মনে করুন, মিষ্টি রোদে মাখা একটি দিন। পাখি ডাকছে, মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এমন একটা দিনে কী করতে মন চাইবে আপনার? নিশ্চয়ই একটু ঘুরে বেড়াতে, একটু চারপাশে হেঁটে আসতে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারাটাও কিন্তু খুব একটা খারাপ কিছু হবে না, তাই না? কিন্তু কেমন হবে, যদি এমন একটা দিনে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে বয়ে যাওয়া খালের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া হয়, কিংবা ভয়ংকর কোনো রোলার কোস্টার রাইডে চড়ে বসা যায়? চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেল তো আপনার? কিন্তু এই বিপদজনক আর রোমাঞ্চকর কাজগুলো করতেই এমন মিষ্টি দিনে সবচাইতে ভালো লাগবে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের। স্বাভাবিকভাবেই আপনার মাথায় প্রশ্ন আসবে- কেন? নির্ঝঞ্ঝাট সময়ে এমন গা শিউরানো কাজ করতে ভালো লাগে কীভাবে এই মানুষগুলোর?
মূলত, যেকোনো ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের প্রধান কারণ কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নয়। বিশেষ করে, সেই আগ্রহ যদি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারে হয় তাহলে সেখানে নতুন কিছু করা আর ঝুঁকির প্রতি আমাদের আকর্ষণ- এ দুটো আবেগ মিশ্রিত থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা যেটাকে বলে থাকেন “নতুন কিছু খোঁজার আকর্ষণ”, সেটা আদতে অপ্রত্যাশিত এবং অচেনা কিছুকে চেনার একটা মাধ্যম কেবল। খুব ভালো করে দেখতে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন, নতুন কিছু করতে চাওয়া এই মানুষগুলো অসম্ভব বিরক্ত ও হতাশ হয়ে পড়েন জীবন নিয়ে মাঝেমধ্যে। জীবনে আরো মজার, আরো রোমাঞ্চকর কিছু করতে, যার শেষ অব্দি ফলাফল কী হবে সেটা জানা যায় না, এমন কিছু করতে সবসময় তাই মুখিয়ে থাকেন তারা। তাদের কাছে জীবনকে আরো একটু বেশি উপভোগ করার জন্য দরকার পড়ে আরো একটু বেশি কিছুর, একটু বেশি রোমাঞ্চকর সময় ও কাজের। কখনো কখনো সেই বেশি কিছুর সমাপ্তি ঘটে মাদক কিংবা অন্য কোনো ভয়ানক গন্তব্যে।
ডোপামিন: যত দোষ, নন্দ ঘোষ!
এক স্নায়ু থেকে অন্য স্নায়ুতে বার্তা পাঠাতে গেলে দরকার পড়ে ডোপামিনের। অনেকে একে ‘প্লেজার কেমিক্যাল’ বা আনন্দ উদ্দীপক রাসায়নিক বলে ভাবতে ভালোবাসেন। ডোপামিন মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যখানে অবস্থান করে। এটি প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের শরীরে জন্ম নেয়। কাজের প্রেরণা, চেতনা, আনন্দের অনুভূতি, পুরস্কার পাওয়া বা কোনোকিছু জিতে নেওয়ার মতো ব্যাপারগুলোর সাথে বড় রকমের সম্পর্ক আছে ডোপামিনের। খাওয়ার সময় কিংবা মাদক গ্রহনকালে এই ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত রোগীদের যাদেরকে ডোপামিন বাড়ানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তাদের শতকরা ১৭ শতাংশের মধ্যে জুয়া খেলা, অতিরিক্ত খাওয়া ইত্যাদির প্রবণতা দেখা দেয়। শুধু তা-ই নয়, এই রোগীদের মধ্যে অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাও দেখতে পাওয়া যায় আরো বেশি পরিমাণে। এতে করে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পড়েন সবাই যে, ডোপামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে আগ্রহবোধ করে।
একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, মানুষ যেখানে জিতে যাওয়ার আশা করে, সেখানে তার মস্তিষ্কের ডোপামিন প্রধান অঞ্চলগুলোতে কার্যক্রম অনেক বেশি বেড়ে যায়। অন্যদিকে হেরে যাওয়ার চিন্তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে এই কার্যক্রম অনেক কমে আসে। অবশ্য, কোনো কোনো কার্যক্রম মস্তিষ্কে জিতে যাওয়া এবং হেরে যাওয়া- দুটো অনুভূতিই একসাথে দিয়ে থাকে। এই যেমন, রোলার কোস্টার কিংবা বেইজজাম্পিঙয়ের বেলায়, মস্তিষ্কে পুরো রোমাঞ্চ উপভোগের একটা অনুভূতি থাকে। অন্যদিকে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটার মাধ্যমে হেরে যাওয়ার অনুভুতিও থাকে। অবশ্য, রোলার কোস্টারে জেতার অনুভুতি শতকরা ১০০% থাকলেও হারার অনুভূতি থাকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। অন্যদিকে, বেইজজাম্পিঙয়ে যত বেশি উপরে ওঠা হয়, ততবেশি হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা অনেক সময় ৫০ শতাংশে গিয়েও ঠেকে।
শুধু তা-ই নয়, বেশিরভাগ গবেষণায় এটাও পাওয়া যায় যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোপামিন রিসেপ্টরসম্পন্ন মানুষের ক্ষেত্রে, ঝুঁকি খোঁজার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এটা অনেক সময় জন্মগতভাবেই তৈরি বৈশিষ্ট্য মনে করা হলেও, মাঝেমধ্যে বেড়ে ওঠার সময়টিকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় এক্ষেত্রে। মানুষ কতটা ঝুঁকি নেবে সেটা যেমন তার মস্তিষ্কের গঠনের উপরে নির্ভর করে, ঠিক তেমনি কেমন পরিবেশে সে বড় হয়েছে, তার চিন্তাভাবনা কেমন তার উপরেও নির্ভর করে। কেন কারো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে ভালোলাগে যেগুলোর কোনো নিশ্চিত ফলাফল নেই, এবং কারো কেন খুব সাধারণ কোনো কাজ বেশি ভালো লাগে, নিশ্চিত ফলাফল আছে এমন কাজ করতে ইচ্ছে করে- এর মূল কোনো একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বন্ধুদের প্রভাবও অনেক বড় ভূমিকা রাখে এখানে। তবে ডোপামিন এক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, বয়ঃসন্ধিকালে, যখন মানুষের মস্তিষ্ক এবং শরীর গঠিত হচ্ছে একটু একটু করে, তখন মানুষ ঝুঁকি নিতে বেশি পছন্দ করে। সেসময় শরীরের রাসায়নিক উপাদানগুলো সঠিকভাবে কাজ করে না।
কিন্তু যদি আমরা মানুষের মধ্যে কাউকে ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে, এবং কাউকে ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে না- ডোপামিনের মাধ্যমে এ দুটো ভাগে ভাগ করেও ফেলি, একটি প্রশ্ন থেকেও যায়। আর সেটি হল, আমাদের জিন ঝুঁকি নিতে চাওয়ার গঠনে থাকলেও আমরা কেন ভয় পাওয়ার নিদর্শন রেখে যায়? এমন কোনো ভ্রমণে যাওয়া, যেখান থেকে আপনি না-ও ফিরে আসতে পারেন, ব্যাপারটি সঙ্গত। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে নিজের জীবন বীমা করে যাওয়াটা অসঙ্গত। অন্যদিকে, যদি আমাদের ধরনটা হয় ঝুঁকি এড়িয়ে চলার, অথচ আমরা অতিকায় রোলার কোস্টারে ওঠার টিকিট পাই, তাহলেও সেখানে যাব। অর্থাৎ, পুরষ্কার যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চাইলেও, তবুও সেটা আমরা নিতে আগ্রহী। সেক্ষেত্রে খুব পরিষ্কারভাবে এটা বলে দেওয়া যায় যে, মানুষ ডোপামিনের পরিমাণের উপরে নির্ভর করে ঝুঁকি নিতে ভালোবাসুক আর না বাসুক, দুই পক্ষ দ্বারাই তাদের অবস্থানের উল্টো কাজটা করানো সম্ভব।
কিছু মানুষ, যাদের মধ্যে কোনোরকম মানসিক বিপর্যয় কিংবা বিপদকে উপভোগ করার প্রবণতা আছে, তারাও ঝুঁকি নিতে ভালোবাসেন। তবে কে কতটা জিতবেন সেটাও অনেক সময় নির্ভর করে ঝুঁকির পরিমাণের উপরে। এই যেমন- আপনি ধূমপান করতে পছন্দ করেন। আপনি জানেন যে, এতে করে আপনার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তবুও আপনি ধূমপান করছেন, এই ঝুঁকি নিচ্ছেন আনন্দ লাভের জন্য। ঠিক একইরকম কাজে আপনি আরো বেশি আনন্দ পাবেন যদি ঝুঁকিটা আরো একটু বেশি নিয়ে আপনার ঘরের মধ্যে ধূমপান করেন আপনি। এতে করে, আপনার ধরা পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে এবং সেইসাথে আপনার উপভোগের পরিমাণটাও বাড়বে। গবেষণায় দেখা যায় যে, যাদের স্ট্রায়েটাম অঞ্চল বেশি কর্মক্ষম, যে অঞ্চলে ডোপামিন উৎপন্ন হয়, তারা অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে ভালোবাসেন। উপরের কথাগুলোকে সত্যি এবং যুক্তিযুক্ত মেনে নিলে স্বীকার করতেই হবে যে, নতুন কিছু আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের উৎপাদন বাড়ায় এবং ফলে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো পুরস্কার পাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। আর সেই নতুন কিছুর পুরষ্কারটা ঠিক কী তা যদি না জানা যায়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই!
ফিচার ইমেজ: Adventure | HowStuffWorks