নবী-রাসুলদের স্মৃতি বিজড়িত অথবা পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কবরস্থানে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়াটা নতুন কিছু নয়। এমনটা প্রায়ই ঘটে, দৈনন্দিন জীবনেও আমরা তা দেখতে পাই। যেমনটা ঘটে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান- তিন সম্প্রদায়ের কাছেই পরম পবিত্র স্থান জেরুজালেমে গিয়ে।
প্রাচীন এই শহর ঘুরে দেখাবার জন্য গাইডরা থাকে সদা প্রস্তুত। এমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন অলিভার ম্যাকাফি। ২৯ বছর বয়সী ব্রিটিশ এই পর্যটক আসেন পবিত্র নগরী জেরুজালেমে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে শেষবারের মতো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। তখন তিনি দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমিতে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। তারপর ম্যাকাফির আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি! তবে তার ওয়ালেট এবং ল্যাপটপ কিছু পর্যটক খুঁজে পেলে পুলিশ অনুসন্ধানে নামে। টেলিগ্রাফ পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, যেখানে এই ভদ্রলোক সাইকেল চালাচ্ছিলেন, তার কাছেই পাওয়া গিয়েছে বাইবেলের কিছু ছেঁড়া পাতা এবং ম্যাকাফির নিজের হাতে লেখা কিছু লাইন। অনুসন্ধানকারীদের মতে, স্বেচ্ছায় মরুভূমির ভেতরে হারিয়ে গিয়েছেন ম্যাকাফি, যেমনটা যিশু খ্রিস্ট গিয়েছিলেন চল্লিশ দিন এবং চল্লিশ রাতের জন্য। ব্রিটিশ এই পর্যটক ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া ধার্মিক হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাদের সন্দেহের কথা জানায়:
জেরুজালেম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন অলিভার ম্যাকাফি।
যদিও এখন পর্যন্ত এই রোগটি মনোরোগের নানা বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবুও অন্তত এহেন ঘটনার আধিক্যের কথা একেবারে অস্বীকার করা যায় না।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই জেরুজালেম ভ্রমণ করতে হবে। কিন্তু যত মানুষ জেরুজালেমে যান, তাদের সবাই কি আচমকা নিজেকে ঈশ্বরের দূত অথবা জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট দাবী করেন? কখনোই না! তাহলে কেন কিছু কিছু মানুষের মাঝে দেখা যায় এই উপসর্গ? তারা কি মানসিকভাবে অসুস্থ? নাকি আত্মিক পরিশুদ্ধতার অভিজ্ঞতা নিতে না পেরে এমন আচরণ শুরু করে তারা।
বইপত্র এই রোগের অস্তিত্বের কথা স্বীকার না করলেও এই ক’দিন আগেও প্রতি বছর কম করে হলেও ৫০ জন পর্যটক এই উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালে। জেরুজালেমের একটি সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালকে তাই জেরুজালেম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণও করে দেয়া হয়েছে! বিংশ শতাব্দীতে পা রাখার ঠিক আগে দিয়ে আচমকা অনেক বেড়ে গিয়েছিল আক্রান্তদের সংখ্যা। কিন্তু ২০১১ সালে নেয়া সেই হাসপাতালের এক মনোবিদের সাক্ষাৎকার অনুসারে এখন বছরে খুব বেশি রোগী ভর্তি হন না এই রোগ নিয়ে।
ইতিহাস
জেরুজালেম সিন্ড্রোমকে আগে বিবেচনা করা হত সাময়িক স্নায়ু-বৈকল্য সংক্রান্ত রোগ হিসেবে। তখন এর নাম ছিল জেরুজালেম স্কোয়াবল পয়জন। ১৯৩০ সালে জেরুজালেমেরই মনোচিকিৎসক হেইনয হারম্যান সর্বপ্রথম রোগ হিসেবে একে ব্যাখ্যা করেন। হারম্যান নিজ পেশায় বিখ্যাত একজন মানুষ। তার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েলের আধুনিক সাইকিয়াট্রিক গবেষণা।
তবে এই উপসর্গগুলো কেবলই জেরুজালেমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি না, তা নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ্ব। কেননা মক্কা বা রোমের মতো এলাকাতেও এমন আচরণের উদাহরণ রয়েছে। এমনকি সেই মধ্যযুগেও আছে এই সিন্ড্রোমের সদর্প উপস্থিতি; ফেলিক্স ফাবরি বা মার্জারি কেম্পের জীবনী থেকে আমরা তা জানতে পারি। উনিশ শতকে জেরুজালেমে পা রাখা পর্যটকদের লেখা থেকেও আমরা আরও কেসের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হই।
কাদের হয় জেরুজালেম সিন্ড্রোম?
নারী অথবা পুরুষ উভয়েই হতে পারেন জেরুজালেম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। তবে হ্যাঁ, পুরুষদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সামান্য বেশি নারীদের থেকে। রোগীদের পরিচিতি, লিঙ্গ, বয়স, জাতীয়তা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই-
১) উত্তর আমেরিকার অধিবাসী
২) প্রটেস্টান্ট
৩) বয়েস বিশ থেকে ত্রিশের মাঝে
৪)অবিবাহিত
উপসর্গ
মনোচিকিৎসক বার-এল সিন্ড্রোমটিকে মোট সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যেকটির রয়েছে অনন্য উপসর্গ।
১) অনিশ্চয়তাবোধ: এই ধাপের একদম প্রথম থেকেই, অদ্ভুত এক উদ্বেগের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করেন রোগী।
২) একাকী থাকার ইচ্ছা: একাই শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে জন্মায় রোগীর মনে। ফলশ্রুতিতে বন্ধুবান্ধব বা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান তিনি।
৩) পবিত্রতা: দ্বিতীয় ধাপেই হাসপাতালে নেয়া না হলে, বার-এলের মতে, রোগী পাগলের মতো গোসল করতে থাকেন এবং নিজেকে অপরিষ্কার ভেবে পরিষ্কার করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। হাত-পায়ের নখ নিখুঁতভাবে কাটার প্রতি থাকে তার অপরিসীম যত্ন।
৪) প্রস্তুতি: এই ধাপে রোগী হোটেলের চাদর ছিঁড়ে টোগা বানিয়ে নেন। সর্বদা সাদা হয় এই টোগা, লম্বায় হয় গোড়ালি পর্যন্ত। এছাড়া আর কোনো পোশাক গায়ে তোলেন না তিনি।
৫) চিৎকার-চেঁচামেচি: এই পর্যায়ে রোগীরা হুট করে চেঁচিয়ে ওঠেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় বাইবেলের কোনো স্তব অথবা কোনো প্রশংসাগীতি। জেরুজালেমের সব হোটেল কর্মচারীকে নির্দেশ দেয়া আছে- এই অবস্থা দেখলে যেন হাসপাতালে খবর দেয়া হয়!
৬) দ্রুতপায়ে চলা: বার-এলের মতে, এরপরই রোগীর মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব শহরের কোনো পবিত্র স্থানের দিকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
৭) ধর্মপ্রচার: সেই পবিত্র স্থানে পৌঁছাবার পর আক্রান্ত ব্যক্তি ধর্মপ্রচার করতে শুরু করেন। পবিত্র এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপনের দিকে আহ্বান করাই হয়ে থাকে তার প্রধান লক্ষ্য। অদ্ভুত সব বাক্য উচ্চারণ করতে থাকেন তিনি, বেশিরভাগই নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
প্রকারভেদ
প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় জেরুজালেম সিন্ড্রোমকে। টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত রোগীদের অতীতেও মানসিক রোগের ইতিহাস। টাইপ টু-এর রোগীরা সাধারণত জেরুজালেমকে নিয়ে প্রচণ্ড আবেগ দেখিয়ে থাকে শহরটায় পা রাখার আগে থেকেই। এবং টাইপ থ্রি-এর রোগীদের কোনো ধরনের মনোরোগের অতীত ইতিহাস থাকে না।
এই মনোরোগে আক্রান্ত শতকরা প্রায় আশি শতাংশ রোগীই টাইপ ওয়ান বা টাইপ টু-এ পড়েন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে, প্রায় বারোশ রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় কেফার শাউল মেন্টাল হসপিটালে। এদের মাঝে ৪৭০ জন ভর্তি হন সেই হাসপাতালে, যার মাত্র ৪২ জন ছিল টাইপ থ্রি-এর রোগী।
টাইপ ওয়ানের রোগীরা সাধারণত নিজেদেরকে বাইবেলের বিশেষ কোনো চরিত্র বলে পরিচয় দেয়। টাইপ টু-এর রোগীরা হয় একাকী, অন্য কাউকে সঙ্গে না নিয়ে তারা দেখতে আসে পবিত্র নগরী। সবচেয়ে বিরল হচ্ছে টাইপ থ্রি-এর রোগী, এদের আচরণ বা কথা-বার্তা থেকে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে তারা অতি দ্রুত জেরুজালেম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন!
চিকিৎসা
যখন কোনো পর্যটকের মাঝে জেরুজালেম সিন্ড্রোমের উপসর্গের দেখা পেলে, কর্তৃপক্ষ তাকে দ্রুত নিয়ে আসে কেফার শাউলে। সাধারণত কাউন্সেলিংয়েই কাজ হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধপত্রের প্রয়োজন পড়ে।
তবে কেফার শাউলের ডাক্তারদের মতে, এই রোগের সেরা চিকিৎসা হলো রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব শহর থেকে বের করে তার পরিবার-পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া। সাধারণত এতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন রোগী। সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন লাগে রোগের উপসর্গগুলো মুছে যেতে।
জেরুজালেম সিন্ড্রোম নিয়ে আসা সব রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। সাধারণত বছরে একশো জন রোগী আসেন কেফার শাউলে, অদ্ভুত আচরণ নিয়ে। তার মাঝে মাত্র চল্লিশজনকে ভর্তি করার দরকার দেখা দেয়।