X (ছদ্মনাম) এর বয়স অাটচল্লিশ, পেশায় একজন ব্যাঙ্কার। চাকরিজীবনের শেষপর্যায়ে এসে পদার্পণ করেছেন, অার কিছুদিন পরেই অবসরে যাবেন। স্ত্রী অার দুই সন্তানকে নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন। রোজ সকালে অফিস যান অার বিকেলে বাসায় ফেরেন।
এভাবেই নিশ্চিন্তে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। বাধ সাধলো তার একটি বিচিত্র শারীরিক সমস্যা। সেটা হলো তিনি যত্রতত্র ঘুমিয়ে পড়েন। তা হোক দিন কি রাত, সকাল বা সন্ধ্যা।
শুরুতে শুরুতে ক্লান্তিজনিত অবসাদ ভেবে উপেক্ষা করে চললেও দিন দিন সমস্যাটা বেড়েই চললো। অবস্থাটা এমন দাড়ালো যে, তিনি কারো সাথেই অালাপচারিতার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলেন। X এর এহেন অাচরণে অাশপাশের মানুষেরা বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলো এই ভেবে যে, তাদের কথা শুনতে শুনতে বোরড হয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। অাবার অনেকে ভাবলেন হয়তো সারাদিন খাটতে খাটতে ক্লান্ত হয়ে যাবার কারণেই এই ঘুম। কিন্তু X নিরুপায়। তিনি নিজেও জানেন না এমনটা কেন হচ্ছে।
সবচেয়ে বিব্রতকর ঘটনাটা ঘটলো এর কিছুদিন পর। মূল শাখা হতে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অফিস পরিদর্শনে এসে লক্ষ্য করলেন X অফিস চলাকালেই নিজের ডেস্কে বসে নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রায় মগ্ন। ব্যাস, অার যায় কোথায়। ধমক-অপমান তো জুটলোই, সেই সাথে হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো একটি বাধ্যতামূলক ছুটির নোটিশ।
লজ্জিত X বুঝতে পারলেন, এবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন চিকিৎসকের চেম্বারে। কতগুলো টেস্ট অার চেকঅাপের পর চিকিৎসক জানালেন, X একটি মানসিক বিকারে ভুগছেন, যার নাম নারকোলেপ্সি।
নারকোলেপ্সি কী?
নারকোলেপ্সি একধরনের স্নায়বিক ব্যাধি, যা মানুষের মস্তিস্কের নিদ্রা আর জাগরণ সঞ্চালনকারী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর দিনের বেলায় খুব ঘুম পায়। হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ার দৃষ্টান্তগুলো আচমকাই হয়, স্থান-কাল নির্বিশেষে। নারকোলেপ্সি আক্রান্ত ব্যক্তি গাড়ি চালাতে চালাতে, কথা বলতে বলতে, এমনকি খেতে খেতেও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। বেশিরভাগ রোগী জানেন না যে তারা নারকোলেপ্সি ভুগছেন। এটি একটি গুরুতর ব্যাধি, কিন্তু নিয়মিত ওষুধ খেলে আর জীবনশৈলীতে কিছু পরিবর্তন আনলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সাধারণ অবস্থায় ক্লান্তি বা ঝিমুনিভাব অনুভব করার মানেই এই নয় যে নারকোলেপ্সি হয়েছে। অন্য কোনো নিদ্রাবিকার, মানসিক সমস্যা বা সঠিক পরিমাণে ঘুমের অভাবে এই সমস্ত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ইতিহাস
নারকোলেপ্সি রোগটি পুরোনো হলেও এর ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে রোগটির ধারণা প্রথম পাওয়া যায় ১৮৭৭ সালে। তবে রোগটিকে নারকোলেপ্সি নামে অভিহিত করেন চিকিৎসাবিদ গ্যালিনিউ ১৮৮০ সালে। এটিকে তখন বলা হতো গ্যালিনিউয়ের সিনড্রোম। এর ২২ বছর পর ১৯০২ সালে লোয়েনফিল্ড ক্যাটাপ্লেক্সি উপসর্গটি অাবিষ্কার করেন, যা রোগটি সম্পর্কে মানুষের অাগ্রহ বৃদ্ধি করে। অাধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে নারকোলেপ্টিক রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালে, যেটি একটি কুকুর ছিলো।
কারণ
নারকোলেপ্সি হওয়ার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। যদিও এই অসুখের কারণ হিসেবে গবেষকদের মত হলো জিনগত কারণে মস্তিকের হাইপোক্রেটিন রসায়নের ঘাটতির ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন বা জেগে যান।
উপসর্গ
নারকোলেপ্সির উপসর্গগুলোকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. অতিরিক্ত অবসাদ
রাতে ভালো করে ঘুমানোর পরেও সারাদিন ধরে ক্লান্ত অনুভূত হয়। এর ফলে রোগী হয়ত অল্পক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নিয়ে সতেজ অনুভব করেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার ক্লান্ত লাগতে শুরু করে।
২. ক্যাটাপ্লেক্সি
ক্যাটাপ্লেক্সি হলো একধরনের শারীরিক অবস্থা, যেখানে হঠাৎ হাসি, রাগ বা উত্তেজনা দেখা দিলে রোগী তার মাংসপেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং মাটিতে পড়ে যান। রোগী কী ধরনের বিকারের সম্মুখীন হতে পারেন, তা শরীরের কোন মাংসপেশি ক্যাটাপ্লেক্সির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে। ক্যাটাপ্লেক্সির ফলে উচ্চারণ অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে, বা হাঁটু দুর্বল হয়ে পড়ে যেতে পারেন। অবশ্য সমস্ত নারকোলেপ্সি রোগীর ক্ষেত্রে ক্যাটাপ্লেক্সি দেখা যায় না।
৩. সম্মোহনী ধরনের অলীক বিভ্রম
নিদ্রায় মগ্ন হওয়ার পূর্বমুহূর্তে রোগী ভীতি উৎপাদী অলীক দর্শন প্রবণতায় ভোগে। যেহেতু এসব বিভ্রম জেগে থাকা অবস্থায় দেখা যায়, দৃশ্যগুলো সত্যি মনে হয়। রোগী স্বপ্নের মতো ছবি বা উল্টোপাল্টা কথাবার্তা শোনে যাকে হ্যালুসিনেশান বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বিভ্রম থেকে মনের ভয় আর আতঙ্ক আরো বেড়ে যেতে পারে।
৪. অসাড়তা
নিদ্রাভঙ্গের পর উত্থানকালে স্বল্প সময়ের জন্য দৈহিক অসাড়তা দেখা দেয়। এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, এক বা দুই মিনিট। এই সময় রোগী শ্বাসরুদ্ধ বোধ করে না, কিন্তু সে কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারে না। একে স্লিপ প্যারালাইসিস বলে।
অন্যান্য উপসর্গ
* নিদ্রাকাল খুব সংক্ষিপ্ত হওয়া।
* নিদ্রা খুব ঘন ঘন উৎপন্ন হওয়া।
* নিদ্রা ভাঙ্গামাত্রই সচলতা অনুভব করা।
* বারে বারে চোখে বাঁধ না মানা ঘুম আসা।
* খেতে খেতে বা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা।
* নিদ্রাভঙ্গের পর রাতে ঘুমের ঘোরে এমন কিছু কাজ করা যা মনে থাকে না।
* রাতে হঠাৎ গরম লেগে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া।
রোগ নির্ণয়
এই রোগ নির্ণয়ে দুটি পরীক্ষা করা হয়।
১. পলিসমনোগ্রাম ও
২. মাল্টিপল স্লিপ ল্যাটেন্সি টেস্ট।
এছাড়াও আধুনিক গবেষণায় মস্তিষ্কের রসে হাইপোক্সেটিন পরিমাপ করেও নারকোলেপ্সি নিশ্চিত করা যায়।
বিশ্ব-পরিস্থিতি
নারকোলেপ্সি রোগটি ধীরে ধীরে বিশ্বে প্রকটমান। এটি পার্কিনসন রোগের মতোই বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ। প্রতি ২,০০০ জনে একজন আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে।
চিকিৎসা
দুঃখজনক হলেও সত্যটা হলো, নারকোলেপ্সি রোগটির পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। কিন্তু ওষুধ আর জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে কিছু পরিবর্তন সাধন করে এই রোগটির প্রভাবকে আয়ত্বের মধ্যে রাখা যায়। যেমন- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের সাহায্যে ক্যাটাপ্লেক্সি, বিভ্রম আর ঘুমের মধ্যে অসাড়তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
করণীয়
নারকোলেপ্সি নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কঠিন। কিন্তু জীবনশৈলীতে কিছু কিছু পরিবর্তন এনে অনায়াসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। এগুলো হলো-
★ রুটিন মেনে ঘুমানো আর দিনের বেলায় অল্প সময় বিশ্রাম নেয়া।
★ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় গাড়ি চালানো বা একাগ্রতার প্রয়োজন এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা।
★ গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ তন্দ্রা বা ঝিমুনি অনুভব করলে গাড়ি রাস্তার একপাশে দাড় করিয়ে বিশ্রাম নেয়া।
★ নিয়মিত ব্যায়াম করা, এতে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
★ মদ, তামাক আর ক্যাফেইনের সেবন এড়িয়ে চলা।
★ চিকিৎসকের নির্দিষ্ট চিকিৎসা পরিকল্পনা কঠোরভাবে মেনে চলা।
★ ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা উপসর্গে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানানো।
★ নিজের সমস্যা সহকর্মী বা শিক্ষকদের খুলে বলা, যাতে তারা রোগীকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করতে পারেন।
★ আশেপাশের লোকেদের নারকোলেপ্সি সম্বন্ধে সচেতন করা।
Featured photo: El Confidencial