১৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দ; অ্যান্টোনিন প্লেগের সময় ছিল এই পুরো পনেরো বছর। এই লম্বা সময়ে গুটি বসন্তের এই ভাইরাসটি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। মানবশূন্য করে দিয়ে যায় রোমের শহর, গ্রাম। পরাক্রমশালী রোম সাম্রাজ্যে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। ধারণা হয়, পূর্বদিক হতে সামরিক অভিযান শেষে ফেরা সৈন্য বাহিনীর সাথে এই ভাইরাসটি রোমে আসে। প্লেগটির প্রধান লক্ষণ ছিল জ্বর, ডায়রিয়া, বমি, গলা ফুলে যাওয়া, প্রবল তৃষ্ণা ও মাত্রাতিরিক্ত কাশি।
গ্রিক চিকিৎসক গালেন প্লেগটির সম্ভাব্য কারণ, উপসর্গ ও গতিপথ বর্ণনা করেন বিদায় একে ‘প্লেগ অভ গালেন’ বা গালেনের প্লেগ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এমনিতে প্লেগটির নামকরণ করা হয় সে সময়কার রোমান সম্রাট ও স্টোয়িক দার্শনিক মার্কার অরেলিয়াস অ্যান্টোনিয়াস নামে।
সে সময়, মহামারির ঠিক মাঝামাঝি সময়ে মার্কাস অরেলিয়াস নিজেকে দেওয়া নিজের উপদেশগুলো জার্নাল আকারে লিখতে থাকেন, যা বর্তমানে আত্মচিন্তা বা মেডিটেশন নামে দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত।
মহামারির সময়ে তিনি প্রতিনিয়ত স্টোয়িকবাদের মূল দর্শনকে মানসিক যন্ত্রণা, অসুস্থতা, রোমে চলা ভয়ঙ্কর মহামারি নিয়ে দুশ্চিন্তা, ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে মানসিক ধীরতার জন্য মন্ত্রণা হিসেবে কাজে লাগান। স্টোয়িক দর্শনের মূল বিষয়গুলোকে নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে সারমর্ম আকারে জার্নালে আবদ্ধ করেন। আশা করা যায়, করোনার দিনগুলোতে স্টোয়িক দর্শন ও মার্কাস অরেলিয়াসের পথ নির্দেশনা আমাদের মানসিক ধীরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
প্রথমে স্টোয়িকবাদের কয়েকটি মৌলিক নীতি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। স্টোয়িক বিশ্বাস বলে-
আমাদের কল্যাণ, মঙ্গল বাস করে আমাদের স্বভাব ও কাজে। চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। কী আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, কী নেই, সে বিষয়ে স্পষ্ট বিচারক্ষমতা অর্জনের উপর।
অর্থাৎ, যা ঘটে, ঘটছে, সেগুলো সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু সেগুলোর উপর ভিত্তি করে আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। ঠিক বর্তমান সময়ের মতো।
ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে আমাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু আমরা চাইলেই ঠিকঠাকভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, বিশেষজ্ঞদের দেওয়া পরামর্শ, করণীয় জিনিসগুলো মেনে ভাইরাসটির আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারি। অর্থাৎ, ভাইরাসটির সংস্পর্শে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা ঝুঁকিতে নেই। কিন্তু ভাইরাসটির চাইতে ভাইরাসটির প্রতি আমাদের ভয় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
স্টোয়িক দর্শনের প্রচলিত স্লোগানটি হচ্ছে, “ক্ষতি করতে পারে এমন জিনিসগুলোর চেয়ে সেগুলোর ভয় আমাদের বেশি ক্ষতি করে।” আমাদের যতগুলো অস্বাস্থ্যকর, ক্ষতিকর ইমোশন বা আবেগ রয়েছে, তার মধ্যে ভয় অন্যতম। আপনার হয়তো করোনার আক্রমণ থেকে নিরানব্বই শতাংশ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভাইরাসটি নিয়ে করা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ভয় আপনার ক্ষতি করে ছাড়বে। আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, চিন্তা-ভাবনার সর্বনাশ করে আপনাকে পাগল করে তুলবে। মানসিকভাবে পঙ্গু করে তুলবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন অবস্থায় মানুষ আত্মহত্যাও করে বসে।
তবে স্টোয়িকদের কাছে স্লোগানটি আরো গভীর অর্থ বহন করে। ভাইরাস হয়তো আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে। সর্বোচ্চ আমাদেরকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিবে। কিন্তু ভয় আমাদের সত্ত্বার নৈতিক মূলে ঢুকে আমাদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। আমাদের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। স্টোয়িকদের কাছে তা মৃত্যুর চাইতেও বেশি ভয়ঙ্কর।
এমন অবস্থায় মার্কাস অরেলিয়াস সব সময় নিজেকে প্রশ্ন করতেন,
“এধরনের পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে প্রকৃতি আমাকে কী গুণ দিয়েছে? অন্যরা কীভাবে এধরণের পরিস্থিতি সামলে উঠেছিল, উঠছে?”
জ্ঞানচর্চা, ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো চারিত্রিক শক্তিগুলোর উপর স্টোয়িকরা সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জিনিসগুলোকেই প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত গুণ হিসেবে ধরা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এধরনের চারিত্রিক শক্তিগুলো দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান সহ মহামারির মতো কঠিন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে মার্কাস অরেলিয়াস ঐতিহাসিক, এমনকি কাল্পনিক চরিত্রগুলো থেকেও কীভাবে এ ধরনের কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করা যায়, তা শেখার চেষ্টা করতেন।
অন্যদিকে মহামারি চলাকালে আমরা হয়তো করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাও থেকে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতি, চিন্তাভাবনার সম্মুখীন হলেই, সাধারণত দুটো জিনিস হয়ে থাকে। হয়তো আমাদের মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরে। ভয় আমাদের আমাদের সত্ত্বার উপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। নয়তো আমাদের মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মৃত্যু, অসুস্থতার মতো অনিবার্য বিষয়গুলো অস্বীকার শুরু করার মাধ্যমে ভয়গুলোকে দূরে ঠেলে রাখে।
অনিবার্য জিনিসগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর সবচাইতে প্রচলিত কোপিং স্ট্র্যাটেজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এজন্যই আমরা অধিকাংশরা মৃত্যুর মতো স্ব-স্পষ্ট ঘটনাকে অস্বীকার করি। মৃত্যুর ভয়কে মোকাবেলা করার জন্য আমরা এমন ভাব নিয়ে দুনিয়াতে বিচরণ করি, যেন আমরা অবিনশ্বর, অমর, চিরজীবী। আমরা এমনকি নিজেদের মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করতেও স্বস্তিবোধ করি না।
কিন্তু স্টোয়িকরা বিশ্বাস করেন, আমরা যখন নিজেদের মৃত্যুর মুখোমুখি হই, যখন মৃত্যু যে নিশ্চিত তা উপলব্ধি করি, জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়।
“পৃথিবীতে প্রত্যেকটা জিনিস আসে যাওয়ার জন্য। অসুস্থতা, মৃত্যু বসন্তের ফুল আর শরতের ফলের মতোই নিশ্চিত, সাধারণ একটি ব্যাপার।”
স্টোয়িক দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস এমনটাই বলতেন।
মার্কাস অরেলিয়াস যখন মৃত্যুশয্যায়, তার পরিবার, বন্ধুবান্ধবরা যখন পাশে বসে কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি তাদের কান্না করতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, বরং তারা যেন অসুস্থতা ও মৃত্যুকে অনিবার্য এবং প্রকৃতিতে খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। তিনি মনে করতেন, মৃত্যু, অসুস্থতার মতো প্রকৃতিতে অনিবার্য ঘটা জিনিসগুলোকে যদি আমরা স্বীকার করে নিতে পারি, তাহলে অন্যান্য যেকোনো ক্ষতি, দুঃখ, দুর্দশা সামলানো আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।