বর্তমানে কর্মব্যস্ত জীবনে আমরা হাঁটাহাঁটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি প্রায়শই পাশ কাটিয়ে যাই। দৈনন্দিন জীবনে হাঁটার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা কম বেশি সকলেই জানি। তা সত্ত্বেও কিছুটা আলসেমি এবং কষ্টের ভয়ে আমরা হাঁটাহাঁটিকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চাই। অনেকে আবার রিকশায় না উঠে হাঁটাকে অপমান বা লজ্জাজনকও মনে করে থাকেন। তবে অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিকেই বর্তমানে দেখা যায় নিয়ম করে ভোরবেলা বা বিকালের কিছুটা সময় হাঁটার অভ্যাস ধরে রাখেন। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করার গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা যদি সঠিকভাবে জানতাম, তাহলে হয়তো এটি সকলের অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠতো।
স্থূল স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ
অনেকেই আজকাল মোটা হওয়ার জন্যে অতিরিক্ত খাওয়াকে দায়ী করে থাকেন। আর এর প্রতিকার হিসেবে প্রথমেই খাওয়া কমিয়ে দেন। তবে এটি খুব কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নয় তা বলাই বাহুল্য। কারণ আমাদের শরীরের মেটাবলিজমের কারণে শরীরের ঘাটতি পূরণ করার জন্যে নির্দিষ্ট সময় পর ঠিকই খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর খাওয়া কমিয়ে স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, আমরা খাওয়ার সাথে যে ক্যালোরি গ্রহণ করছি তার সমান বা বেশি যেন আমাদের শরীর থেকে ক্ষয় করতে পারি। এই কাজটি করতে হাঁটাহাঁটি একটি উত্তম উপায়।
যাদের নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস নেই তাদের জন্যে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস রাখেন তবে ভালো পরিমাণে ক্যালরি শরীর থেকে ক্ষয় হতে বাধ্য। তবে খেয়াল রাখতে হবে পায়চারি করা বা ধীরে ধীরে হাঁটা কিন্তু এই নিয়মের মধ্যে পড়বে না। হাঁটতে হবে খুব দ্রুত যাতে শরীর থেকে ঘাম ঝরে যায়।
হজমে সাহায্য করা
খাওয়ার পরে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলে নিজেকে বেশ হালকা লাগে এবং খাবার খুব সহজেই হজম হয়ে যায়। এছাড়াও নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস থাকলে ক্ষুধাজনিত সমস্যা দূর হয়ে যায়। হাঁটার ফলে খাবার হজম হয়ে গিয়ে পুনরায় ক্ষুধার সৃষ্টি করে যা শরীরের মেটাবলিজমের অনুপাত ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে
অতিরিক্ত রক্তচাপ বর্তমান সময়ে খুব পরিচিত একটি নাম। কমবেশি অনেককেই বর্তমানে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে খাদ্যাভাসের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অতিরিক্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন। আর বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে অফিসে বা বাসায় টানা বেশীক্ষণ চেয়ারে বসে থাকা না হয়। কিছু সময় পর পর চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু পায়চারি করা বা হাত-পা নড়াচড়ার অভ্যাস রাখা খুব প্রয়োজন।
মানসিক চাপ কমাতে
ঘরে-বাইরে আমাদের সবসময় একধরনের মানসিক চাপে থাকতে হয়। আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানসিক চাপকে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। চাকরির চাপ, সংসারের চাপ, রাস্তায় ট্রাফিকের চাপ এসব তো নিত্যদিন লেগেই রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁটার অভ্যাস থাকলে কিছুটা হলেও এই চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
হাঁটার সময় আমাদের মন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারে। এতে করে মন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে না। আর খোলামেলা উদ্যানে ভোরের আলোতে হাঁটতে পারলে মনে একধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আর এই অভ্যাস পুরো দিনের কাজের জন্যে উৎসাহ বাড়াতে বেশ সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস রাখতে পারলে আমাদের শরীরের সকল কোষ সচল থাকে। ফলে প্রত্যেকটি কোষে বিশুদ্ধ রক্ত ও অক্সিজেন সঠিকভাবে পোঁছতে পারে। তাই নিয়মিত হাঁটার ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
ঘুমের সমস্যা সমাধানে
যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে অর্থাৎ যাদের খুব সহজে গভীর ঘুম হয় না তাদের জন্যে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস বেশ ফলদায়ক। নির্দিষ্ট সময় ধরে হাঁটার ফলে শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় এবং শরীরে ক্লান্তিবোধ হয়। এর ফলে শরীর অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চায়। এছাড়াও যাদের ইনসমনিয়া রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও ওষুধের পাশাপাশি হাঁটাহাঁটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
হাড় মজবুত করে
শরীরের হাড় মজবুত করতে সুষম খাদ্যের পাশাপাশি আমাদের ছোটবেলা থেকেই হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো, দড়িলাফ ইত্যাদি নিয়মিত অনুশীলন করা উচিত। এতে করে আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ছোটবেলা থেকেই বেশ দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে। বয়সের সাথে সাথে অন্যান্য ব্যায়ামগুলো করা সম্ভব না হলেও সকলের হাঁটাহাঁটির অভ্যাসটি নিয়ম করে পালন করা উচিত। এর ফলে শরীর হাড়গুলো আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ডায়াবেটিস রোগের নিয়ন্ত্রণে হাঁটার গুরুত্ব আজ আর কারো কাছে অজানা নয়। শরীরের ইনসুলিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অন্যতম পথ্য হিসেবে কাজ করে। তবে শরীরে ডায়াবেটিস দেখা দেয়ার আগে থেকেই যদি নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস রাখা যায় তবে জন্মগতভাবে ডায়াবেটিস শরীরে থাকলেও তা প্রথম থেকেই অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকে।
পেশীর ব্যথা কমাতে
বেশি বয়সে হঠাৎ করে শারীরিক ব্যায়াম করতে গেলে আমাদের শরীরের পেশীতে অনেকসময় ব্যথা অনুভব হয়, যার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করা সম্ভব হয় না। তাই যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে প্রশিক্ষকেরা কিছুদিন নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দেন। নিয়মিত হাঁটার ফলে শরীরের পেশীগুলো কিছুটা নমনীয় হয়ে আসে। এর ফলে ব্যায়াম করতে গেলে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয় না।
প্রফুল্ল মন
মনকে প্রফুল্ল রাখার ক্ষেত্রে হাঁটার অভ্যাস বেশ কার্যকর একটি অনুশীলন। ভোরে অথবা বিকেলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করা উচিত। এর ফলে শরীর নিজে থেকেই হাঁটার জন্যে অনেক বেশি উৎসাহ বোধ করবে। আর নিয়মিত হাঁটার ফলে মনের দুশ্চিন্তা কমে গিয়ে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্যেও হাঁটার সুফলতা রয়েছে। অনেক বেশি পড়া মাথায় চাপের সৃষ্টি করতে পারে। তাই অযথা মোবাইলে সময় নষ্ট না করে হাঁটার অভ্যাস করলে পড়ায় মনোনিবেশ করতে খুব কষ্ট হবে না।
সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে
সৃজনশীল ব্যক্তিদের জন্যে হাঁটাহাঁটি একটি খুব সহজ সমাধান। সৃজনশীল ব্যক্তিদের হাঁটাহাঁটি করে চিন্তা করা খুব পরিচিত একটি দৃশ্য। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁটাহাঁটি কার্যতই চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের সমাধান করতে বা নতুন কিছু তৈরি করার পরিকল্পনা করতেও হাঁটাহাঁটি বেশ উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান সমাজ অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়াতে মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন আমাদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসকল যন্ত্রের প্রতি আমরা অনেক বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছি যা আমাদের শরীরের জন্যে অসম্ভব ক্ষতিকর। সময় থাকতেই আমাদের প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের শরীর, মন, আত্মীয়স্বজন, সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব এসব দিকে বেশি নজর দেয়া উচিত। আর এসবের জন্যে প্রয়োজন সুস্বাস্থ্যের। আর শরীরকে যথাযথভাবে কর্মক্ষম রাখার জন্যে নিয়মিত হাঁটাহাঁটির কোনো বিকল্প নেই।
ফিচার ইমেজ- churchofchristarticles.com