X (ছদ্মনাম) যেদিন এই পৃথিবীতে এলো, সেদিন ওর বাবা-মাসহ পুরো পরিবারেই বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। বিয়ের অাট বছর পরে সংসারে নতুন অতিথির অাগমন, এ কী কোনো চাট্টিখানি কথা! তবে এই মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ দেখে বিধাতা হয়তো অলক্ষ্যে মুচকি হাসি হাসলেন।
X এর বয়স যখন অাট মাস তখন থেকেই ওর অাচরণে নানা অস্বাভাবিকতা নজরে পড়তে শুরু করলো। বৈদুত্যিক বাল্বের দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে থাকা, খেলনা দেখে ভয় পাওয়া, খাবার খাওয়ার সময় অাশপাশের মানুষের গায়ে ছিটিয়ে দেয়া, দেরিতে কথা বলতে শেখা- এসব অদ্ভুত অাচরণ দেখা যেতে লাগলো তার মাঝে।
দিনে দিনে এমন অবস্থা দাড়ালো যে, X কে কেউ ডাকলেও সে কোনো সাড়া দেয় না। একাকী নিজের সাথেই কথা বলে, অকারণে হাসে, মুখ দিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে। অসংলগ্ন এ অাচরণে পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো। মা-বাবার ক্রমাগত চোখের জল কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যত্নঅাত্তি, সবকিছুই X কে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে ব্যর্থ হলো।
X এর বাবা-মা বুঝতে পারলেন, এবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সন্তানকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন চিকিৎসকের চেম্বারে। কতগুলো টেস্ট অার চেকঅাপের পর চিকিৎসক জানালেন, X একটি ব্যাধিতে ভুগছে, যার নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার।
ASD কী?
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) একটি নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটির কারণে এই সমস্যাটি দেখা দেয়, যা ব্যক্তির সামাজিক, যোগাযোগগত ও আচরণগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। একে সংক্ষেপে অনেকে অটিজম নামেও অভিহিত করে থাকেন।
ASD-তে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। এর কারণে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার উপর দক্ষতা কম থাকে। সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যেই এ রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়।
বিশ্বের সব জায়গায় জাতিগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক পটভূমি নির্বিশেষে ASD এর প্রকোপ পরিলক্ষিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার পরিবেশ দূষণ ASD-তে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
ইতিহাস
ইংরেজী শব্দ Autism এর উৎপত্তি গ্রিক শব্দ αυτος (আউতোস) থেকে, যার অর্থ অাত্ম বা নিজ। এর বাংলা পারিভাষিক প্রতিশব্দ হলো অাত্মসংবৃত্তি। সুইজারল্যান্ডের চিকিৎসাবিদ অয়গেন ব্লয়লার (Eugen Bleuler) ১৯১১ সালে American Journal of Insanity তে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে Autism শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।
তবে ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোরে অবস্থিত জন হপকিন্স হাসপাতালের মনোবিদ ড. লিও ক্যানার সর্বপ্রথম ১১টি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত শিশুর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি এ ব্যাধির নাম দেন ‘Early infantile autism’। তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন ASD-তে অাক্রান্ত শিশুরা অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়ে তার প্রথম প্রবন্ধ The Nervous Child নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
প্রায় একই সময়ে অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী ড. হ্যান্স অ্যাসপারগার একই ধরনের পর্যবেক্ষণ করেন। তবে তার পর্যবেক্ষণটি ছিলো ক্যানার থেকেও উচ্চতর। তিনি প্রথাগত অটিজম থেকে ভিন্নতর একটি ব্যধির অস্তিত্ব অাবিষ্কার করেন, যার নাম Asperger’s syndrome। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতে অনূদিত না হওয়ার কারণে তার পর্যবেক্ষণগুলো অনেকদিন কোনো স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৯৭ সালে তার প্রবন্ধগুলো স্বীকৃতি পায় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
২০১৩ সালে অটিজম এবং Asperger’s syndrome কে একীভূত করা হয় এবং রোগটি ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ নামে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাস এর ৫ম সংস্করণে (DSM-V) স্থান পায়।
কারণ
ASD এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার উপর নির্ভর করে কারণগুলোর ভিন্নতা দেখা যায়। এগুলো হলো-
জিনগত সমস্যা: বিভিন্ন জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে একজন ব্যক্তি ASD-তে অাক্রান্ত হতে পারেন। জেনেটিক ডিসঅর্ডার, যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে। কিছু জিন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে।
বিভিন্ন সংক্রমণ: রোগজীবাণুর সংক্রমণ, ভাইরাল ইনফেকশন এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
শারীরবৃত্তীয় সমস্যা: মস্তিষ্কের সেরোটোনিন বা অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটার অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে ASD হতে পারে। এছাড়াও ভ্রুণ বৃদ্ধির প্রারম্ভিক অবস্থায় মস্তিস্কের গঠনের অস্বাভাবিকতার জন্য মস্তিস্কের কোষগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ফলে নবজাতকের ASD-তে অাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অন্যান্য কারণ: লিঙ্গ ASD রোগের সংক্রমণে ভূমিকা রাখে। নারীদের তুলনায় পুরুষদের ASD-তে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ৪ গুণ বেশি। এছাড়াও পরিবারে কারও অটিজম থাকলে শিশুর ASD-তে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অাবার বেশি বয়সে সন্তানধারণ ও গর্ভকালীন জটিলতা থাকলে সন্তানের ASD-তে অাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
উপসর্গ
ASD এর উপসর্গসমূহ একেক শিশুর ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। কিন্তু সাধারণভাবে এদেরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
• খুব কম সময়ের জন্য অন্যের চোখে চোখ রাখতে পারা।
• আশেপাশে উপস্থিত লোকদের কথা শুনতে অনাগ্রহ বোধ এবং অন্যের কথার সাড়া না দেয়া।
• পছন্দের জিনিস আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করবার অক্ষমতা।
• অন্যরা রাগ, দুঃখ বা স্নেহ প্রদর্শন করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
২. যোগাযোগ বৈকল্য
• খুব ধীরে ও দেরিতে শব্দ উচ্চারণ করতে শেখা।
• প্রথম বছরে শিশু সুলভ আওয়াজ করলেও পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
• একটি শব্দ বা বাক্যের অংশ বার বার বলা, অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া।
• একটি শব্দ বা বাক্য শুনে তা হুবহু বলা। একে ইকোলালিয়া (echolalia) বলে।
• অপরিচিত ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহার করা, যা কেবল অন্য রোগীই বুঝতে পারে।
৩. পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ
• একই ধরনের কাজ বারবার করা। একে ‘স্টেরিওটাইপ’ আচরণ বলে।
• কোনো বিশেষ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ বা আসক্তি অনুভব করা।
• চলমান কোনো বস্তু দেখে উত্তেজিত বা আকর্ষিত হওয়া। যেমন- চলন্ত গাড়ির চাকা।
• অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করা। যেমন- হাত ঝাপটানো, আঙ্গুল নাড়ানো, মুখ বিকৃতি করা ইত্যাদি।
এছাড়াও কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখে ASD শনাক্ত করা হয়। এগুলো হলো-
• সৃজনশীল বা কল্পনানির্ভর খেলায় অংশগ্রহণ করতে না পারা।
• নতুন পরিবেশে মনে চরম উত্তেজনা বা হতাশার উদ্রেক ঘটা।
• আক্রমণাত্মক/ধ্বংসাত্মক আচরণ প্রদর্শন (অল্প কয়েকজনের মধ্যে দেখা যায়)।
• অদ্ভুত ধরনের ভয় বা আতঙ্ক অনুভব করা। যেমন- টিভিতে কোনো বিশেষ দৃশ্য দেখে ভয় পাওয়া।
• নিজের শরীরকে আঘাত করার প্রবণতা, যেমন- নিজের হাত কামড়ানো, মাথা ঠোকা।
• ঘুমের ব্যাপারে বিশেষ অনিয়ম প্রদর্শন।
রোগ নির্ণয়
মূলত দুই ধাপে এ রোগটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
প্রথম ধাপে চিকিৎসক শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। যে সকল শিশুর বিকাশগত সমস্যা শনাক্ত হয় তাদেরকে উচ্চতর পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
দ্বিতীয় ধাপে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাদারদের সমন্বয়ে একটি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। এই পর্যায়ে শিশুর অটিজম বা অন্য কোনো বিকাশজনিত সমস্যা আছে কি না তা নির্ণয় করা যায়। দুই বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার নির্ভরযোগ্যভাবে নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
১. আচরণগত প্রক্রিয়া
• অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস (এবিএ): এই পদ্ধতি রোগীর আচরণগত সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলো-
ক) ডিসক্রিট ট্রায়াল ট্রেনিং (ডিটিটি): এই পদ্ধতির সাহায্যে শিশুদের প্রাথমিক জটিলতা দূর করার চেষ্টা হয়। সঠিক আচরণ এবং উত্তর পাওয়ার জন্য ইতিবাচক প্রয়োগ ও আনুষঙ্গিক নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর সাহায্যে বাচ্চাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত আচরণ বা দক্ষতা, যতক্ষণ না তারা তা শিখতে পারছে, সেটা শেখানোর প্রচেষ্টা করা হয়।
খ) আর্লি ইন্টেনসিভ বিহেভিয়ারাল ইন্টারভেনশন (ইআইবিআই): এই ধরনের এবিএর লক্ষ্য থাকে অটিস্টিক বাচ্চাদের বিশেষ ধরনের আচরণগত সমস্যার সমাধান করা। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
গ) পিভটাল রেসপন্স ট্রেনিং (পিআরটি): এই পদ্ধতিতে বিকাশের চারটি প্রধান অঞ্চলকে লক্ষ্য হিসেবে ধার্য করা হয়- মোটিভেশন বা উদ্দেশ্যগত দিক, আত্ম-পরিচালন ক্ষমতা, আত্ম-উদ্যোগ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। এই চিকিৎসায় রোগীকে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়।
২. গঠনগত প্রক্রিয়া
• অকুপেশনাল থেরাপি: এই থেরাপির সাহায্যে রোগীকে বিভিন্ন কৌশল শেখানো হয়, যার সাহায্যে সে ঠিকঠাকভাবে দৈনন্দিন জীবনযাপন করতে পারে। এই প্রক্রিয়া গ্রস মোটর দক্ষতা এবং ফাইন মোটর দক্ষতাকে শক্তিশালী করে।
• স্পিচ থেরাপি: এই থেরাপি রোগীর যোগাযোগের ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর চিন্তাভাবনা অন্যের কাছে প্রকাশ করার বিকল্প কৌশল শেখানো হয়। এটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইন্টারভেনশন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কেননা ASD আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে দুর্বলতা দেখা যায়।
• সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি: দেখা, শোনা বা গন্ধ শোঁকার মতো অনুভূতির ক্ষেত্রে এই থেরাপি সাহায্য করে। রোগী যে বস্তুর শব্দ বা স্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়, সেই বস্তুকে চেনার ক্ষেত্রে সাহায্য করে এই থেরাপি। এর ফলে রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কমে ও সামাজিক দক্ষতা বেড়ে যায়।
৩. অন্যান্য প্রক্রিয়া
• মিউজিক থেরাপি: মিউজিক থেরাপি রোগীর সামাজিক ও যোগাযোগের দক্ষতার উন্নতিতে সাহায্য করে।
• পিকচার এক্সচেঞ্জ কমিউনিকেশন সিস্টেম (পিইসিএস): যাদের যোগাযোগের ক্ষমতা খুবই কম বা একেবারেই নেই, তাদের ওপর এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে ছবি বা প্রতিলিপি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফিচার ইমেজ- sayidaty.net