করোনাভাইরাস বনাম জ্যাক মা ফাউন্ডেশন

২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বরে চীনের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং আলিবাবা কর্ণধার মি. জ্যাক মা নিজের নামেই জ্যাক মা ফাউন্ডেশন (JMF) গঠন করেন। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি অলাভজনক সংস্থা হিসেবে মানবহিতৈষী কাজ অর্থাৎ পৃথিবী এবং মানুষের উন্নতি এবং কল্যাণে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফাউন্ডেশনটি কাজ করার জন্য চারটি বিশেষ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে-  

  • সামাজিক উদ্যোগ
  • শিক্ষা
  • নারী নেতৃত্ব
  • চিকিৎসা সেবা ও পরিবেশ সংরক্ষণ।
জ্যাক মা ফাউন্ডেশন; Image Source: businesswire.com

কার্যক্রম এবং পৃথক তহবিল

প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নতিতে শিক্ষিত এবং উদ্যোগী জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা, এই অঞ্চলগুলোতে শিশু সুরক্ষা, যুব উগ্যোক্তা এবং নারী গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নতির মাধ্যমে সুখী, সমৃদ্ধ এবং সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলাই জ্যাক মা তথা এই প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্ন। সুনির্দিষ্ট এই লক্ষ্যেগুলো অর্জন করতে মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানটি নিম্নলিখিত পৃথক তহবিলগুলো গঠন করেছে।

  • জ্যাক মা গ্রামীণ শিক্ষা কার্যক্রম
  • জ্যাক মা শিক্ষা তহবিল
  • আফ্রিকা  নেটপ্রেনর  কার্যক্রম
  • চীন জাতীয় মাহিলা ফুটবল দলের উন্নতি কার্যক্রম
  • পরিবেশ সংরক্ষণ তহবিল এবং কার্যক্রম
  • চিকিৎসা তহবিল এবং কার্যক্রম। 
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে এসেছেন জ্যাক মা; Image Source: zeebiz.com

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জ্যাক মা ফাউন্ডেশন

পুরো পৃথিবী যখন করোনা প্রাদুর্ভাবে দিশেহারা, ঠিক তখনই জ্যাক মা ফাউন্ডেশন তাদের রুটিন কার্যক্রমের বাইরে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে আলোকবর্তিকা হাতে। চীনের পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্থ বিভিন্ন দেশে ফেস মাস্ক, ডিটেকশন কিট এবং চিকিৎসা সামগ্রীর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি এককালীন অনুদান বরাদ্দ করছে।

দ্রুত সময়ে কার্যকরী করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা কাজকে গতিশীল করতে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এককালীন তহবিল দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জ্যাক মা বলেন-

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় দ্রুত যাতে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আসে, এ নিয়ে গবেষকরা আসলে দিন-রাত কাজ করছেন, কিন্তু স্বল্প সময়ে এই কার্যকরী ভ্যাকসিন নিয়ে আসা এবং জনসাধারণের ওপরে এর সফল প্রয়োগ ঘটানো কিন্তু মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। আমরা আশা করি, কার্যকরী ভ্যাকসিন আসার আগেই আমরা এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। ভাইরাস বনাম মানুষের এই যুদ্ধ আসলে সময়সাপেক্ষ। ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের জিততে হলে ধৈর্য, অভিজ্ঞতা, আশা এবং সর্বোপরি আত্মপ্রত্যয়ের প্রয়োজন। জ্যাক মা ফাউন্ডেশন করোনার কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে যা যা দরকার, ঠিক তা-ই করবে।

ভ্যাকসিন গবেষণা তহবিল

চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি জ্যাক মা ফাউন্ডেশন কার্যকরী করোনা প্রতিষেধক আবিষ্কারে কাজ করতে বেশ কয়েকটি রিসার্চ ফ্যাসিলিটির জন্য ১৪.২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি তহবিল ঘোষণা করে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম গতিশীল এবং ত্বরান্বিত করতে বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গবেষণা সংস্থা জ্যাক ফাউন্ডেশনটির সাথে সমন্বিত হয়েছে। 

  • মার্চ ২; অস্ট্রেলিয়ার ইন্সটিটিউট ফর ইনফেকশন অ্যান্ড ইম্যুনিটি
  • ফেব্রুয়ারি ১৮; কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেইলম্যান পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ফাউন্ডেশন
  • ফেব্রুয়ারি ১৩; জং নানশান মেডিকেল ফাউন্ডেশন, গুংজু ইন্সটিটিউট অব রেস্পিরেটরি হেলথ এবং আলিবাবা ক্লাউড
  • ফেব্রুয়ারি ১১; ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স, চীন
  • ফেব্রুয়ারি ০৭; ন্যাশনাল একাডেমী অব ইঞ্জিনিয়ারিং, চীন। 
ভাইরাসের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটির ১৪.২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল ঘোষণা; Image Source: cryptonewsz.com

গবেষণার সুবিধার্থে জ্যাক মা ফাউন্ডেশন এ পর্যন্ত চীনের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য ২.৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স-এর জন্য ২.৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জং নানশান মেডিকেল ফাউন্ডেশন এবং গুংজু ইনস্টিটিউট অভ রেস্পিরেটরি হেলথে ০.৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ২.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ার পিটার ডোহার্টি ইনস্টিটিউট ফর ইনফেকশন অ্যান্ড ইমিউনিটিতে ২.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সরাসরি তহবিল প্রদান করেছে।

আলিবাবার সহায়তা 

দ্রুত করোনা-প্রতিষেধক আবিষ্কারকল্পে কাজ করতে জ্যাক মা-এর আরেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আলিবাবা ফাউন্ডেশনও সমানভাবে এগিয়ে এসেছে। গবেষণা ফ্যাসিলিটিগুলোর গবেষণা কার্যক্রমকে সুষম এবং ত্বরান্বিত করতে এই প্রতিষ্ঠানটি যাবতীয় কম্পিউটার পরিষেবা দিচ্ছে।

এগিয়ে এসেছে জ্যাক মা’র আরেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আলিবাবা; Image Source: bangladeshpost.net

চিকিৎসা সেবা এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ

বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ ছড়ানোর পর থেকেই জ্যাক মা ফাউন্ডেশন পৃথিবীর নানা প্রান্তের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আক্রান্ত এবং বিপদগ্রস্থ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে সার্বিক সহায়তা করছে জ্যাক মা’র আরেক প্রতিষ্ঠান আলিবাবা ফাউন্ডেশন।

দুর্দশাগ্রস্থ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের জন্য সমন্বিতভাবে এই প্রতিষ্ঠান দুটি মিলিয়ন মিলিয়ন ফেইস মাস্কসহ কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তকরণে পরীক্ষণ কিট এবং প্রতিরোধে নানা ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ দান করছে।

কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তকরণে কিট এবং নানা ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ প্রদান করছে এই ফাউন্ডেশন; Image Source: alizila.com

এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকা অঞ্চলগুলোতে সহায়তা পৌঁছে গিয়েছে। এক্ষেত্রে জ্যাক মা এবং আলিবাবা ফাউন্ডেশনের সমন্বিত সাহায্যের বিস্তারিত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হচ্ছে-

জাপান

করোনা ভাইরাস থেকে যথাযথ সুরক্ষার জন্য জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জাপানের জনগণের জন্য ১ম দফায় ৩ লক্ষ ফেইস মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে এবং ২য় দফায় আরও ১০ লক্ষ ফেইস মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে।

কোরিয়া

কোভিড-১৯ প্রতিরোধকল্পে প্রতিষ্ঠানটি থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় দ্রুততম সময়ে ১০ লক্ষ ফেইস মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে।

ইরান

কোভিড-১৯ যেসব দেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, এদের মধ্যে ইরান অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি দেশটিতে সম্ভাব্য রোগী শনাক্ত করতে ১ লক্ষ ডিটেকশন কিট এবং ৩০ হাজার ইউনিট পিউরিফিকেশন রিজেন্ট দিচ্ছে। এছাড়া ১০ লক্ষ ফেইস মাস্ক ইতোমধ্যে দেশটিতে পৌঁছে গিয়েছে।

মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন্স, থাইল্যান্ড

মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২০ লক্ষ ফেইস মাস্ক, দেড় লক্ষ ডিটেকশন কিট এবং ২০ হাজার ইউনিট করে নিরাপত্তা স্যুট এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নিরাপদ ফেইস শিল্ড দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইউরোপ

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেন এখন করোনা মহামারিতে টালমাটাল। দেশটিতে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগী এবং মৃত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আলিবাবা ফাউন্ডেশনের সাথে সমন্বয় করে জ্যাক মা ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যেই ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং স্লোভেনিয়ায় ৩৫ লক্ষ ফেইস মাস্ক এবং ২ লক্ষ ডিটেকশন কিট সরবরাহ করেছে।

দ্রুত সময়ে আক্রান্ত দেশগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে জ্যাক মা’র সাহায্য; Image Source: scmp.com

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 

জ্যাক মা ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা সমস্যায় মার্কিনীদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে। ১০ লক্ষ ফেইস মাস্ক এবং ৫ লক্ষ ডিটেকশন কিট মার্কিনীদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি বরাদ্দ করেছে। ইতোমধ্যেই ২ লক্ষ কিট আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছে।

রুয়ান্ডা

ফাউন্ডেশন এই দেশটিতে ৩০ হাজার ইউনিট করে ডিটেকশন কিট এবং পিউরিফিকেশন রিজেন্ট সরবরাহ করছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি এখানে ৩০ হাজার কোভিড-১৯ কেইস শনাক্ত করতে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা করছে।

আফ্রিকা অঞ্চল

করোনা মোকাবেলায় আফ্রিকা অঞ্চলের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সহায়তা করতে জ্যাক মা ফাউন্ডেশন এগিয়ে এসেছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ৬০ লক্ষ ফেইস মাস্ক, ১১ লক্ষ ডিটেকশন কিট এবং ৬০ হাজার ইউনিট করে নিরাপত্তা স্যুট এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিরাপদ ফেইস শিল্ড দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ল্যাটিন আমেরিকা 

বিশ্বব্যাপী সাহায্যের ধারাবাহিকতায় জ্যাক মা ফাউন্ডেশন ল্যাটিন অঞ্চলের ২৪টি দেশে ২ মিলিয়ন ফেইস মাস্ক, ৪ লক্ষ টেস্ট কিট এবং ১০৪টি ভেন্টিলেটর জরুরি সাহায্য হিসেবে প্রদান করছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুত সময়ে দেশগুলোতে এই সাহায্য পৌঁছে যাবে।

এশিয়া অঞ্চল

এশিয়া অঞ্চলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে আলিবাবার সহায়তায় জ্যাক মা ফাউন্ডেশন ২ মিলিয়ন ফেইস মাস্ক, দেড় লক্ষ টেস্ট কিট, ২০ হাজার ইউনিট করে নিরাপত্তা স্যুট এবং ফেস শিল্ড প্রদানের ঘোষণা করেছে। প্রথম পর্যায়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে এই জরুরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সংস্থাটি নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত এই অঞ্চলেও দ্রুত জরুরি মেডিকেল সহায়তা প্রদান করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

This article is in the Bengali language. It is about COVID-19 relief and research funds assisted by Jack Ma Foundation and Alibaba. Information is collected from Jack Ma Foundation and Alibaba's official websites.

Reference:

1. Jack Ma Foundation

2. Alibaba

Featured Image: Getty Images 

Related Articles

Exit mobile version