‘অ্যাঁ! বলেন কী! আপনার পানিতে অ্যালার্জি?’
পানির অপর নাম? ঠিক ভেবেছেন- জীবন। বাঁচার জন্য প্রত্যেকটা প্রাণীই পানির উপর নির্ভরশীল। মানুষের দেহের শতকরা ৭০ ভাগই পানি দিয়ে গঠিত। দিনে কম-বেশি আড়াই লিটার পানির প্রয়োজন হয় আমাদের, যার অনেকটাই খাবার থেকে পেয়ে যায় দেহ। বাঁচতে হলে পানিকে আপনার ব্যবহার করতেই হবে।
ধরুন, আপনার পরিচিত এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছেন। বৃষ্টির দিন, খুব বৃষ্টি হচ্ছে; প্রচণ্ড গরমের পর ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়া কার না ভাল লাগে? আপনি ভিজতে চান, কিন্তু আপনার সঙ্গীর উসখুসানি প্রতি মুহূর্তে বেড়েই চলছে। তিনি থাকতে চান না বাইরে, মাথার ওপর কিছু একটা চাইছেন। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সমস্যা কী আপনার?’ জবাব পেলেন, ‘আমার পানিতে অ্যালার্জি আছে!’
সেই মুহূর্তে সম্ভবত মাথায় বাজ পড়লেও এর চাইতে বেশি অবাক হতেন না। মুখ দিয়ে যদি তাই বেরিয়ে আসে, ‘অ্যাঁ! বলেন কী! আপনার পানিতে অ্যালার্জি?’ তাহলে সম্ভবত দোষও দেওয়া যায় না আপনাকে।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, এমন রোগ সত্যিই আছে। রোগের নাম- অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়া (Aquagenic urticaria)। অত্যন্ত বিরল এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এখন পর্যন্ত একশোরও কম। সেটাও সারা বিশ্বে! বিশ্বাস না হতে চাইলেও, মেডিকেল জার্নালগুলো এই রোগের স্বীকৃতি দিয়েছে। আক্রান্ত রোগী পানির প্রতি অ্যালার্জিক, এমনকি নিজের কান্না বা ঘামের প্রতিও। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই রোগের উপসর্গ দেখা যায় দেহে, তবে একদম কম বয়সে আক্রান্ত হবার নজিরও আছে।
এটি আসলে কী?
এক কথায় বলতে গেলে, অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়া আসলে একধরনের অ্যালার্জি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক যখন পানির সংস্পর্শে আসে, তখন খুব দ্রুত তার দেহে রক্তস্ফোট বা লাল-লাল বিন্দু দেখা যায়। পানির তাপমাত্রা এই রক্তস্ফোট সৃষ্টিতে কোনো প্রভাব রাখে না। সাধারণত মেয়েরাই বেশি আক্রান্ত হয়। উপসর্গগুলো দেখা যায় বয়ঃসন্ধিকাল অথবা যৌবনের শেষ দিকে। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই জানান- রক্তস্ফোট উঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা শরীরে চুলকানিও বোধ করেন।
আবিষ্কার
এর কথা প্রথম বর্ণনা করেন শেলী এবং রনসলি, ১৯৬৪ সনে। রোগটি এতই বিরল যে এখন পর্যন্ত শ’ খানেকেরও কম রোগীর খোঁজ পাওয়া গেছে। ১৯৬৩ সালে এক পনেরো বছর বয়সী কিশোরী পানিতে স্কি করার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার দেহে প্রথমে দেখা যায় রক্তস্ফোট এবং পরবর্তীতে ক্ষত।
কারণ
রোগীর স্বল্পতার কারণে এই রোগের কারণ, প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুব একটা গবেষণা করা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই, এই রোগের প্রকৃত কারণ আজও অজানাই রয়ে গেছে। তবে কারো কারো মতে, পানিতে যোগ করা ক্লোরিনই এর কারণ। কেউ কেউ আবার খোদ পানিকেই এই অ্যালার্জির কারণ বলে উল্লেখ করে থাকেন।
সাধারণত রোগটা অনেক ছাড়া-ছাড়া ভাবে হয়ে থাকে। অর্থাৎ একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মাঝে অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়ার উপস্থিতি সাধারণত লক্ষ্য করা যায় না। তবে কয়েকটা ক্ষেত্রে দেখাও গিয়েছে। একটা বিশেষ পরিবারে একাধিক সদস্য এই রোগে আক্রান্ত। তবে সঙ্গে আরও একটা জেনেটিক রোগ আছে তাদের। বার্নার্ড-সলিয়ের সিন্ড্রোম। এটি শরীরে রক্ত-তঞ্চন জনিত সমস্যার জন্ম দেয়। তাই অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়ার সঙ্গে যে বংশগত বৈশিষ্ট্যের কোনো সম্পর্ক নেই- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
উপসর্গ
উপসর্গগুলো মূলত ত্বক-সম্পর্কিত, বিশেষ করে প্রাথমিক উপসর্গগুলো। প্রথমেই ত্বকে রক্তস্ফোট জন্ম নেয়, সেই সঙ্গে চুলকানি এবং ব্যথা তো আছেই। ঘাড়, হাত এবং বুকের উপরের দিকেই মূলত ফুটে উঠে লাল-লাল রক্তস্ফোটগুলো। তবে শরীরের যেকোন অংশেই ওগুলো দেখা যেতে পারে। পানির সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার মিনিটখানেকের মাঝেই আর যে-যে উপসর্গ দেখা যেতে পারে,
- ত্বক লাল হয়ে যাওয়া
- জ্বলা-পোড়ার অনুভূতি
- ক্ষত
- ফুলে ওঠা
- প্রদাহ
অনেকক্ষেত্রেই, এই রোগে আক্রান্ত রোগীর উপসর্গ প্রথম দেখা দেয় পানি পান করার পর। যা হলো:
- মুখের চারপাশে লাল দাগ
- গিলতে সমস্যা
- শ্বাসকষ্ট
- শ্বাসের সঙ্গে শোঁশোঁ শব্দ হওয়া
তবে সাধারণত শরীর থেকে পানি মুছে ফেললে, অথবা পানি থেকে দূরে সরে গেলে, আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মাঝে সব উপসর্গ দূর হয়ে যায়।
যে-যে কাজ করলে দেখা যেতে পারে উপসর্গ:
- গোসল
- বৃষ্টিতে ভেজা
- সাঁতার
- শরীরে পানি ঢালা
- ঘাম
- কান্না
চিকিৎসা
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি- এখন পর্যন্ত অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়ার কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। তবে উপসর্গগুলো দূর করার জন্য নানা ওষুধের সাহায্য নেওয়া হয়। যেমন:
অ্যান্টি-হিস্টামিন: যেকোনো ধরনের অ্যালার্জির জন্য অ্যান্টি-হিস্টামিনের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রেও তা-ই।
পেট্রোলিয়াম-সমৃদ্ধ ক্রিম: এই ক্রিমগুলো ত্বক এবং পানির মাঝে একধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে। গোসল করার আগে, কিংবা পানির সংস্পর্শে আসতে হতে পারে এমন যেকোনো কাজ করার আগে ক্রিম ব্যবহার করলে উপসর্গ দেখা দেবার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।
এপিপেন: উপসর্গ অত্যন্ত প্রবল হলে রোগীর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে দরকার হয় এপিনেফ্রিন বা অ্যাড্রেনালিনের। এপিপেন-এ থাকে সেই জীবনদায়ী ওষুধ।
ফটো-থেরাপি: কিছু কিছু কেসে, আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মির ব্যবহারে রোগীদের উপসর্গ কমে গিয়েছে বলে জানা যায়।
ওমালিযুমাব: বিশেষ এই ওষুধটি হাঁপানিতে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে। বেশ কিছু অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়ার রোগীর ক্ষেত্রেও উপশম এনে দিয়েছে।
তবে অনেকক্ষেত্রেই, কোনো ধরনের ওষুধেই রোগীর উপসর্গের উপশম হয় না। এদের ক্ষেত্রে পানির সঙ্গে সংস্পর্শ থেকে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
যা যা করা যাবে না
প্রথমেই রয়েছে- পানি একদম স্পর্শ না করা। কিন্তু তা কি আর সবসময় সম্ভব? তাই যতটা পারা যায়, দূরে থাকতে হবে পানির কাছ থেকে। কেননা মাত্র কয়েক মিনিট পানির স্পর্শে থাকাই তার জন্য হয়ে দাঁড়াতে পারে প্রাণঘাতী। এই যেমন আইভির কথা ধরা যাক। ১৮ মাস বয়সী আইভি অ্যাকারম্যানকে মাত্র পনেরো সেকেন্ড পানিতে রাখলেই তার দেহের এখানে-সেখানে দেখা যায় রক্তস্ফোট।
পানিতে অ্যালার্জি নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক রোগীই সপ্তাহে একবার বা দুইবার, দশ-বারো মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে ফেলেন। অধিকাংশের ক্ষেত্রে পানি পানে সমস্যা না হলেও, যাদের হয় তাদেরকে পানি ছাড়াই বেঁচে থাকতে হয়। এজন্য অনেকে কেবল কোমল পানীয়ও পান করে থাকেন। খাদ্যাভ্যাসেও আনতে হয় আমূল পরিবর্তন।
শেষ কথা
বিগত একশো বছরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসেছে অভূতপূর্ব উন্নতি। অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাই এখন হাতের নাগালে। আবার সেই সঙ্গে মাথা-চাড়া দিয়ে উঠছে নতুন-নতুন অনেক রোগ। এগুলোর অনেকগুলোই আগেও ছিল, তবে মানুষ তার সীমিত জ্ঞানের কারণে ধরতে পারেনি, এই যা।
অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়া বা ওয়াটার অ্যালার্জি বা পানিতে অ্যালার্জি দারুণ বিরল একটি রোগ। বিরল হওয়ায় এই নিয়ে গবেষণা যেমন হয়েছে কম, তেমনি সুযোগও খুব একটা আসেনি। তারপরেও আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এর সফল একটি চিকিৎসা প্রণালী আমরা পাব। অবশ্য ২০১৬ সালে ওমালিযুমাব ব্যবহার করে অ্যাকুয়াজেনিক আর্টিকারিয়ার এক রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে বলে দাবী করছেন রোরি এবং জিরের নামক দুই বিজ্ঞানী। এই বিষয়ে আরও গবেষণাই আমাদেরকে জানিয়ে দেবে- রোগটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময়-যোগ্য কিনা।