদান পাচ্ছে নাকি তা দেখাশোনার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণমুক্ত ও উপযুক্ত পরিবেশে আছে নাকি তা-ও লক্ষ্য রাখতে হবে।