আকারে ছোট, কিন্তু অনেক পুষ্টি গুণাগুণ সম্পন্ন একটি ফল হলো টমেটো। রসালো, সুস্বাদু এবং দেখতে সুন্দর এই ফল টমেটো পাকা অবস্থায় টকটকে লাল এবং কাঁচা অবস্থায় এর রঙ সবুজ হয়ে থাকে। তবে হলুদ এবং কমলা টমেটোও দেখা যায়। বাংলাদেশে শীতকালে মূলত বেশি পাওয়া গেলেও এখন গরমকালেও চড়া দামে বাজারে পাওয়া যায় এই ফল। সালাদে, তরকারীতে, পাস্তা-নুডলসে, এমনকি কাঁচা খেতেও এই ফলের স্বাদের জুড়ি নেই। আজ আমরা আলোচনা করবো টমেটোর পুষ্টি গুণাগুণ নিয়ে।
টমেটোতে কী আছে?
আসলে হিসাব করা উচিৎ টমেটোতে কী নেই! এতে প্রধানত শর্করা, কিছু আঁশ এবং ক্যালসিয়াম রয়েছে। এছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং ই, ভিটামিন বি এবং কিছু পরিমাণে ভিটামিন কে রয়েছে।
এক কাপ টমেটো কুচিতে যা যা রয়েছে
- ১৭০.১৪ গ্রাম পানি
- ১.৫৮ গ্রাম প্রোটিন
- ২.২ গ্রাম আঁশ
- ৫.৮ গ্রাম শর্করা
- ০ গ্রাম কোলেস্টেরল
- ৩২ ক্যালোরি
যে সকল খাদ্য গুণাগুণ রয়েছে তা হলো
- ১৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম
- ৪২৭ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম
- ৪৩ মিলিগ্রাম ফসফরাস
- ২৪.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি
- ১৪৯৯ আন্তর্জাতিক একক (IU) ভিটামিন এ
টমেটো কি হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো?
১০০ গ্রাম টমেটোতে পূর্ণবয়স্কদের জন্য ৬% পটাশিয়াম থাকে। বলা হয় বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম শরীরে স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। টমেটোতে আরও রয়েছে লাইকোপেন, যার কারণে টমেটোর রঙ লাল হয়। এই উপাদান শরীরে কোলেস্টেরল কমায় এবং কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
টমেটো কি চোখের জন্য ভালো?
টমেটোতে ক্যারোটিনয়েডস, লাইকোপেন, লুটিন এবং বেটা-ক্যারোটিন নামক বেশ কিছু ফাইটোকেমিক্যাল থাকে, যা চোখ ভালো রাখতে অত্যন্ত দরকারী। বার্ধক্যজনিত কারণে চোখের সমস্যা রোধেও এই উপাদানগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টমেটো চামড়ার জন্য কতটুকু ভালো?
টমেটোতে থাকা ক্যারোটিনয়েডস চামড়ার জন্যও ভালো। এটি চামড়ায় সরাসরি অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব পড়তে দেয় না। ২০০৬ এর একটি গবেষণায় দেখা যায় যে টমেটো খাওয়া মানুষের শরীরে ১০/১২ সপ্তাহে এই ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। এর মানে অবশ্যই এই নয় যে সারাদিন প্রচুর পরিমাণে টমেটো খেতে হবে। কিন্তু পরিমিত পরিমাণে টমেটো রোজ খেলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রতিরোধক চামড়ার নীচে সৃষ্টি হয়।
টমেটোর আর কি কোনো গুণাবলি রয়েছে?
অবশ্যই টমেটোর আরও অনেক গুণাবলি রয়েছে। এর মধ্যে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি হলো এটি ক্ষত সেরে উঠতে সাহায্য করে এবং মেনোপোজে বেশ কিছু উপকার করে থাকে। টমেটোতে থাকা ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাধতে সহায়তা করে। ফলে কাঁটাছেড়ার মতো ক্ষত খুব দ্রুতই সেরে উঠে। মেনোপোজে ঘটতে থাকা মানসিক পরিবর্তনগুলো, যেমন- অকারণে উত্তেজনা, অস্থিরতা, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি কমাতে টমেটো সাহায্য করে। ৯৫ জন মহিলাদের উপর, যারা ৪০-৬০ বছরে পদার্পন করেছেন, তাদেরকে দিনে দুবার ২০০ মিলিলিটার টমেটো জুস পান করতে দেয়া হয় এবং এমন ফলাফল পাওয়া যায়।
এছাড়াও টমেটো ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। শক্ত ও মজবুত হাড় পেতে টমেটোতে উপস্থিত থাকা ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সরাসরি ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও টমেটো চুলের সুস্বাস্থ্যে, কিডনি ভালো রাখায়, ধূমপানের ফলে হওয়া শারীরিক ক্ষতিপূরণ এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদান করে।
টমেটো রান্না করা অবস্থায় খেলে এর পুষ্টিগুণ অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। তবে সালাদ হিসেবে খেলেও যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি পাওয়া যায়।
কিন্তু যারা টমেটো খেতে পারেন না তাদের উপায় কী? অনেকের কাছেই টমেটো খেতে ভালো লাগে না কিংবা এর স্বাদ ভালো লাগে না। তাদের জন্যও নিম্নে টমেটো দিয়ে তৈরি কিছু মজাদার রেসিপি দেয়া হলো, যা আপনাকে প্রয়োজনীয় উপাদান প্রদানে সক্ষম। এই রেসিপিগুলো চেষ্টা করেই দেখুন। টমেটোর নতুন স্বাদ আপনার সামনে উন্মোচিত হবে।
১. টমেটো সালসা
উপকরণ
- ৪/৫টি মাঝারি আকারের টমেটো
- অর্ধেক পিয়াজ মিহিকুচি
- রসুনের একটি কোয়া
- ভিনেগার
- অর্ধেক লেবুর রস
- সামান্য ধনিয়াপাতা কুচি
প্রস্তুত প্রণালী
সব উপকরণ একত্রে মেখে হালকা আঁচে ৫ মিনিট নাড়ুন। তারপর নামিয়ে ঠাণ্ডা হলে পরিবেশন করুন। চারজনের জন্য পরিবেশন যোগ্য।
২. টমেটো রোস্ট
উপকরণ
- ১০/১২টি বড় টমেটো
- রসুনের ৪ কোয়া মিহিকুচি
- সামান্য পুদিনাপাতা
- ৩ টেবিল চামচ ভিনেগার
- ২ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
প্রস্তুত প্রণালী
১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ওভেন গরম করে নিন। টমেটোর সাথে সমস্ত উপকরণ মেখে নিন। একটি প্যানে বেকিং শিট বিছিয়ে নিন। টমেটোগুলো একে একে বসিয়ে দিন। হালকা পাঁচফোড়ন ছড়িয়ে দিতে পারেন (ঐচ্ছিক)। ১ ঘণ্টা পরে ওভেন থেকে বের করে পরিবেশন করুন।
৩. ক্রিমি টমেটো রিসোটো
নামটা একটু কাঠখোট্টা লাগলেও খুবই মজাদার এবং সহজে তৈরি করা যায় এমন একটি খাবার এটি। এই খাবারের উৎপত্তি মূলত ইউরোপে। চলুন দেখে নেয়া যাক এর উপকরণ এবং প্রস্তুত প্রণালী।
উপকরণ
- ৪০০ গ্রাম টমেটো
- সবজি সেদ্ধ এক কাপ
- ১ টেবিল চামচ মাখন
- ১টা বড় পিয়াজ মিহিকুচি
- ২ কোয়া রসুন মিহিকুচি
- ২৫০ গ্রাম পোলাওয়ের চাল
- ৩০০ গ্রাম ছোট টমেটো
- সামান্য ধনিয়াপাতা মিহিকুচি
- ৪ টেবিল চামচ পার্মিসিয়ান চিজ মিহিকুচি
প্রস্তুত প্রণালী
- ৪০০ গ্রাম টমেটো কুচি করে কেটে অর্ধেকটা ব্লেন্ডারে দিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। একটি সসপ্যানে মিহি করা টমেটো এবং কুচানো টমেটো একসাথে ঢেলে দিন। খুবই হালকা আঁচে রেখে ফুটিয়ে নিন।
- আরেকটি সসপ্যানে মাখন এবং তেল মাখিয়ে নিন। পিয়াজ এবং রসুন হালকা বাদামি করে ভেজে নিন। এতে চাল ঢেলে দিন এবং পরিমাণ মতো পানিতে রান্না করে নিন।
- রান্না করা চালে টমেটোর মিশ্রণ ঢেলে দিন। কিছুটা ঘন হয়ে আসলে তাতে ছোট টমেটোগুলো অর্ধেক করে কেটে ছেড়ে দিন। ২০/২৫ মিনিট পরে চুলা বন্ধ করে সসপ্যান চুলায় রেখে দিন।
- কিছুক্ষণ ঢেকে রাখার পর ধনিয়াপাতা কুচি এবং চিজ ছড়িয়ে এক মিনিট ওভেনে বেক করুন।
- হালকা গোলমরিচের গুড়া (ঐচ্ছিক) ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
উপরের সকল রেসিপি চারজনের জন্য পরিবেশনযোগ্য। চাইলে সমান পরিমাণে উপাদান বাড়িয়ে বা কমিয়ে কম-বেশি মানুষকে পরিবেশন করতে পারেন।
বাজারে এখন অহরহ টমেটো পাওয়া যাচ্ছে। জানতেন কি এর এত পুষ্টি গুণাগুণ? এই গরমে টমেটোর সালাদ বা জুস আপনাকে পানির অভাব পূরণে সহায়তা করবে। ঘরে কিছু নেই? বানিয়ে ফেলুন মজাদার টমেটোর চাটনি! যেভাবেই রান্না করা হোক বা খাওয়া হোক না কেন, টমেটোর পুষ্টি গুণাগুণ বহুলাংশে অক্ষুণ্ণ থাকে। সহজলভ্য, সুস্বাদু এবং মূলত কম দামী এই ফল আজই ঠাই করে নিক আপনার খাদ্যতালিকায় এবং আপনি হয়ে উঠুন আরও সুস্থ, সতেজ এবং প্রাণবন্ত!
ফিচার ছবিসূত্র: taste.com.au