হাসিখুশি মানুষ আফজাল সাহেব (ছদ্মনাম)। বয়স পঁয়তাল্লিশ, কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরিটা রিসিপশনিস্টের, তাই সারাদিন বসেই থাকতে হয়। রোজ নয়টা-পাঁচটার চাকরি শেষে বাসায় গিয়েই গা এলিয়ে দেয়া তার খুব পুরনো একটি অভ্যাস।
কিন্তু কয়েকদিন ধরেই একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করেছেন আফজাল সাহেব। সেটা হলো- বিছানায় শোবার সাথে সাথে এক অস্বস্তিকর অনুভূতি এসে ঘিরে ধরে তাকে। অস্বস্তিটা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় পায়ে। মনে হয়, কিছু একটা যেন ওগুলো বেয়ে উঠে আসতে চাইছে। অস্বস্তি এড়াতে তিনি পা নাড়াতে থাকেন। তাতে কিছুটা আরাম বোধ হয়।
এই অদ্ভুত সমস্যার জ্বালায় টিকতে না পেরে আফজাল সাহেব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। চিকিৎসক নানাভাবে পরীক্ষা করে জানালেন, তার এই সমস্যাটির নাম ‘রেস্টলেস লেগস সিনড্রোম’।
রেস্টলেস লেগস সিনড্রোম কী?
রেস্টলেস লেগস সিনড্রোম (RLS) এমন একধরনের শারীরিক ব্যধি, যেখানে রোগীর রোগে পায়ে এমন এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে থাকে, যাতে রোগীর পা না নাড়িয়ে উপায় থাকে না। মূলত বিশ্রাম নেবার সময় (সন্ধ্যায় ও রাতে) বেশি দেখা গেলেও দিনের যেকোনো সময় উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।
এ শারীরিক সমস্যাটি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যে কারোরই হতে পারে। তরুণ বয়সে রোগের লক্ষণগুলো মৃদু থাকলেও, বার্ধক্যে উপনীত হবার সাথে সাথে তা আরো প্রকট হয়ে ওঠে, তীব্রতা বেড়ে যায়। পুরুষের তুলনায় নারীদের এ ব্যধি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
পায়ে ঝিনঝিনে ভাব এবং প্রদাহকে এ ব্যধির লক্ষণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আর এসব অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে রোগী অনবরত পা নাড়াতে আরম্ভ করেন। শুধু পা নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতেও একই ধরনের অনুভূতি হতে পারে।
ইতিহাস
১৬৭২ সালে ব্রিটিশ নিউরোলজিস্ট থমাস উইলিস সর্বপ্রথম ‘De Anima Brutorum’ নামক গবেষণাপত্রে এ ব্যধির কথা বর্ণনা করেন। এরপর ১৮৬১ সালে জার্মান বিজ্ঞানী থিওডোর উইটম্যাক ‘অ্যাংটাস টিবিয়ারাম’ বা ‘উদ্বিগ্ন পা’ নামে ব্যধিটিকে শনাক্ত করেন। ১৯৪৫ সালে সুইডিশ নিউরোলজিস্ট কার্ল এক্সল একবম ব্যধিটিকে ‘asthenia crurum paraesthetica’ নামে অভিহিত করে এর লক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করেন। সে সময় থেকে এ ব্যধিটির আরেক নাম হয়ে ওঠে ‘উইটম্যাক-একবম সিনড্রোম’।
কারণ
বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক অস্বাভাবিকতার কারণে আর এল এস দেখা দেয় এবং তা প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা আলাদা হতে পারে। এদের মধ্যে সাধারণ কয়েকটি কারণ হলো-
শরীরে লৌহ কণিকার স্বল্পতা: শরীরে কোনো কারণে লৌহ কণিকার স্বল্পতা দেখা গেলে, মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যকার যোগাযোগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে আরএলএস-এর উপসর্গ দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থাকে নারীদের আরএলএস হবার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে ডেলিভারির আগের তিন মাসে রোগটির উপসর্গগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু নবজাতক প্রসবের এক মাসের মধ্যে উপসর্গগুলো প্রকোপ কমে যায়।
ডোপামিনের অভাব: রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম মূলত ডোপামিন-নির্ভর একটি বৈকল্য। ডোপামিন হরমোন আমাদের দেহের মাংসপেশি সঞ্চালনার জন্য দায়ী। মস্তিষ্ক কোনো কারণে নিঃসরণ কমিয়ে দিলে শরীরে এর ভারসাম্যের তারতম্য ঘটে এবং উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতা, যেমন: ডায়াবেটিস, পার্কিনসন্স ডিজিজ, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, আর্থ্রাইটিস (বাত), অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা), কিডনি জটিলতা, স্নায়ু রোগের কো-মরবিডি হিসেবে আরএলএস হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: অন্যান্য রোগ নিরাময়ে সেবন করা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও আরএলএস দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিহিস্টামিন এবং ঠান্ডা ও অ্যালার্জি নিরামক অ্যান্টিহিস্টামিনের কথা উল্লেখ করা যায়।
বংশগতির প্রভাব: যারা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমে আক্রান্ত হন, দেখা গেছে তাদের অর্ধেকের পরিবারের কারো না কারো এই রোগটি ছিলো।
অন্যান্য কারণ: এছাড়া মাদকাসক্তি এবং পর্যাপ্ত নিদ্রার অভাবে আরএলএস দেখা দিতে পারে।
উপসর্গ
রেস্টলেস লেগস সিনড্রোম নামটি থেকেই বোঝা যায় এই ব্যাধির প্রধান উপসর্গ হলো অনবরত পা নড়ানো। এর অন্যান্য প্রধান উপসর্গগুলো হলো-
- পায়ে অস্বস্তিকর শিহরণ অনুভূত হয়, যার ফলে রোগী পা নাড়াচাড়া করতে বাধ্য হন।
- পা শক্ত হয়ে ওঠে।
- পায়ে জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়।
- পা ভাঁজ করতে অসুবিধা হয়।
- পায়ে চুলকানি দেখা দেয়, এমন মনে হয় যে পায়ের ত্বক বেয়ে কোনো পোকা মাকড় উঠছে।
- কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো অনুভূতি হতে পারে।
- কখনো মনে হয়, পায়ের হাড়ের মধ্যে কী যেন চুলকাচ্ছে।
- ঘুমের মধ্যে বারবার পা নাড়ানোর জন্য ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে সকালে ক্লান্ত লাগে, সারাদিন ঝিমুনি ভাব থাকে এবং ঘুমের অভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
রোগনির্ণয়
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার আগে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা উচিত।
- রাতে অনবরত পা নাড়ানোর কারণে ঘুমোতে অসুবিধা হচ্ছে কি?
- পায়ে জ্বালাপোড়ার কারণে সারারাত জেগে থাকতে হচ্ছে কি?
- নিচু হবার সময় পায়ে প্রদাহ অনুভূত হচ্ছে কি?
- পায়ের এই কাঁপুনির ফলে হাটতে বা দৌড়াতে অস্বস্তি লাগছে কি?
- উপসর্গগুলো সপ্তাহে দুই-তিন দিন অন্তর অন্তর দেখা দিচ্ছে কি?
উপরের প্রশ্নগুলোর কোনোটির উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে একে সাধারণ ভেবে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গের বর্ণনা শুনেই রোগটিকে শনাক্ত করা যায়। অনেক সময় নিউরোপ্যাথিক পেইন, আর্থ্রাইটিস, রক্তনালির সমস্যার লক্ষণের সঙ্গে রেস্টলেস লেগ সিনড্রোমের লক্ষণের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই কারো হয়েছে কি না, সেটি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে ব্লাড টেস্ট, মস্তিষ্কের এমআরআই, ইএমজি ও পলিসমনোগ্রাফি টেস্টের দরকার পড়ে।
অনেকে এ রোগটি সম্পর্কে খুব বেশি না জানায় একে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। শরীর নিয়ে এমন অবহেলা RLS এর উপসর্গগুলোকে প্রকট করে তোলার পাশাপাশি ডেকে আনতে পারে অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতাও।
চিকিৎসা
পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য না হলেও ওষুধ সেবন এবং নিয়মমাফিক চললে এর উপসর্গগুলোকে আয়ত্ত্বে রাখা সম্ভব।
ডোপামিনার্জিক এজেন্ট: বিভিন্ন ওষুধ রয়েছে যা মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিঃসরণকে তরান্বিত করে। এগুলোকে ডোপামিনার্জিক এজেন্ট বলে। উল্লেখযোগ্য কিছু ডোপামিনার্জিক এজেন্ট হলো Levodopa, Mirapex, Neupro ও Requip। উল্লেখ্য, এসকল ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন- অসাড়তা অনুভব, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি।
Alpha2 Agonist: Alpha2 Agonist মস্তিষ্কের স্টেম সেলগুলোর রিসেপ্টরকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। এতে করে মস্তিস্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যকার বার্তা আদান-প্রদান গতিশীল হয় এবং এর উপসর্গগুলোর মাত্রা হ্রাস পায়।
ওপিয়েটস: ব্যথানাশক হিসেবে পরিচিত ওপিয়েটস ব্যবহার করে আরএলএস নিরাময়ে ইতিবাচক ফলাফল দেখা গেছে। তবে ওষুধটির তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং মাদকদ্রব্য হিসেবে দুর্নামের কারণে একে আরএলএস নিরাময়ের সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
স্লিপিং মেডিকেশন: মূলত স্লিপিং মেডিকেশনের সাথে নিরাময়ের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও রোগীর সুনিদ্রার জন্য Benzodiazepines জাতীয় সিডেটিভ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।
এছাড়াও অ্যান্টিকনভালসেন্ট এবং অ্যান্টিসেইজার ড্রাগ, যেমন- Tegretol, Lyrica, Neurontin এবং Horizant ব্যবহারে উপসর্গগুলো প্রশমিত হতে পারে।
করণীয়
ওষুধের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়ম মেনে চললে একজন RLS রোগী অন্যান্য সুস্থ মানুষের মতোই প্রাত্যহিক জীবনযাপন করতে পারেন। এগুলো হলো-
বাড়াতে হবে নড়াচড়া
এ কথা কে না জানে যে, শারীরিক কসরত করলে সারাদেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়? তাই একজন রোগীর উচিত নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, স্ট্রেচিং এবং ব্যায়াম করা। সেই সাথে যারা সারাদিন ডেস্কে বসে অফিস জব করেন, তাদের উচিত একটু পরপর চেয়ার থেকে উঠে পায়চারী করা। সেই সাথে কেউ যাতে অধিক যানবাহন নির্ভর হয়ে না পড়েন, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ক্যাফেইন-চিনি থেকে থাকুন দূরে
অতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং চিনি গ্রহণ করলে দেহে শর্করার ভারসাম্য বিনষ্ট হয়, যা মাংসপেশির প্রদাহ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই দেহে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাবারের তালিকা থেকে কফি বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারগুলো বাদ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
মদকে ‘না’ বলুন
মদ, কিংবা অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন ড়লশ-এর উপসর্গগুলো আরো তরান্বিত করে তোলে। তাই অ্যালকোহল কিংবা যেকোনো ধরনের মাদকদ্রব্যকে সর্বাবস্থায় পরিহার করতে হবে।
পরিবর্তন করুন ঘুমের অভ্যাস
ঘুমাতে যাবার আগে নিশ্চিত করতে হবে, যে স্থানে ঘুমাচ্ছেন, সেটি যথেষ্ট আরামদায়ক কি না। ঘরে কোনো বিরক্তিকর আলো কিংবা শব্দের উৎস থাকলে তা সরিয়ে নিতে হবে। ঘুমাবার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পর্যাপ্ত আরামদায়ক ঘুমই হলো আরএলএস উপশমের অন্যতম চাবিকাঠি।