গ্লুকোজ আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শরীরের প্রতিটি কোষের কাজ করার শক্তির জন্য প্রয়োজন গ্লুকোজের। কোষগুলোতে গ্লুকোজ পৌঁছায় রক্তের মাধ্যমে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ভর করে আপনার খাদ্যাভ্যাস এবং খাবারের সময়ের ওপর। এর পরিমাণ কমে গেলে যদি চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা হয়, আপনি হাইপোগ্লাইসেমিক কোমায় চলে যেতে পারেন। আবার কোনো কারণে কোষে গ্লুকোজ না পৌঁছালে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। আর গ্লুকোজ বেড়ে গেলে শরীরে অনেক জটিলতা দেখা দেয়।
রক্তে স্বাভাবিক গ্লুকোজের মাত্রা ৬০-১৪০ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার। ‘হিমোগ্লোবিন এ১সি’ নামক রক্তের আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এতে পূর্ববর্তী তিন মাসের গড় গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এর মান ৫.৭% এর কম হলে স্বাভাবিক ধরা হয়। গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি হলে তা হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা ডায়বেটিসের লক্ষণ।
গ্লুকোজ বেড়ে গেলে শরীরের স্নায়ু, রক্তনালী ও অন্যান্য অঙ্গগুলোতে বিপদজনক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গ্লুকোজ বেড়ে গেলে কী কী ক্ষতি হতে পারে জেনে নেয়া যাক।
কোনো উপসর্গ না থাকা
বেশিরভাগ সময়ই রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকলেও কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। অন্তত শুরুর দিকে প্রকাশ পায় না। যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতি চারজনের একজন জানেনই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। এর কারণ গ্লুকোজের মাত্রা ডায়বেটিসের উপসর্গ প্রকাশ করার মতো মাত্রায় না পৌঁছা। কিন্তু তাদের ঝুঁকি থাকে ডায়াবেটিস হওয়ার। তাই ভালো উপায় হচ্ছে আপনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে থাকলে নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা।
আপনি কীভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে? আপনার ওজন যদি অতিরিক্ত হয়, শারীরিক পরিশ্রম যদি কম করেন, যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের ডায়াবেটিস থাকে তবে আপনার ঝুঁকি রয়েছে ডায়াবেটিস হওয়ার। অবশ্য একবার পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা যদি বেশি পান, তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, আপনি অসুস্থ থাকলে বা মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে সাময়িকভাবে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু বারবার পরীক্ষা করার পরও যদি উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজ পাওয়া যায়, তখন বুঝতে হবে আপনার সমস্যা আছে। তবে এতে সুবিধা হচ্ছে, উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই ধরা পড়ায় আপনি চিকিৎসা নিয়ে একে দ্রুত স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারবেন এবং মারাত্মক জটিলতা এড়াতে পারবেন।
ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া
রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গেলে আমাদের শরীর চায় অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করে দিতে। অতিরিক্ত গ্লুকোজ তখন প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। বেশি পরিমাণ গ্লুকোজ বের করার জন্য প্রস্রাবও তৈরি হয় বেশি পরিমাণে। তাই ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পায়। এতে শরীর থেকে পানিও কমে যায় অনেক পরিমাণে। তাই তখন পানির পিপাসাও পায় বেশি। অন্যদিকে কোষে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ না যাওয়ায় ক্ষুধার পরিমাণও বেড়ে যায়। হঠাৎ করে ওজনও কমে যেতে পারে। আবার রাতে ঘুমের মধ্যে প্রস্রাবের চাপ পড়ায় ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে।
সবসময় ক্লান্ত অনুভূত হওয়া
আপনার কোষগুলো শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ পাচ্ছে না। আপনার কোষ শক্তি পাচ্ছে না মানে আপনিও কাজ করার শক্তি পাচ্ছেন না। এ কারণে আপনার প্রায়ই শরীর দুর্বল লাগবে। অন্যদিকে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তকে ঘন আর আঠালো করে ফেলে। ফলে রক্ত প্রবাহের গতি কমে যায়।
হৃৎপিণ্ডকে তখন রক্ত সঞ্চালনের জন্য অনেক জোরে চাপ প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু রক্তের গতি কম থাকায় কোষগুলোতে সেই অনুপাতে পুষ্টি পৌঁছায় না। যেসব অঞ্চলের রক্তনালী ছোট (চোখ, কান, স্নায়ু), সেখানেও রক্ত ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে না। অন্যদিকে ঘন ঘন প্রস্রাবের মাধ্যমে পানিও কমতে থাকে শরীর থাকে। ফলে শরীর শক্তি হারাতে থাকে।
দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত
গ্লুকোজের কারণে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চোখের পেছনের দিকে সবচেয়ে আলোক সংবেদনশীল জায়গা হচ্ছে রেটিনা। গ্লুকোজের কারণে রেটিনার ছোট রক্তনালীগুলোর যদি ক্ষতি হয়, চোখের দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায়। গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকে নিয়ে আসলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসতে পারে। কিন্তু আরো ক্ষতিকর পর্যায়ে গেলে দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে।
পায়ে সংক্রমণ
বেশি মাত্রায় গ্লুকোজের কারণে পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সংবেদনশীলতা হারাতে পারে। তখন পায়ে কোনো আঘাত পেলে অনেক বড় সমস্যা হতে পারে। পায়ে লোহা আটকানো কিংবা ফোসকা পড়া থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পা পঁচে যেতে পারে। এতে অনেক সময় পা কেটেও ফেলতে হতে পারে। বর্তমানে পা কেটে ফেলার অন্যতম একটি কারণ ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ে সংক্রমণ দেখা দেয়া।
কিডনি ক্ষয় হওয়া
কিডনিতে থাকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালী, যেগুলো আমাদের শরীরে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের কাজ করে। রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকলে, এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করার জন্য নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার কাজ বেড়ে যায়। বছরের পর বছর এমন চলতে থাকলে কিডনি একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন আর নিষ্কাশন প্রক্রিয়া ঠিকমতো করতে পারে না।
এই সমস্যা জানার উপায় প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে গেছে কি না তা দেখা। গ্লুকোজ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনলে কিডনি আবার সচল হতে পারে। যদি চিকিৎসা না নেয়া হয়, তখন কিডনি ক্ষয় হতে থাকবে। একসময় কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দেবে। তখন ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
দাঁত ও মুখের ক্ষয়
উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজের কারণে দাঁত ও মুখের অনেক ক্ষতি হতে পারে। মুখের লালা বা স্যালাইভায় যে গ্লুকোজ থাকে, তা মুখের ব্যাকটেরিয়াগুলো খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। তখন দাঁতে আঠালো জাতীয় একধরনের পদার্থ রেখে চলে যায়। এতে দাঁতের ক্ষয় হয়। গ্লুকোজের কারণে দাঁতের মাড়িতে ব্যথা ও রক্তপাত হতে পারে। এছাড়া মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া ও ঠোঁটে ফাটলও দেখা দিতে পারে এর কারণে। ‘ওরাল থ্রাশ’ নামক ছত্রাক জাতীয় রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণগুলোরও একটি এটি।
চামড়ায় সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকলে এর প্রভাব চামড়াতেও পড়ে। গ্লুকোজ বের করার জন্য শরীর থেকে যেহেতু প্রস্রাবের কারণে পানি হারাতে হয়, এতে চামড়াও শুষ্ক হয়ে পড়ে। চামড়া ফেটে যায়। তখন ছত্রাক জাতীয় সংক্রমণগুলো বেড়ে যায়, যা খুব বেদনাদায়ক। মহিলাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি দেখা যায়। স্তন ও উরুতে এই সংক্রমণগুলো দেখা দিতে পারে।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া
রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকলে তা মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। এতে স্মৃতিশক্তির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি আলঝেইমারস ডিজিসও হতে পারে। জার্মানির এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি তারা যদি ডায়বেটিস রোগী না-ও হয়, তারপরও তাদের মধ্যে চিন্তা ও স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা হ্রাস পায়। মস্তিষ্ক স্ক্যান করেও তাদের হিপোক্যাম্পাস স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট পাওয়া যায়। হিপোক্যাম্পাস হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদের স্মৃতি জমা রাখে।
হরমোন বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অভ আলবামার পরিচালক ফার্নান্দো ওভালি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আপনার গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে রক্ত চলাচল প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে আপনার স্ট্রোক, মস্তিষ্ক ক্ষয় ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে”।
শেষকথা
ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা। এর প্রতিকার করতে হলে নিয়ম মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই। খাদ্যাভ্যাস, ওজন ও শারীরিক পরিশ্রমের দিকে সবসময় মনোযোগ রাখতে হবে। নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আপনার যদি কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে উচিত হবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এটি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।