“O, beware, my lord, of jealousy;
It is the green ey’d monster, which doth mock
The meat it feeds on”
– William Shakespeare, Othello
ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয় চিরন্তন। কিছুটা ভয়, কিছুটা সন্দেহ, কিছুটা “ও শুধু আমার” ধরনের চিন্তা সম্পর্ককে আরো মিষ্টি ও সুন্দর করে তোলে। তবে ভয় আর সন্দেহ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখনই নেমে আসে মানসিক কিংবা শারীরিক নিপীড়ন, যা ভয়ের কারণ বৈকি! আর এই সব কিছু মিলিয়ে যে জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি হয় সেটাই ওথেলো সিনড্রোম। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জন টোড নামক একজন ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ এই সমস্যাকে ওথেলো সিনড্রোম হিসেবে অভিহিত করেন। আজ তাহলে ওথেলো সিনড্রোম সম্পর্কে দুই-চারটি কথা জেনে নেয়া যাক।
ওথেলো এবং শেক্সপীয়ার
উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি ‘ওথেলো’র শুরুটা হয়েছিল ইতালির ভেনিস শহরে। ভালোবাসা, অবিশ্বাস, সন্দেহ, খুন, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ, অনুতাপ- কী নেই এই নাটকে! অন্যের প্ররোচনায় নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওথেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী ডেসডিমোনাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে, পরকীয়ার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে, শেষ পর্যন্ত নিজ হাতে খুন করে ডেসডিমোনাকে। সবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওথেলো নিজেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ওথেলো আর ডেসডিমোনার মধ্যে ভালোবাসার অভাব কখনো ছিল না। বরং সাধারণের চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিল হয়তো। প্রচণ্ড ভালোবাসা কখনো কখনো ধ্বংস বয়ে আনে, এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ বোধহয় এটাই।
ওথেলো সিনড্রোম কীভাবে নিশ্চিত হবেন?
কেস ১
৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ তার ৬৫ বছরের বৃদ্ধা স্ত্রীকে পরকীয়ার অজুহাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। কোনো কাজে ঘরের বাইরে গেলে গোপনে তার উপর নজরদারি করতেন এবং স্ত্রী ঘরে ফিরে এলে তাকে কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কার সাথে গিয়েছিল এই ধরনের নানা প্রশ্ন করা ছিল তার রুটিনমাফিক কাজ। এমনকি স্ত্রীকে প্রতিবেশী কারো সঙ্গে মিশতেও তিনি বাধা দিতেন।
কেস ২
একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করার কিছুদিন পর থেকেই স্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বামীকে বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকেন। অফিসের নারী কলিগের সাথে কথা বলা যাবে না, টিভিতে খবরের চ্যানেল বাদে আর কোনো চ্যানেল দেখা যাবে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় নারী বন্ধু রাখা যাবে না ইত্যাদি।
উপরের এই দুটি ঘটনাই ডাক্তারি পরিভাষায় ওথেলো সিনড্রোমের উদাহরণ। এছাড়াও এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি আরো কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকেন। যেমন :
- সঙ্গীর যেকোনো কাজ সন্দেহের চোখে দেখা।
- নিয়মিত ফোনের কল লিস্ট চেক করা, কার সাথে কেন কথা হচ্ছে সেই ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানো।
- সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে নজরদারি করা।
- প্রতিবেশী কারো সাথে সুসম্পর্ক না রাখা, এমনকি নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা।
আপনি যদি কারো মধ্যে উপরের একাধিক ঘটনার মিল পান, তাহলেই যে তিনি ওথেলো সিনড্রোমে ভুগছেন তেমনটা না-ও হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে আপনার উচিত তাকে অথবা তার পরিবারকে সেই সম্পর্কে জানানো।
প্রতিরোধ নাকি প্রতিকার
ওথেলো সিনড্রোম প্রতিরোধ করার তেমন কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত মজবুত হলে এই ধরনের সমস্যা সাধারণত হয় না, আর হলেও খুব সহজেই তা কাটিয়ে ওঠা যায়। অনেক সময় স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ব্রেইন টিউমার অথবা পারকিনসন্স ডিজিজের রোগীদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। আবার অ্যালকোহল বা কোকেনের মতো ড্রাগের সাইড ইফেক্ট হিসেবেও ওথেলো সিনড্রোম মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
সমস্যাটা যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক তাই আগে থেকে বোঝার কিংবা সতর্ক হবার কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। তবে হ্যাঁ, আপনি যেটা করতে পারেন তা হলো, আশেপাশে কারো মধ্যে অথবা আপনার নিজের মধ্যে যদি ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে অহেতুক সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হয় তবে সেটা নিজের মধ্যে চেপে রাখবেন না। যেকোনো সমস্যা ঢেকেঢুকে রাখতে গিয়েই কিন্তু আমরা সমস্যাটাকে আরো বড় করে তুলি। তাই এ ব্যাপারে কথা বলুন, বুঝতে চেষ্টা করুন যা আপনি ভাবছেন সেটা কি আদৌ সত্যি? নাকি পুরোটাই আপনার কল্পনা?
পরিবারের সহযোগিতা খুব দরকার
সবার আগে যা দরকার তা হলো পরিবারের সবার সহযোগিতা। যেকোনো দাম্পত্য কলহে পরিবার একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। আপনার যদি মনে হয় আপনার ভালোবাসার মানুষের জীবনে অন্য কারো অস্তিত্ব আছে, তবে সেটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন। মনগড়া কোনো গল্প বানিয়ে নিজেকে কষ্ট দেবার কোনো মানে হয় না। পরিবারের বাকিদের সাথেও এটা নিয়ে কথা বলুন। নিজের সমস্যার কথা জানান। একে অপরকে জায়গা দিতে গিয়ে আবার দূরে সরে যাবেন না যেন! একে অন্যকে সময় দিন। বাইরের কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে আপনজনকে ভুল বুঝলে শেষে ওথেলোর মতো “হায় হায়” করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমস্যার সমাধান করুন।
নিতে পারেন মনোবিদের পরামর্শ
যে মুহূর্তে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার সঙ্গী আপনার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত, তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আপনার অনিরাপত্তার ফল, সেই মুহূর্তেই কিন্তু আপনি নিজেই আপনার সমস্যার অর্ধেক সমাধান করে ফেলেছেন। তবে যেহেতু সমস্যাটা মনস্তাত্ত্বিক এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিণতি হয় খুন, জখম, আত্মহত্যা কিংবা সম্পর্কবিচ্ছেদ। তাই আপনার উচিত একজন মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া। আমাদের দেশে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির জন্য মনোবিদের শরণাপন্ন হওয়াটাকে অনেকেই ভাল চোখে দেখেন না। উল্টো ব্যাপারটা গোপন রাখার দিকেই সবার ঝোঁক। অথচ শুরুর দিকে শুধুমাত্র কাউন্সেলিং করেই সমাধান সম্ভব। তবে সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করলে হালকা কিছু ঔষধপত্র আপনাকে দেয়া হতে পারে।
Loved not wisely, but too well
– Othello
ওথেলোকে ভালোবেসেই ঘর ছেড়েছিল ডেসডিমোনা। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই ওথেলোই সম্পূর্ণ বিনা কারণে হত্যা করে ডেসডিমোনাকে। শুধুমাত্র নিছক সন্দেহের বশে, অন্যের মিথ্যা প্ররোচনায় সায় দিয়ে নিজের সংসার নিজেই ধ্বংস করে ওথেলো। অতিরিক্ত যেকোনো কিছু আপনার ক্ষতি বয়ে আনে। সেটা যদি ভালোবাসার মতো স্বর্গীয় বিষয় হয়, তবুও অতিরিক্ত আসক্তি সব সময়ই ভয়ের কারণ। তাই একজন আরেকজনকে সময় দিন। সম্পর্কে তিক্ততা যেন কখনও না আসে। প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় অস্বাভাবিক না। কিন্তু সেই ভয়ে যদি সম্পর্কই শেষ করে ফেলেন তাহলে কী করে হবে বলুন তো! নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন, নিজের ভালোবাসার মানুষটার উপর বিশ্বাস রাখুন। হৃদয়ের এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতিকে উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নেই, কারো না।