মানুষ ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মাঝে মূল পার্থক্য বুদ্ধিমত্তায়। এই বুদ্ধির জোরেই আমরা পৃথিবীতে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছি। জন্মের পর থেকে আমাদের যেভাবে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে, তা অন্য সকল প্রাণী থেকে আলাদা। খেয়াল করে দেখবেন, একটি নবজাতক মানব শিশু ও অন্য কোনো সদ্যজাত প্রাণীর মাঝে কিন্তু তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সকল প্রাণীই জন্মের পর অসহায় ও পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে। খাবার ও নিরাপত্তার জন্য নিজের বাবা-মায়ের ওপর এদের নির্ভর করতে হয়।
কিন্তু, বয়স যত বাড়তে থাকে, বাচ্চাগুলো তত স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। নিজেদের শারীরিক বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করতে শেখে। এই একটা জায়গাতেই আসলে মানবশিশুর বৃদ্ধিতে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। একটি নবজাতক মানবশিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেবল শারীরিক বৃদ্ধিই ঘটে না। বয়সের সাথে সাথে দ্রুত হারে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে। এই ব্যাপারটি অন্য প্রাণীদের মাঝে খুবই স্বল্পাকারে দেখা যায় বলেই মানুষ পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী।
এই যে আমাদের মানসিক বিকাশ, এটা কিন্তু রাতারাতি ঘটছে না। ছোট্ট শিশু থেকে আমাদের বয়স যত বাড়তে থাকে, আমরা মানসিকভাবে তত বেশি পরিপক্বতা লাভ করি। মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসন মানবজাতির এই মানসিক ক্রমবিকাশের ধারাকে আটটি ধাপে ভাগ করেছেন। একেবারে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে আমরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কীভাবে নিজেদের গড়ে তুলি, তার এক চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এরিকসনের এই মানসিক ক্রমবিকাশ তত্ত্বের মাধ্যমে। এ তত্ত্বে যে আটটি ধাপের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব।
প্রথম ধাপ: বিশ্বাস ও অবিশ্বাস
একটি নবজাতক শিশু জন্মের পর থেকে ১৮ মাস বয়সের মধ্যে এই দুটো মানসিক গুন অর্জন করে। শিশুরা জন্মের পর খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য মা-বাবার উপর নির্ভরশীল থাকে। এখান থেকেই আসলে বিশ্বাসের ব্যাপারটা তৈরি হয়। শিশুর আদর-যত্নের মধ্যমণি হয়ে থাকে তার বাবা-মা। যে মানুষগুলোর কাছ থেকে বাচ্চারা নিজের সকল প্রয়োজন, বিশেষ করে খাবার ও ভরণপোষণ পেয়ে থাকে, তাদের প্রতি একধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়। একারণেই দেখা যায় যে, একেবারে অপরিচিত কারো কোলে গেলে বাচ্চারা প্রায়ই কান্নাকাটি করে। নিজের মায়ের কোলে বাচ্চাটি যে উষ্ণতা অনুভব করে, অপরিচিত কারো কোলে গেলে সেটি পায় না। আর এর থেকেই তৈরি হয় অবিশ্বাস। যখন বাচ্চাটি একটি মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত খাদ্য খাবার, আদর-যত্ন ও অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, তখনই তারা মানুষটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
এখানে একটি বিষয়ের দিকে বিশেষভাবে আলোকপাত করা উচিত। এক বছরের কমবয়সী বাচ্চারা প্রায়ই কান্নাকাটি করে। কখনো তা খাবার কিংবা আদরের জন্য, আবার কখনো এর পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকে না। সবসময় বাচ্চা কাঁদলেই তাদের কান্না থামাতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এতে বাচ্চারা বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বিনা কারণে কোনো বাচ্চা কান্নাকাটি করলে একসময় নিজে নিজেই থেমে যায়। এতে করে বাচ্চাটির মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং বারংবার কান্নাকাটি করার খারাপ অভ্যাসটা দূর হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: ব্যক্তিস্বাধীনতা, লজ্জা ও সন্দেহ
এরিকসনের বর্ণিত মানসিক বিকাশ তত্ত্বের দ্বিতীয় ধাপে আসে ব্যক্তিস্বাধীনতা, লজ্জা এবং সন্দেহ। এ ধাপের সময়সীমা হলো জন্মের পর ১৮ মাস বয়স থেকে তিন বছর পর্যন্ত। বাচ্চারা এটুকু বয়সেই বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা অর্জন করে ফেলে। মায়ের আঁচল থেকে বের হয়ে তারা নিজেরা অনেক কিছু শিখে ফেলে। নতুন রপ্ত করা কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে হাঁটতে ও দৌড়াতে পারা, নিজের জামা ও জুতো নিজে নিজে পরতে শেখা, নিজে নিজে খেলনা নিয়ে খেলতে পারা ইত্যাদি। এখান থেকেই শিশুদের মাঝে ব্যক্তিস্বাধীনতা তৈরি হয়।
এই সময়টাতে মা-বাবার উচিত সন্তানদের এই ব্যক্তিস্বাধীনতা যতটুকু সম্ভব উপভোগ করতে দেওয়া। বাচ্চারা যেন নিজেরাই নিজেদের খেলনা নির্বাচন করতে পারে, নিজেদের জামা-কাপড় নিজেরা পছন্দ করতে পারে- এই সুযোগটা দেওয়া উচিত। শুরুর দিকে তারা ভুল করবে ঠিকই। এর জন্য একটি সহজ কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাদের কাপড় কিংবা খেলনা পছন্দ করতে দেওয়ার সময় নিজেদের পছন্দ করা দুটির মধ্য থেকে তাদেরকে একটি নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। এটুকু স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে তাদের নিজেদের মধ্যে সংকোচ ও সন্দেহ তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে তারা নিজেরা নিজেদের নানা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বিপাকে পড়ে। এ সময় তাদের কোনো ভুল কাজের সমালোচনা না করে বরং তাদের উৎসাহ দিতে হয়। তা না হলে তাদের মাঝে নিজেদের নিয়ে লজ্জা, হীনম্মন্যতা ও সন্দেহ বাড়তে থাকে।
বাবা-মা যদি এই বয়সে বাচ্চাদের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করে, তাহলে বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান তৈরির প্রাথমিক ধাপ হলো এই বয়সটা। এ দুটো বৃদ্ধির পরিবেশ না পেলে তা মানসিক বিকাশের পথে তা এক বিরাট বাধা।
তৃতীয় ধাপ: উদ্যোগ ও অপরাধবোধ
এ ধাপের সময়সীমা তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত। এই সময়টাতে একটি বাচ্চা তার নিজ পরিবারের বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হতে থাকে। তার নিজের বয়সী কিছু খেলার সাথী তৈরি হয় এবং বাইরের মানুষজনের সাথে তার সখ্যতা বাড়তে থাকে। এসময় বাচ্চারা নিজেরা নিজেরা নানা খেলা তৈরি করে ফেলে। তারা নিজে নিজে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিতে শেখে। তাই বাবা-মার উচিত, তাদের এই কাজ গুলোতে সহায়তা করা। নিজের সন্তানকে সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সাথে নিয়মিত মেলামেশা করার সুযোগ দিতে হয়। তারা নিজেরা কোনো খেলা খেলতে চাইলে সাধ্যমতো সেগুলোতে অংশগ্রহণও করা উচিত। এতে করে বাচ্চাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
এই বয়সের একটা বিশেষ দিক হলো, বাচ্চারা অনেক কৌতূহলী হয়। তারা তাদের চারপাশে কী ঘটছে, কেন ঘটছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন করতে শুরু করে। বাচ্চাদের এসব কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে তাদেরকে সহায়তা করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে বিরক্তি প্রকাশ করলে কিংবা এড়িয়ে গেলে বাচ্চাদের মাঝে অপরাধবোধ তৈরি হয়।
এই বয়সে বাচ্চাদের মাঝে দুষ্টুমি ও কিছুটা জেদি মনোভাবও দেখা যায়। তাদেরকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ না করলে বাচ্চাদের মাঝে আত্মসংযমের ব্যাপারটা তৈরি হয় না। একইসাথে বাচ্চারা ভুল করলে তাদের ওপর রেগেমেগে চড়াও না হয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে। একটু অপরাধবোধ না থাকলে আবার তারা ভালো ও মন্দের মাঝে তফাত দেখতে পাবে না।
চতুর্থ ধাপ: কর্মদক্ষতা ও হীনম্মন্যতা
পাঁচ থেকে এগারো বছর বয়সী বাচ্চাদের মাঝে কর্মদক্ষতা যেমন বাড়ে, তেমনি হীনম্মন্যতাও তৈরি হয়। এসময় বাচ্চারা নতুন নতুন স্কুলে ভর্তি হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ধীরে ধীরে তাদের আচরণে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এর আগে কেবল বাবা-মা তার সন্তানদের দক্ষতা যাচাই করতেন। এখন স্কুলে তার শিক্ষকরা তার দক্ষতাগুলো যাচাই করে দেখেন। এতে করে সমবয়সী সহপাঠীদের মাঝে একটা প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যায়। এ বয়সে যে বাচ্চারা বিভিন্ন পাঠ্য বিষয় এবং পাঠ্য বিষয় বহির্ভূত কাজে পারদর্শিতা দেখায়, তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অপরদিকে যারা অন্যদের থেকে সামান্য পিছিয়ে থাকে, তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা বাসা বাঁধে। তাই এ বয়সটার দিকে নজর দেওয়া বেশ জরুরি।
একটা বাচ্চা হয়তো গণিতে দুর্বল। কিন্তু, সে অনেক ভালো গান গাইতে পারে কিংবা খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে। তাকে তাই গণিতে খারাপ হওয়ার জন্য বেশি চাপ না দিয়ে বরং তার অন্যান্য গুণের জন্য প্রশংসা ও অনুপ্রাণিত করা উচিত। বাচ্চারা নিজেদের কাজের জন্য প্রশংসিত হলে তাদের কর্মস্পৃহা ও উৎসাহ দুটোই বৃদ্ধি পায়। তারা তখন অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর সাহসটাও পেয়ে যায়।
আমাদের সমাজে প্রায়ই আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি বাচ্চাকে অন্য আরেকটি বাচ্চার সাথে তুলনা করে বসি। এতে যে বাচ্চাটির সমালোচনা করা হচ্ছে, সে অনেক কম বয়সেই হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করে। সে নিজের যোগ্যতাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। কিঞ্চিৎ হীনম্মন্যতা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বাচ্চা বেশি হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করলে অবশ্যই তাকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী জীবনে এর বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে।
পঞ্চম ধাপ: ব্যক্তিগত পরিচয় ও বিভ্রান্তি
মানসিক বিকাশের পঞ্চম ধাপের সময়সীমা ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করায় এটি জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কিশোর বয়স, তথা বয়ঃসন্ধিতে মানুষের আত্মসম্মান ও আবেগ দুটোই বৃদ্ধি পায়। এ সময়টাতেই কিন্তু আমাদের নিজস্ব চিন্তাধারা ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে থাকে। একজন কিশোর বা কিশোরী প্রথম তার ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে শুরু করে। একইসাথে তারা তাদের নিজস্ব একটি পরিচয় তৈরিতে তৎপর হয়। ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় এসময় প্রায়ই নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
বয়ঃসন্ধিতে থাকা একজন কিশোর বা কিশোরী আসলে ভবিষ্যতে কী করতে চায়, আশেপাশের মানুষ তাকে নিয়ে কী চিন্তা করছে, এসব নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করে। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও পরিচয় তৈরি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে এগুলো গঠনের জন্য এই পঞ্চম ধাপটিই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বয়সে আশেপাশের পরিবেশ আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। একইসাথে এ বয়সের শেষের দিকে আমাদের নিজস্ব নীতি ও নৈতিকতা পাকাপোক্তভাবে তৈরি হয়।
ষষ্ঠ ধাপ: অন্তরঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা
মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে, এখানে প্রত্যেকটি ধাপের ওপর পরবর্তী ধাপ অনেকাংশে নির্ভরশীল। পঞ্চম ধাপে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এ ধাপে এসে পরিবার বহির্ভূত কিছু সম্পর্ক তৈরি করি। পরিবারের বাইরের বেশ কিছু মানুষের সাথে আমাদের অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে। ১৮-৪০ বছর বয়স পর্যন্ত একটি লম্বা সময় নিয়ে এই ধাপ। নিজের ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী মানুষেরা নানা মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করে। ভালো বন্ধুবান্ধব ও জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে তারা একটি প্রতিশ্রুতিশীল সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে।
এসময় যারা পরিচয় সংকট বা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে, তারা আবার উল্টো একাকিত্বে ভুগতে শুরু করে। পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরিতে তারা দ্বিধা অনুভব করে। আমরা ‘ইন্টিমেসি ইস্যু’ বলে যে শব্দটা ব্যবহার করি, সেটিই এদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। আর এর সাথে বৃদ্ধি পায় হতাশা ও বিষণ্ণতা।
সাধারণত ষষ্ঠ ধাপে সাফল্যের মাধ্যমেই আমরা আমাদের জীবনের প্রকৃত ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পেয়ে থাকি।
সপ্তম ধাপ: জেনারেটিভিটি ও স্থবিরতা
এরিকসনের বর্ণিত আটটি ধাপের মধ্যে সপ্তম ধাপের সময়কাল ৪০-৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত। একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি এ সময়ে নিজের থেকে অন্যদের পেছনে সময় দিতে বেশি পছন্দ করেন। সমাজ, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের জন্য তারা কাজ করার একটা তাগিদ অনুভব করেন। এই যে অন্যের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করা, একেই মনোবিদ্যার ভাষায় জেনারেটিভিটি বলা হয়। জীবন যুদ্ধে ৪০ বছর পার করে দেওয়া একজন মানুষ মনে করেন যে তিনি নিজের জন্য যথেষ্ট করেছেন। এখন তার দায়িত্ব, পরিবারের জন্য কিছু করে রেখে যাওয়া। যে সমাজে তিনি বাস করেন, সে সমাজের নানারকম কর্মকাণ্ডেও তিনি অবদান রাখতে চেষ্টা করেন।
এ বয়সে এসে অনেকেই নিজের পরিবার ও সমাজের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। অল্প উপার্জনের কারণে হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক, তারা নিজেদের সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন। ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে অপারগ হওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। তারা সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়াদি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন।
অষ্টম ধাপ: পরিপূর্ণতা ও হতাশা
মানসিক বিকাশের একেবারে শেষ ধাপে এসে একজন মানুষ পেছনের দিকে তাকাতে শুরু করেন। ৬৫ বছর বয়স থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই সময়টাতে তারা অতীতের হিসাব-নিকাশ করতে থাকেন। শেষ বয়সে এসে তারা চিন্তা করেন, জীবনে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন কি না। আর আসলে এর পুরোটাই নির্ভর করে গ্রহণযোগ্যতার উপর। যারা নিজেদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, তারা একধরনের পরিপূর্ণতা অনুভব করেন। আর যারা মনে করেন, তাদের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে, তারা এ সময় হতাশাগ্রস্ত হন। অতীতের কিছু ভুল তারা এখন চাইলেই শুধরাতে পারবেন না, এ চিন্তা তাদেরকে কষ্ট দিতে থাকে।
মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের মতে, শেষ ধাপে এসে একজন মানুষ এই দু’রকমের অনুভূতিই অনুভব করে থাকেন। যারা এই শেষ বয়সে এসে জীবন নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট, পরবর্তীকালে তারা মৃত্যুকেও অনেক সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন।
শেষ কথা
মানুষের জীবনচক্রে ধাপে ধাপে ব্যক্তিত্বের বিকাশ কীভাবে ঘটে, তা খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের এই তত্ত্বে। তবে এ তত্ত্বে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তিনি নিজেও এটি স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে একটি ধাপ থেকে কীভাবে মানুষ অন্য ধাপে পদার্পণ করে, কী কী অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের মানসিক পরিবর্তনগুলো হয়ে থাকে, তা নিয়ে তিনি বিস্তারিত ব্যাখা করেননি। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকালে অনেক সহজে এই তত্ত্বের সাথে একটা যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। বর্তমানে এরিকসনের এ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত অনেক গবেষক আচরণগত মনোবিদ্যা নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেছেন।