টুরেটস সিনড্রোম: যে রোগকে অবহেলা করলে বাড়বে বিষণ্নতা

প্রথম ঘটনা

মিজান মিয়া কাজ করেন পুরান ঢাকার একটি লোহার ডাইস তৈরির ওয়ার্কশপে। ওয়ার্কশপের মালিক তিনি নিজেই। ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তার আলাপ-আলোচনা করতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয় যে, ব্যবসা নিয়ে কারো সাথে কথা বলার সময় লোকটি বিরক্তি প্রকাশ করছেন। এতে করে তার ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে ভেবে চিন্তায় পড়ে যান মিজান। তিনি তখন সমস্যাটি খুঁজে বের করেন। কথা বলার সময় বা অন্য যেকোনো সময় তার মনে হয় গলায় ভারী কিছু আটকে আছে। এটি কফ বা অন্য কিছু হতে পারে। তাই প্রায়শই তিনি গলা খাকারি দিয়ে সেই বস্তুটি বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বের হয় না কিছুই। বারংবার তার এমনই মনে হয়। চিকিৎসা করার জন্য তিনি ডাক্তারের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সমাধান আজও পাননি তিনি।

দ্বিতীয় ঘটনা

তৌহিদুল ইসলাম মুনীর কলেজের ছাত্র। ছেলেবেলা থেকেই সে একটি সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। হাঁটার সময় ডান হাত হুট করে সামনে তাক করতে হয়। তখন তার চোখের পাতাও একসঙ্গে বারবার বন্ধ করতে হয় এবং খুলতে হয়। তার কলেজের বন্ধুরা এই কারণে তাকে বিশেষ একটি নামে সম্বোধন করে। এই কারণে প্রায়শই তাকে হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। রাতে প্রায়ই কাঁদে সে, একা। কেউ জানে না সেই কান্নার কারণ। সমাধান করার চেষ্টা করেছে সে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান পায়নি মুনীর।

এতে আক্রান্তরা কিছু আচরণে ব্যতিক্রমী এবং স্বাভাবিক নয়; Image Source: LabRoots

উপরের ঘটনা দুটো অন্য কোনো রোগের মতো কোনো রোগ নয়। এই ধরনের সমস্যাকে মেডিকেলের ভাষায় ‘টুরেটস সিনড্রোম’ বলা হয়। এটি একটি নিউরো- মটরজনিত মানসিক সমস্যা। কারো মগজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে দেখা দেয় এই লক্ষণ। তার কোনো কথাবার্তা কিংবা যেকোনো অঙ্গভঙ্গিকে তখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে। কারণ এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে মস্তিষ্কে থাকতে হয় একটি সুষ্ঠু নেটওয়ার্ক। এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে সে কথা বলার সময় বা কোনো কাজ করার সময় ভিন্ন রকম কিছু আচরণ দেখায়। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা তখন তার জন্য কষ্টসাধ্য কাজ হয়ে পড়ে।

১৮৮৫ সালে ডা. জর্জ জিল ডে লা টুরেট নামের একজন ফরাসি চিকিৎসক ও নিউরোলজিস্ট সর্বপ্রথম তার নয়জন রোগীর মধ্যে এই ধরনের ব্যতিক্রমী আচরণের লক্ষণ খুঁজে পান। তার নামানুসারে এই সিনড্রোমের নামকরণ করা হয় ‘টুরেটস সিনড্রোম’।

লক্ষণ

এই সিনড্রোমের লক্ষণ হলো মূলত বিভিন্ন ধরনের Tics বা টিক্স। আমাদের দেহের মোটর পেশীর অনিয়মিত কিংবা পুনরাবৃত্তিমূলক সঞ্চালনকে টিক্স বলা হয়। টিক্সকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১) ভোকাল টিক্স: মূলত আমাদের স্বরযন্ত্র থেকে বের হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত আওয়াজ এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ঘন ঘন কাশি দেয়া, চিৎকার করা, ঘন ঘন নাকের মাধ্যমে বাতাস টানা, একটু পর পর মুখ বড় করে হা করা, একটু পরপর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরা কিংবা ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ করা।

২) মোটর টিক্স: এই ধরনের লক্ষণগুলো মূলত স্বরযন্ত্র ছাড়া দেহের অন্য যেকোনো অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত।। যেমন- হাত, পা কিংবা দেহের কোনো বাহু ঝাঁকি মারা, মুখের পেশি ঝাঁকি মারা, মাথা ঝাঁকি মারা, চোখ টিপ মারা কিংবা কাঁধ নাড়ানো।

মূলত এটি কোনো রোগ নয়, একধরনের সিনড্রোম; Image Source: Deccan Chronicle 

আপনার সামনে কেউ যদি পথে-ঘাটে চেঁচিয়ে ওঠে কিংবা হাত পা ছোড়ে, তাহলে তাকে উন্মাদ ভাবা উচিত নয়। কেননা টুরেটস সিনড্রোমের মতো জটিল সমস্যার কারণে এমনটি হতে পারে। কখনও কখনও এই সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীর মুখ থেকে বের হতে পারে অশ্রাব্য ভাষার গালিগালাজ। মস্তিষ্কের অশোভন আচরণের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে মানুষের। তবে টুরেটস সিনড্রোমের একটি অংশ হতে পারে অশোভন আচরণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা।

কখন হয় ও আক্রান্ত হবার কারণ কী?

যারা এই সিনড্রোমে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে জন্মের পর দুই বছর বয়স থেকেই দেখা দিতে শুরু করে এর লক্ষণগুলো। টানা ১০ বছর এটি চলে। ১২ বছর বয়সের সময় এটি কমতে শুরু করে। তবে অনেকের না-ও কমতে পারে। এর সঙ্গে কখনও কখনও অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) বা লার্নিং ডিফিকাল্টির মতো সমস্যা দেখা যায়। তবে এই অসুখে বাচ্চার বুদ্ধির উপর প্রভাব পড়ে না।

এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার মূল কারণ আজও জানা যায়নি। তবে অনেকেই বলে থাকেন এটি বংশগত কিংবা জিনগত। এটি আসলে সত্যি নয়। যাদের টুরেটস সিনড্রোম আছে তাদের বংশধরের কেউ এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। টুরেটস সিনড্রোম হতে পারে জিনগত এবং শিশুর চারপাশের অবস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে। তবে সিনড্রোমটি নারী বা পুরুষভেদে পার্থক্য হয়ে থাকে। নারীদের চেয়ে পুরুষদের এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি। এই সিনড্রোমের আরও কিছু কারণ হলো-

 গর্ভধারণের সময় মা যদি অতিরিক্ত পরিমাণ মদ্যপান করেন, কফি পান করেন কিংবা সিগারেট পান করেন তাহলে তার পেটে থাকা সন্তানের এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
 তিনি যদি গর্ভধারণের সময় অনেক বেশি মানসিক অশান্তিতে থাকেন তাহলেও এটি হবার সম্ভাবনা থাকে।
 জন্মের সময় বাচ্চার ওজন অনেক কম হলে তার মস্তিষ্কে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে তার। সে শিকার হতে পারে টুরেটস সিনড্রোমের।
 জন্মের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কম হলে এমন হতে পারে।

অনেকটা অযাচিতভাবেই এই সিনড্রোমটি আমাদের আড়ালে রয়েছে; Image Source: Nicole Beurkens

প্রতিকার

চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি অন্যান্য রোগের মতো নয়। তাই এর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাও নেই। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি সাধারণ ট্রিটমেন্ট করিয়ে বলতে পারেন এতেই সমাধান আসবে। মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির মনের জোর আনতে এবং ব্যাপারটি ভুলিয়ে দিতে এমনটি করা হয়। তবে একটু সচেতন হলে এই সিনড্রোমের হাত থেকে একটি শিশুকে রক্ষা করতে পারবেন। তার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবেন সহজেই। মেনে চলুন কিছু নিয়ম-
 আপনার সন্তানের সমস্যা আসলে কী তা শুরু থেকেই জানতে চেষ্টা করুন। কেননা এই সমস্যাগুলো শিশুরা প্রকাশ করতে চায় না।
 এই ধরনের আচরণ করলে তাকে বকবেন না। তার পাশে থাকুন, তাকে বোঝান এটি আসলে স্বাভাবিক ব্যাপার। বড় হলেই এই সমস্যার সমাধান আসবে।
 অধিকাংশ সময় তার পাশে থাকার চেষ্টা করুন। তাকে ভিন্ন কোনো কাজে মনোনিবেশ করান। এতে করে সে ব্যাপারটি ভুলে যাবে। নাহলে তার বারবার মনে হবে এই কাজটির কথা।

এই সিনড্রোমে আক্রান্তরা তাদের কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণে করতে পারে না; Image Source: Drug Target Review

 তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করবেন না। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন।
 শিক্ষকদেরকে অবশ্যই এই ব্যাপারে জানা থাকতে হবে। সিনড্রোমটি নিয়ে তার জানা না থাকলে তিনি ভুল পদক্ষেপ নিতে পারেন।
 এই সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে আলাদাভাবে নজরে রাখুন। তার সমস্যা অনুযায়ী তাকে সময় ও সুবিধা দিন। এমন ভান করুন যাতে মনে হয় আপনি ব্যাপারটি সহজভাবে নিয়েছেন। এতে করে আপনার বাকি শিক্ষার্থীরা ব্যাপারটি সহজভাবে নেবে।
 তাকে পরীক্ষার সময় সুবিধামতো সময় ও ধরন দিন। লিখতে সমস্যা হলে মৌখিক পরীক্ষা নিন। মুখে বলতে সমস্যা হলে লেখার মাধ্যমে পরীক্ষা নিন।
 এই সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীরা প্রায়শই বিষন্নতায় ভোগে। এই পথ থেকে সরিয়ে আনতে হলে তার সমস্যাটি সহজভাবে নিতে হবে। চাইলে তিনি মেডিটেশন করতে পারেন কিংবা সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে পারেন।

টুরেটস সিনড্রোমকে যতটা সহজ ভাবা হয় তা ততটা সহজ নয়। আবার একে যতটা কঠিন ভাবা হয় এটি ততটা কঠিনও নয়। ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া বলিউডের সিনেমা ‘হিচকি’তে এই সিনড্রোমে আক্রান্ত একজনের চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেত্রী রানী মুখার্জী। তিনি কথা বলার সময় কিংবা অন্য যেকোনো সময় মুখ বাঁকা করে অদ্ভুত আওয়াজ করেন। কিন্তু শিক্ষক হবার প্রবল ইচ্ছা তার। এই সিনেমায় দেখানো হয় এরূপ সমস্যায় থাকার পরেও তিনি কীভাবে একজন সফল শিক্ষক হন। রানী মুখার্জী এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি নিজেও তার শৈশবে টুরেটস সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন।

 টুরেটস সিনড্রোম নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয়েছে রানী মুখার্জী অভিনীত ‘হিচকি’ সিনেমা; Image Source: indiawest

ইতিহাসে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা টুরেটস সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েও বিখ্যাত হয়ে আছেন। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ফুটবলার ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহাম, মোৎজার্ট, হুই মেন্ডেল, লেখক স্যামুয়েল জনসনসহ অনেক বিখ্যাত মানুষই টুরেটস সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু এটা তাদের সাফল্যের পথে কখনোই অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি। তারা নিজেদের যোগ্যতা দেখিয়ে তাদের ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা হয়েছেন।

This article is about Tourette's syndrome. It is a problem related to the nervous system that causes some people to make sudden movements or sounds. 

Feature Image Source: Jerusalemonline

Related Articles

Exit mobile version