ভ্যাক্সিন হেসিট্যান্সি কী?
- ভ্যাক্সিনের যথেষ্ট সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ভ্যাক্সিন গ্রহণে মানুষের বিলম্ব করা বা নিতে সম্পূর্ণ অনীহা প্রকাশ করা।
- ভৌগলিক পরিবেশ, সময়, ভ্যাক্সিনের ধরন ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে বিষয়টির রকমফের হয়ে থাকে।
- ভ্যাক্সিন হেসিট্যান্সির জন্য দায়ী কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় ফাইভ সি (5C) মডেলের মাধ্যমে।
কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান
ইম্পেরিয়াল কলেজ অভ লন্ডনের গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করার পর প্রায় প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর শরীরে আশাব্যাঞ্জক পরিমাণে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাক্সিন হসপিটালাইজেশনের হার শতকরা ৯২-৯৬ ভাগ হ্রাস করতে সক্ষম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয়াবহতার চেয়ে এর ভ্যাক্সিন গ্রহণে সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার বহুলাংশে কম। এতসব গবেষণার ইতিবাচক ফলাফলের পরও পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছেন যারা ভ্যাক্সিন নিতে অনিচ্ছুক কিংবা তারা সত্যিই ভ্যাক্সিন নিলেও অনেক দেরি করে নিয়ে থাকেন। কেন? চলুন জেনে আসা যাক সম্ভাব্য সকল ব্যাখ্যার মাঝে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য ফাইভ সি (5C) মডেল সম্পর্কে।
ফাইভ সি মডেল
যারা ভ্যাক্সিন নিতে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন তাদের প্রতি অন্যদের একটি সাধারণ ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে যে অনিচ্ছুক সকলেই একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী; একই ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী বলেই হয়তো তারা সকলেই ভ্যাক্সিন গ্রহণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বস্তুত, এই ধারণাটি ভুল। ভ্যাক্সিন গ্রহণে অনীহা পোষণ করার পেছনে একচেটিয়াভাবে একটি কারণই দায়ী নয়। ভ্যাক্সিন নেব কিনা- মানুষের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে একাধিক কারণ যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
- কনফিডেন্স: যে টিকাটি নিকটস্থ এলাকায় দেওয়া হচ্ছে মানুষ অনেক সময়ই তার ওপর যথেষ্ট আস্থাভাজন হতে পারে না। টিকাটি সুদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরেই বাজারে এসেছে তবু তারা এর কার্যকারিতা ও সুরক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না বলেই টিকা গ্রহণে কালক্ষেপণ করেন অথবা সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকেন। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও নীতি নির্ধারকদের নিয়ে ইতিবাচক ধারণার অভাবও মানুষের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরায়।
- কমপ্লেসেন্সি: ভ্যাক্সিন নিতে অনীহা প্রকাশের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ওই রোগের প্রেক্ষিতে ব্যক্তি নিজেকে ইমিউন ভাবেন। তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তিনি এতটাই সুনিশ্চিত থাকেন যে তিনি ওই রোগে আক্রান্ত হবেন না বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ফলে, তিনি ভ্যাক্সিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
- ক্যালকুলেশন: ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যক্তি এক সীমাহীন জ্ঞান আহরণে রত থাকেন এবং বেলা বয়ে গেলেও তার আর চূড়ান্ত সিদ্ধানে পৌঁছানো হয়ে ওঠে না।
- কন্সট্রেইন্টস (অথবা কনভেনিয়েন্স): ভ্যাক্সিন গ্রহণের কাজটি সত্যিই একজন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য কতটা সহজ বা কতটা কঠিন সেটিও ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
- কালেক্টিভ রেস্পন্সিবিলিটি: সমাজের একজন সদস্য হিসেবে অন্যান্য সদস্যদের প্রতি ব্যক্তি নিজে কতটা দায়িত্ব অনুভব করেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেটিও একটি নিয়ামক। ব্যক্তি যদি নিজে ভ্যাক্সিন গ্রহণের মাধ্যমে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধ করার দায় অনুভব করতে পারেন তাহলে তিনি স্বেচ্ছায় ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে থাকেন।
এখানে একটি বিষয় না বললেই নয়। ভ্যাক্সিন হেসিট্যান্সি শুধু যে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করেই সাড়া ফেলেছে এমনটি কিন্তু নয়। ভ্যাক্সিন গ্রহণে মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্ব বহু আগে থেকেই চলে এসেছে। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে রোগ, সমাজ, বয়স, স্থান ইত্যাদি নানা কিছুর প্রভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ধরনে পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ফাইভ সি মডেলের ভ্যালিডেশনের (সত্যাসত্য যাচাই) লক্ষ্যে জার্মানিতে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ফাইভ সি-র উপর ভিত্তি করে একটি প্রশ্নপত্রে মার্কিং করতে বলা হয়। প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে পরবর্তীতে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা গ্রহণের বাস্তব চিত্রের সাযুজ্য সন্ধান করে দেখা যায় যে, ফাইভ সি মডেল বাস্তবতাকে বেশ সুচারুরূপে সমর্থন করে। অর্থাৎ, ফাইভ সি মডেলে উল্লেখিত বিষয়গুলোই বাস্তব জীবনে মানুষের ভ্যাক্সিন গ্রহণে অনীহা প্রকাশের কারণসমূহকে যথোপযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এছাড়া ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের একটি গবেষণাপত্র বলছে যে, ভ্যাক্সিন গ্রহণের সময় সুঁইয়ের স্পর্শকে ভয় পেয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ভ্যাক্সিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
কগনিটিভ বায়াস
মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতার অন্যতম কারণ কগনিটিভ বায়াস। দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা করতে গিয়ে আমরা কমবেশি সকলেই অসংখ্য কগনিটিভ বায়াসের শিকার হই। এসব বায়াসের কারণে আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়া খুব ঘোলাটে হয়ে যায় এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে এগিয়ে যাই নিজেদের অজান্তেই। নেগেটিভিটি বায়াস ও অপটিমিজম বায়াস- দুটোই মানুষের চিন্তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
নেগেটিভিটি বায়াসের শিকার হয়ে মানুষ যে নেতিবাচক তথ্যের মুখোমুখি হয় তাকেই সে সত্য বলে ধরে নিতে শুরু করে। সত্য হিসেবে বিবেচনা না করলেও নিদেনপক্ষে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওই নেতিবাচক তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, অপটিমিজম বায়াস মানুষকে অবাস্তব আশাবাদীতায় ভাসায়। এর কল্যাণে মানুষ ভাবতে শুরু করে, তার সুনির্দিষ্ট ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, এবং ঠিক এ কারণেই তার ভ্যাক্সিন গ্রহণের কোনো দরকার নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বায়াসগুলো একাকী অথবা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
কনফার্মেশন বায়াসকে বলা হয় বায়াসের রাজ্যের গুরু। মনে আছে ফাইভ সি মডেলের ক্যালকুলেশনের কথা? যারা এই বিষয়টি দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কনফার্মেশন বায়াসের নির্মম শিকার হন। যেহেতু তারা ভ্যাক্সিন হেসিট্যান্সিতে ভুগে থাকেন, তাই আগে থেকেই তাদের মনে ভ্যাক্সিনকে ঘিরে খুব সূক্ষ্ম হলেও একটা নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। এরপর তারা ইন্টারনেট, গণমাধ্যম, বইপত্রে সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্যের অনুসন্ধান করেন। যেহেতু তাদের প্রশ্নগুলো হয়ে থাকে নেতিবাচক ব্যপারগুলোকে ভিত্তি করেই, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তরগুলোও তাদের পূর্ব থেকে অনুমিত ধারণাকেই সমর্থন করার মতো হয়। এই দুষ্টচক্রের কারণে ক্রমেই তারা আরও বেশি নিশ্চিত হন যে, তাদের বাস্তবিক পক্ষেই ভ্যাক্সিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
উত্তরণের উপায় তবে কী?
সংলাপ। পৃথিবীতে সৎ, স্বপ্রণোদিত, কার্যকর সংলাপের মাধ্যমে বহু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বৈকি। মানুষ কেন ভ্যাক্সিন নিতে অনীহা প্রকাশ করে এটি অনুমানের বিষয় নয়, নয় কোনো তত্ত্বেরও বিষয়। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে, যারা ভ্যাক্সিন নিতে অনিচ্ছা জ্ঞাপন করছেন তাদের ভাবনাটা আসলে কী? উপলব্ধির আগে অবশ্যই খোলাখুলিভাবে শুনতে হবে তাদের বয়ান।
মানুষকে রাজি করাতে চাইলে এমন কারো মাধ্যমে কাজটা করতে হবে যাকে তারা অধিকতর বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ভাবেন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ খুবই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেন। একই কথা, একই বার্তা যখন চিকিৎসক, নার্সদের মতো পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা না বলে বরং ধর্মীয় কোনো ব্যক্তি বলেন, তখন তার কথাটা অনেক বেশি ওজস্বী হয়। এতে ওই অঞ্চলের মানুষরা ভ্যাক্সিন নিতে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে মানুষের চিন্তার জায়গা কোথায় সেটা ধরতে পারা। ভ্যাক্সিন গ্রহণের হার বৃদ্ধির জন্য কেবলই গৎবাঁধা কথাবার্তা না বলে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের সমস্যার জায়গাগুলো একে একে আমলে নিতে হবে। তাদের প্রশ্নের, সন্দেহের, দ্বিধার বিষয়গুলোকে যথাযথ তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এতে করে তারা বুঝতে পারবেন যে, তাদের বক্তব্যকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে তখন তারা নিজেদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসতে সচেষ্ট হবেন।