দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট্ট দেশ জিম্বাবুয়ে। ১৯৮০ সালে দেশটি স্বাধীন হয়। তুলা, তামাক, স্বর্ণ, লৌহ আকরিক ও সুতো বা কাপড় নির্ভর অর্থনীতি নিয়ে এক সময় জিম্বাবুয়ে ছিল আফ্রিকার ধনী দেশগুলোর তালিকায়। কিন্তু সেসব সোনালী সুদিন অতীত হয়েছে বহুকাল আগেই। মাত্র ১ ডলারের কোনো জিনিস কিনতে বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে দোকানে যেতে হচ্ছে, ভাবতে পারেন? ২০০৮ সালে রেকর্ড ২৩১ মিলিয়ন শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের মুখে দাঁড়িয়ে অনেকটাই ভেঙে গেছে দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে দ্য রিজার্ভ ব্যাংক অভ জিম্বাবুয়ে একশো ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার নোট ছাপাতে বাধ্য হয়, যা কি না এখন পর্যন্ত ছাপা নোটে সর্বোচ্চ সংখ্যক শূন্য বসানো নোট হিসেবে ইতিহাসে প্রথম।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা। কিন্তু ৩,৯০,৭৫৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে মৌলিক চাহিদাগুলো পরিপূর্ণ হবার স্বপ্ন দেখাটাও অধিকাংশ মানুষের জন্য কঠিন। কেননা, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষই দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার। এর ফলে ২৭ শতাংশ শিশু বয়সের সাথে সাথে দৈহিক গড়নে স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ২০১৭ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, জিম্বাবুয়েতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ বেঁচে রয়েছে জীবিকা ও খাদ্যের অনিশ্চয়তায়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অভ মাইগ্রেশনের হিসাবে, খাদ্য নিরাপত্তা ও ভালো জীবন ব্যবস্থায় বেঁচে থাকার সুযোগের আশায় অন্তত কয়েক লক্ষ জিম্বাবুইয়ান অধিবাসী ইতোমধ্যেই অন্যান্য আফ্রিকান দেশে পাড়ি জমিয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এত অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরতার হারে শীর্ষ দেশগুলোর একটি জিম্বাবুয়ে। কিন্তু, খাদ্যের মতো চিকিৎসা খাতেও করুণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে দেশটির জনগণ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে ১৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ এইডসে আক্রান্ত হয়ে জীবনযাপন করছে। জিম্বাবুইয়ানদের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্কের দুটি নাম কলেরা ও ম্যালেরিয়া। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে ৭,৬০,০০০ জনেরও বেশি রোগী নথিভুক্ত হয়েছিল শুধুমাত্র এই দুটি রোগে। চিকিৎসাখাতে এই দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ চিকিৎসকের সংকট।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো দেশে মোট জনসংখ্যার প্রতি হাজারে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম ২.৩ জনের কম হলে, দেশটিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়েতে প্রতি এক হাজার মানুষে চিকিৎসকের ঘনত্ব ছিল মাত্র ০.৭৬৩। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ সংখ্যা কতটা অপ্রতুল, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন পড়বে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চিকিৎসকের ঘনত্ব ৫.২৬৮। ২০১৫ সালের সমীক্ষায় আফ্রিকার আরেকটি দেশ সুদানে জনসংখ্যার প্রতি হাজারে চিকিৎসকের ঘনত্ব ৪.১ ও আলজেরিয়ায় ১৮.৩। ২০১৭ সালের সমীক্ষাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যাটি ৯.১০১ ও লিবিয়ায় ২১.৫৮১। সৌদি আরব, ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানিতে যথাক্রমে ২৩.৯, ৩২.৩৪৯, ৪০.৬৯১ ও ৪২.০৮৭।
অর্থাৎ, জার্মানিতে প্রতি হাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে যেখানে রয়েছেন ৪২ জন, সেখানে জিম্বাবুয়েতে প্রতি ১৩১০ জন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে চিকিৎসা কর্মী রয়েছে মাত্র ১ জন! আর যে দেশে দেহের ডাক্তার খুঁজে পাওয়াই ভার, সে দেশে মনের ডাক্তার খোঁজা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু কি হতে পারে?
অর্থনীতির বেসামাল দশা, বেকারত্ব, এইচআইভিসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রকোপসহ নানান দুর্দশায় দেশটির একজন সাধারণ অধিবাসীর জন্য মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার সমাজে নিষ্ঠুর এ জীবনের কাছে হার মেনে আত্মহত্যার ভাবনা সেসব মানুষগুলোর প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। আর এ প্রবণতার ঊর্ধ্বগতি ইতোমধ্যেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। বর্তমানে জিম্বাবুয়েতে প্রতি চারজনে একজন মানুষ মনো-ব্যাধিতে আক্রান্ত। অথচ, এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের এ দেশটিতে সক্রিয় মনোবিদের সংখ্যাটা মাত্র ১৩ জন। যাদের মধ্যে ১২ জনই কাজ করেন দেশটির রাজধানী হারারেতে। তাদেরই একজন হলেন ডক্টর ডিক্সন চিবান্দা।
স্লোভাকিয়ায় অবস্থিত কোমিনিয়াস ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৩ সালে মেডিসিনে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ইউনিভার্সিটি অভ জিম্বাবুয়ে থেকে সাইকিয়াট্রি (২০০৪) ও পাবলিক হেলথ (২০০৭) বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পর ইউনিভার্সিটি অভ কেপ টাউন থেকে তিনি সাইকিয়াট্রিতে (২০১৫) পিএইচডি সম্পন্ন করেন। হারারে সেন্ট্রাল হসপিটালের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে জিম্বাবুয়ের ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ পলিসি গঠনেও নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি ভারতের ইউনিভার্সিটি অফ পুনেতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় মেন্টাল হেলথ বিভাগে ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অভ জিম্বাবুয়েতে একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি ডক্টর চিবান্দা কাজ করে চলেছেন আফ্রিকান মেন্টাল হেলথ রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বা আমারির পরিচালক হিসেবে। অন্যান্য দরিদ্র দেশের মতো জিম্বাবুয়েতেও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত স্বল্পতা। বহু বছর পাবলিক হেলথ নিয়ে গবেষণা শেষে নিজ দেশের ও দেশের মানুষগুলোর সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন।
২০০৫ সালে, মুরামবাৎসভিনা নামের এক অপারেশনে সরাসরি ৭,০০,০০০ মানুষ তাদের বাসস্থান হারায়। এতে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও ২.৪ মিলিয়ন মানুষ। যার ফলস্বরূপ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ; ডুবে যায় অন্ধকার জগতে। কিছু মানুষ ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার আঘাতের মুখে দাঁড়িয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে, কেউ কেউ আবার বেছে নেয় সহজ মুক্তির পথ, বেছে নেয় আত্মহত্যা।
কিন্তু, চারদিকে এত মানসিক অশান্তি ও অসুস্থতার বিপরীতে সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের কমতি তখন ডক্টর ডিক্সনকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। একটি ক্লিনিক ও কয়েকজন নার্স চেয়ে আবেদন করার পর যখন তার আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়, তখন তিনি থেমে যাননি। তিনি বরং হাজির হলেন অদ্ভুত এক সমাধান নিয়ে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৃদ্ধা নারীদের মাধ্যমে পার্কের বেঞ্চে বসেই শুরু করলেন সেবাদান।
মূলত ২০০৬ সালে পাবলিক হেলথ বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই জিম্বাবুয়ের মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতা নিরসনে এ আইডিয়া খুঁজে পান তিনি। ডক্টর চিবান্দার মতে, আফ্রিকান দেশগুলোয় বৃদ্ধ নারীদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। আর্থসামাজিক অবকাঠামোয় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাও তাদের থাকে না। তাদের দিয়েই যদি কোনোভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায়, আর এতে যদি মানুষের উপকার হয়, তাহলে ক্ষতি কী? ডক্টর ডিক্সনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মাত্র কয়েক সপ্তাহের সহজ প্রশিক্ষণ শেষেই একজন বৃদ্ধ নারী পুরোপুরি এই কমিউনিটি সার্ভিসে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারেন। আর পরম মমতা ও যত্নে রোগীর সাথে কথা বলার মাধ্যমে মনের ডাক্তার হিসেবে কাজ করে দিতে পারেন চিকিৎসা সেবা। এই ছোট্ট ভাবনা থেকেই ২০০৭ সালে জন্ম নিলো ‘ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ’ প্রকল্প।
কেতাবি শিক্ষা, পেশাগত আধিপত্য, অর্থ প্রতিপত্তি না থাকায় অধিকাংশ সমাজেই বৃদ্ধ নারীদেরকে পরিবারের বোঝা মনে করা হয়। বিশেষ করে, দারিদ্রের নিষ্ঠুর আঘাতপ্রাপ্ত সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বয়োজ্যেষ্ঠদের হতে হয় নিগ্রহের শিকার। সমাজের আর দশটা মানুষের সাথে কিংবা অত্যাধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো দৈহিক সক্ষমতা হয়তো তাদের নেই। আর্থিক অস্বচ্ছলতা কিংবা একাকিত্বের চাপ হয়তো তাদেরকে জীবদ্দশাকে করে তুলেছে মলিন। কিন্তু, পুঁথিগত বিদ্যা থাকুক বা না থাকুক, এ মানুষগুলোর রয়েছে পৃথিবীর হাজারো জটিলতার সাক্ষী হয়ে থাকার অভিজ্ঞতা। রয়েছে জীবনের শত উত্থান-পতনে নানান বাঁক পেরিয়ে এগিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা।
দীর্ঘ পাঁচ-ছয় যুগ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে পৃথিবীকে দেখা চোখজোড়া ঘোলাটে হয়ে এলেও একজন মানুষের মনে সজীব হয়ে থাকে অসংখ্য গল্প, অসংখ্য স্মৃতি, অসংখ্য অভিজ্ঞতা। থাকে হাজারো চাওয়া পাওয়ার মাঝে সামঞ্জস্য খুঁজে জীবনকে স্থিরভাবে বহমান রাখার জ্ঞান। থাকে জটিলতম সমস্যা অনুধাবন করে সহজতম সমাধান খুঁজে দেয়ার অনন্য বিদ্যা-বুদ্ধি। থাকে অর্ধশত বছরের অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়ে জীবন পাড়ি দেয়ার অদম্য সাহসিকতা। আর তারা পরম যত্নে যখন কারো সাথে কথা বলেন, খুব সহজেই একজন মানুষ নিজেকে তাদের কাছে মেলে ধরতে পারেন।
কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, গ্র্যান্ডমাদার নামে পরিচিত এই মনের ডাক্তারদের দেয়া সেবা ছাড়িয়ে গেছে প্রত্যাশা। বিবিসিতে (৩০শে জুন, ২০২০) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, জিম্বাবুয়েতে এখন পর্যন্ত গ্র্যান্ডমা বেঞ্চার্স বা ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের চিকিৎসা সেবায় পাল্টে গিয়েছে বিষণ্ণতা, হতাশা, আত্মহত্যা প্রবণতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা ৫০,০০০ এরও বেশি মানুষের জীবন। দেশ জুড়ে আড়াই শতাধিক বেঞ্চে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ প্রবীণা কাজ করে চলেছেন এই মহৎ প্রকল্পে।
সাজানো-গোছানো পরিপাটি কক্ষের আরামদায়ক চেয়ার বা কাউচে বসে দ্বিধান্বিত মনে মনোবিদের সামনে খোলামেলাভাবে মনের কথা বলার চেয়ে, পরিচিত মাঠ কিংবা রাস্তার মোড়ের একটা বেঞ্চে বসে দাদু-নানুর সমতুল্য অতিসাধারণ একজন মহিলাকে ডাক্তার নয়, বরং বন্ধু ভেবে নিজের গল্পগুলো বলা অনেক বেশি সহজ।
স্থানীয় ভাষায় ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতাকে বলা হয় ‘কুফুংগিসিসা’, যার শাব্দিক অর্থ ‘অতি চিন্তা করা’। জিম্বাবুয়ের কোনো একটি পার্ক বা খোলামেলা জায়গায় বেঞ্চে বসে একজন বৃদ্ধা মনোযোগ দিয়ে কারো গল্প শুনছে, এটা খুবই সাধারণ চিত্র। রোগীর মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করা, দীর্ঘ সময় নীরবে রোগীর কথা শোনা, সামান্য কিছু কথায় উৎসাহ দিয়ে রোগীকে আরও বেশি সাবলীলভাবে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার মতো কৌশলগুলোই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে এ প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা, ধর্ম, বর্ণের মানুষের বৈচিত্র্যময় সব গল্প। দিনের পর দিন সংসারে নির্যাতিত স্ত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা করার গল্প। কিংবা এইচআইভি আক্রান্ত হয়ে মানবজাতির প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প। কিংবা চার সন্তান নিয়ে দারিদ্র্য ও হতাশায় ডুবে যাওয়া বেকার মায়ের গল্প। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে রোগীদের গল্প শোনেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মনের ডাক্তাররা।
দেশব্যাপী ক্লিনিকগুলোর সহযোগিতায় রোগীদেরকে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের মানসিক চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, যাচাই করে পাঠানো হয় ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চে। ডক্টর ডিক্সনের মতে, বেঞ্চে আসা রোগীদের ৪০ শতাংশই নারী এবং তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার।
সাধারণত, সমাজের বয়স্ক মানুষগুলোকে পরামর্শদাতা বা উপদেশদাতা রূপেই দেখা যায়। কারণ, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে সবসময়ই তারা পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে পথ দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, এই প্রকল্পে অংশ নেয়া মানুষগুলো পরামর্শ বা উপদেশ দেয়ার চেয়ে গল্প শুনতেই বেশি ভালোবাসেন।
রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা থাকায় দেশটিতে নিজের মানসিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা কথা বলাটাকেই বড্ড অস্বাভাবিক ও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রথম প্রথম বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে তুলতেও তাই যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। জয়েস এনকুবে নামের এক গ্র্যান্ডমাদারের মতে,
“শুধুমাত্র মনের কথাগুলো কাউকে খুলে বলতে না পারার কষ্টেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়। আর মানুষ যখন মনের ভেতর কথা জমাতে শুরু করে, সমস্যার সূচনাও হয় ঠিক তখন থেকেই।”
সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু সমীক্ষা বলছে, ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ এর এই সেবা প্রচলিত চিকিৎসা সেবার চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। তারই ফলস্বরূপ, ডক্টর ডিক্সনের হাত ধরে এই মনের ডাক্তারেরা ছড়িয়ে পড়ছেন কেনিয়ার চা বাগান, মালাউই-র এইচআইভি ক্লিনিক থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কের মাঠে-ঘাটে। লাইবেরিয়া, রুয়ান্ডাসহ, মার্কিন যুক্তরাজ্যেও ঘটতে চলেছে এ প্রকল্পের বিস্তার।
সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ এর আঘাতে নতুন করে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ববাসী। অস্বাভাবিক এই গৃহবন্দী জীবন ব্যবস্থা ও হুট করে কর্মব্যস্ত জীবন হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি ভয়, আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা তৈরি করছে নানান ধরনের জটিলতা ও মানসিক অসুস্থতা। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা, মানসিক স্বাস্থ্য গবেষক সমাজ ও চিকিৎসকেরা এই পরিস্থিতিতে দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতায় যত্নবান হতে নানা ধরনের সমস্যার সমাধান ও নিত্যনতুন সহায়ক ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হতে কাজ করে চলেছেন।
তারই ধারাবাহিকতায়, ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ নতুন রূপে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। সামাজিক দূরত্বে অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট এ পৃথিবীতে ভার্চুয়াল যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে দূরত্বকে হার মানিয়ে ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চের সেবা পাবে বিশ্ববাসী। ইন্টারনেটে সাড়া ফেলা এই প্রকল্পের আদলে বা অনুকরণে গড়ে উঠেছে আরও কিছু প্রকল্প।
ইতিমধ্যেই ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চকে যুগোপযোগী ও কার্যকর সমাধান হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেছে নিউ ইয়র্ক সিটি। নিউ ইয়র্ক সিটির ডিপার্টমেন্ট অভ হেলথ অ্যান্ড মেন্টাল হাইজিন-এর থেরাপিস্ট ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টাকিশা হোয়াইট বলেন,
“মনোবিদের কাছে যাওয়া উচিত কি না, শুধুমাত্র এ দ্বিধা থেকেই বহু মানুষ তাদের মনোরোগ চেপে বেঁচে থাকেন, চিকিৎসা নিতে চান না। কিন্তু, সনদপ্রাপ্ত মনোবিদ না থাকলেও, নির্ভরযোগ্য শ্রোতার কাছে নিজের মনের কথাগুলো স্বাধীনভাবে বলতে পারার সুযোগ করে দেয় ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজকে আরও বেশি সুন্দর ও সুখী করে তুলতে এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু জায়গায় ইতোমধ্যেই ফ্রেন্ডশিপ বেঞ্চ প্রকল্প নেয়া শুরু হয়েছে। তবে পুরো ব্যাপারটাকে সুনির্দিষ্ট কোনো শ্রোতায় সীমাবদ্ধ না রেখে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। যেখানে, সম্পূর্ণ অচেনা কেউ এসে এই বেঞ্চে বসলেও ধরে নেয়া হবে, সে সহযোগিতা করা কিংবা শ্রোতা হিসেবে অন্যের পাশে থাকার জন্যই এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে করে প্রক্রিয়াটি আরও বেশি সহজ ও প্রাণবন্ত হবার পাশাপাশি, জনজীবনের অংশ হয়ে উঠবে। অচেনা অশান্ত মন খুঁজে পাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।