মানবদেহ নামক জটিল জৈব যন্ত্রটির ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষে প্রতিমুহূর্তে চলছে অসংখ্য বিপাকীয় প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হচ্ছে শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সচল থাকছে জৈব যন্ত্রটি। আমরা চলছি, ফিরছি, ঘুরছি, ভাবছি- এই শক্তিকে কাজে লাগিয়েই। কিন্তু শক্তি উৎপন্ন করতে গিয়ে কোষে একইসাথে উৎপন্ন হচ্ছে অনেকখানি বর্জ্য পদার্থ। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, কার্বন ডাই-অক্সাইড সহ আরো কিছু জিনিস। কোষ থেকে এরা চলে আসে রক্তে। তারপরে কী হবে? কোথায় যাবে এরা?
এই বিপাকীয় বর্জ্য রক্তে বেশিক্ষণ জমতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই বিপদ। বিষাক্ত করে তুলবে শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। তাই দ্রুত বের করে দিতে হবে এগুলোকে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের দায়িত্ব নেয় একজোড়া ফুসফুস। এদের মাধ্যমে দেহ থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড। কিন্তু বাকিগুলো?
এদের জন্য রয়েছে আরেক জোড়া অঙ্গ। নাম কিডনি। বহু কাজের কাজী এই কিডনি দুটি সারাক্ষণ নানা কাজ করার পাশাপাশি রক্তকে পরিষ্কার করার কাজ করে চলেছে অনবরত। ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, বিভিন্ন ওষুধের অবশেষসহ আরো হাজারো বর্জ্য পদার্থ প্রতি মুহূর্তে ফিল্টার করে বের করে দিচ্ছে এই কিডনি। আমাদের দেহের ফিল্টার এই অঙ্গ জোড়া। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক এই কিডনি সম্পর্কে।
আমাদের দেহে একজোড়া কিডনি রয়েছে। দেখতে শিমের বিচির মতো এই কিডনি দুটি আমাদের শরীরের দু’পাশে পেছন দিকে কোমরের ঠিক উপরে ঝুলছে। দুটি কিডনির মাথায় দুটি এড্রেনাল গ্রন্থি টুপির মতো লেগে থাকে। এদের কাজ হরমোন উৎপাদন করা। প্রতিটি কিডনি প্রায় ১১ সেন্টিমিটার লম্বা। বাংলায় কিডনি শব্দটির প্রতিশব্দ বৃক্ক। কিন্তু ইংরেজি শব্দটিই বহুল পরিচিতি পেয়েছে। তাই এই লেখায় আমরা সবার সুবিধার্থে কিডনি শব্দটিই ব্যবহার করছি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিডনি অঙ্গটি বোঝাতে অনেক সময় Renal কথাটি ব্যবহৃত হয়। এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ rēn(ēs) থেকে। মধ্যযুগে এবং রেনেসাঁকালীন সময়ে ইউরোপে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অঙ্গসংস্থান বা এনাটমি জানা জরুরি ছিল। বিভিন্ন অসুখের কারণ, লক্ষণ ইত্যাদি বিচার করার জন্য তারা মূত্র সংগ্রহ করতেন। কিন্তু তারপরেও কোনো কারণে কিডনিকে তারা অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি কখনোই। এর পেছনে হয়ত একটি কারণ থাকতে পারে। অন্যান্য অঙ্গ যেখানে সহজেই দৃশ্যমান, সেখানে কিডনি দুটি পেরিটোনিয়াম নামক একটি পর্দার পেছনের ঢাকা থাকে।
এরিস্টটলের দুটি রচনায় কিডনির উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমটির নাম Historia Animalium এবং দ্বিতীয়টির নাম De Partibus Animalium। তিনি অবশ্য কিডনিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তবে কিডনির মৌলিক কাজ, কিডনি যে রক্ত থেকে প্রস্রাব তৈরি করে, তা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। এরপরে কিডনি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন বিজ্ঞানী গ্যালেন। পরবর্তীতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অপেক্ষাকৃত সঠিকভাবে অন্যান্য উদরীয় অঙ্গের সাথে কিডনির চিত্র অংকন করেন।
কিডনি নিয়ে সত্যিকার অর্থে মৌলিক কাজ করেন বিজ্ঞানী আন্দ্রে ভিসালিয়াস। তার রচিত De Humani Corporis Fabrica গ্রন্থে কিডনি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসুর পরিচয় দেন। এভাবেই ধীরে ধীরে কিডনি রহস্য মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়।
যেহেতু কিডনির কাজ রক্তকে ছাঁকন করা, তাই শরীরের সবচেয়ে বড় ধমনী এবডোমিনাল আর্টারির সাথে রেনাল আর্টারি নামে দুটি শাখা ধমনী দিয়ে সরাসরি যুক্ত।
কিডনি দুটি অংশে গঠিত- রেনাল কর্টেক্স এবং রেনাল মেডুলা। কিডনির গঠনগত একক হলো নেফ্রন। প্রতিটি নেফ্রনে স্বয়ংসম্পুর্ণভাবে রক্তের পরিশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। একটি নেফ্রনে চারটি প্রক্রিয়া চলতে থাকে- ছাঁকন, শোষণ, ক্ষরণ এবং নিঃসরণ। এর মাধ্যমেই শরীরে রক্তের পরিমাণ, ইলেকট্রোলাইট সাম্যতা, অম্ল ও ক্ষারের সাম্যতা, রক্তের ঘনত্ব এবং বিষাক্ত পদার্থ পৃথকীকরণ সম্পন্ন হয়। এ প্রক্রিয়াগুলোর শেষে এখান থেকে যে বর্জ্য পদার্থ বের হয়, তা সংগ্রাহক নালিকার মাধ্যমে গৃহীত হয়ে চূড়ান্তভাবে মূত্রাশয়ে জমা হয়। এই ছাঁকন প্রক্রিয়া এত দ্রুত সম্পন্ন হয় যে, প্রতি ঘণ্টায় বলতে গেলে আমাদের দেহের সমস্ত রক্ত নতুন হয়ে যায়, অর্থাৎ ছাঁকন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ রক্তই দেহের রক্তনালীগুলোতে ফেরত যায়। মাত্র একভাগ রক্ত প্রস্রাব হিসেবে মূত্রাশয়ে জমা হয়।
প্রতিটি কিডনিতে প্রায় দশ লক্ষ নেফ্রন থাকে। আমাদের শরীরে দুটি কিডনি থাকে। আসলে এটি শরীরের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ দেখা গেছে যে, শরীরে একটি কিডনিই সমস্ত পরিশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট। এমনকি এই একটি কিডনির যদি শুধুমাত্র অর্ধেক সুস্থ থাকে, তাহলেও সেটুকুই কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এজন্য অনেক মানুষের শরীরে জন্মগতভাবে একটিমাত্র কিডনি থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে কখনো জানতেই পারে না যে তার শরীরে একটি কিডনি আছে। অন্য রোগ নির্ণয়ের সময় কিংবা বিভিন্ন কারণে যখন পেটের এক্সরে বা আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়, তখনই জানা যায় এ ঘটনা।
বর্তমানে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সঠিকভাবে সচেতন উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন পদ্ধতি মেনে চললে কিডনির রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। কিডনি দু’ধাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাময়িক এবং স্থায়ী। যদি হঠাৎ কিডনিতে রক্তপ্রবাহ কমে যায়, তাহলে সাময়িক সমস্যার উদ্ভব হয়। ডায়রিয়া কিংবা পানিশূন্যতায় এমনটি ঘটে। সংক্রামক রোগ, যেমন টাইফয়েড কিংবা ডেঙ্গু রোগের প্রভাব কিডনির উপরে পড়তে পারে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেলে কিডনিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
কিডনির অন্য সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি মূলত এসব সমস্যার পেছনে দায়ী। একে বলে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। এর চূড়ান্ত পর্যায় হলো ‘এন্ড স্টেজ কিডনি ডিজিজ’। এ পর্যায়ে গেলে কিডনি ডায়ালাইসিস কিংবা নতুন কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না, যা বেশ ব্যয়বহুল। সুতরাং আমাদের হাতে একমাত্র সম্ভাব্য উপায়, কিডনি রোগকে প্রতিহত করা। সচেতনতার মাধ্যমে যা খুব ভালোভাবেই সম্ভব। তাছাড়া আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, আপনার কিডনিতে কোনোরকম সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা।
যেহেতু কিডনির কাজের সাথে মূত্র তৈরি সরাসরি যুক্ত, সুতরাং কিডনিতে কোনো সমস্যা হলে তা মূত্রকে প্রভাবিত করবে। হঠাৎ করে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে বা কমে যেতে পারে। এছাড়া প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তবে প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন হলেই ছোটাছুটি করার দরকার নেই। কারণ বহু কারণে প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তিত হত পারে। যা-ই হোক, কিডনিতে সমস্যা হওয়ার আগে মূত্রনালিতে সংক্রমণ হতে পারে, যা আস্তে আস্তে কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে। মূত্রনালিতে সংক্রমণ হলে প্রস্রাবের সাথে জ্বালাপোড়া এবং ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে।
কিডনি সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো দেহে পানি জমে যাওয়া। ফলে দেহের বিভিন্ন জায়গা ফুলে ওঠে। আপনার গোড়ালিতে ত্রিশ সেকেন্ড চেপে ধরুন বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে, তারপর ছেড়ে দিন। যদি জায়গাটি বসে গিয়ে থাকে, তাহলে বুঝবেন আপনার দেহে পানি জমেছে। এটাও হতে পারে কিডনি সমস্যার সতর্ক সংকেত।
অতিরিক্ত লবণ খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষত কিডনির উপর এটি সরাসরি প্রভাব ফেলে। রক্তের খনিজ পদার্থের সাম্যতা এটি নষ্ট করে দেয়। তাই পাতে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পক্ষান্তরে বিষ খাওয়ারই নামান্তর!
অন্যদিকে উচ্চ রক্তচাপ কিডনির জন্য মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। সুতরাং আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আপনার যদি প্রচণ্ড ব্যস্ত দিন কাটে, তাহলে অন্তত হাঁটুন।
যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের কিডনির ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত! কারণ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটি জটিলটার নাম ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি, যা কিডনির নেফ্রনকে আক্রান্ত করে। তাই আপনার রক্তের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ রাখুন, নিজের শরীরকে মুক্ত রাখুন বহুবিধ সমস্যা থেকে।
কিডনি যেহেতু সরাসরি রক্ত ফিল্টার করে দূষিত পদার্থ বের করার কাজে নিযুক্ত, তাই পানিশূন্যতা মানেই কিডনির কাজে ব্যাঘাত। পানিশূন্যতা দেখা দিলে সরাসরি তা কিডনির ফিলট্রেশন হারকে প্রভাবিত করে। ফলে আমাদের শরীর থেকে ইউরিয়া, ইউরিক এসিড এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারে না, যা হয়তো পরবর্তীতে জন্ম দিতে পারে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ।
এসব থেকে আপনি দূরে থাকবেন, যদি আপনি ঠিকঠাক দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পানিটুকু পান করেন। যদিও আমাদের ঠিক কতটুকু পানি পান করতে হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবুও রোজ অন্তত ২-৩.৫ লিটার পানি পান করুন। পাশাপাশি হাতের সিগারেটটিও ফেলে দিতে হবে। কারণ এটি আপনার রক্ত চলাচলকে কমিয়ে দেয়। ফলে যথেষ্ট পানি পান করা সত্ত্বেও আপনার কোনো লাভ হচ্ছে না।
মোদ্দাকথা, কিডনি সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যকর জীবনধারনের কোনো বিকল্প নেই। আপনি একটি সুস্থ, আনন্দময় জীবনযাপন করতে চাইলে অবশ্যই আপনার দেহের ফিল্টার দুটিকে সচল রাখতে হবে। আর সেজন্য আপনাকে মেনে চলতে হবে ন্যুনতম স্বাস্থ্যবিধি।
Feature Image: Hospital San José de Querétaro (Enseñanza)