মানব মস্তিষ্ক অত্যন্ত মজার, একইসাথে অদ্ভূতও। এর কার্যক্রমও সবসময় যুক্তি মেনে চলে না। যে অটিজমকে বহুকাল ধরে অস্বাভাবিক ধরে নিয়ে অটিস্টিক ব্যক্তিদের সমাজের সাধারণ আর দশটা জায়গা থেকে সরিয়ে রাখা হচ্ছিলো, সেটাও যে ব্যবহার করে ভালো কোনো ফলাফল নিয়ে আসা যায় তা বুঝতে শুরু করেছে সবাই। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা এখন যে শুধু বিদ্যালয়ে নয়, কর্মস্থলেও স্থান করে নিতে পারে তার উদাহরণ হিসেবেই এবার ‘আল্ট্রানটস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করেছে। পূর্বে আলট্রা টেস্টিং নামে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মীর শতকরা ৭৫ শতাংশই অটিজমে আক্রান্ত।
আমাদের সবার মস্তিষ্ক একরকমভাবে কাজ করে না। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত রাজেশ আনন্দের এই সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটি সেই ব্যাপারটিকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এমআইটিতে বন্ধু আর্ট শেক্টম্যানের সাথে একত্রে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার সময় রাজেশের মূল লক্ষ্যই ছিল ব্যবসায় স্নায়ু সংক্রান্ত ভিন্নতায় ভুগছেন এবং অটিজমে আক্রান্ত আছেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে, তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ভালো ফলাফল বের করে আনা যায় সেটা সবাইকে দেখানো।
মাইক্রোসফট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও যে অটিজমে আক্রান্ত এবং স্নায়ুসংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন এমন কর্মী নিয়োগ করছেন না তা নয়। তবে নিজেদের কোম্পানিকে একেবারেই আলাদা করে গড়ে তুলতে চাইছেন রাজেশ। অনেকের মধ্যে একজন হিসেবে নয়, বরং অটিজমে আক্রান্ত মানুষদেরকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে তাদের পাশাপাশি কয়েকজন সাধারণ মানুষকে নিয়োগ দিচ্ছেন তারা। রাজেশের মতে, অনেকদিন ধরেই এমন বিশাল একটা সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে আসছিলো সবাই। নিজেদের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মী নিয়গের ক্ষেত্রে নতুন একটি মাইলফলক যোগ করতে চান তারা।
ইদানিং কর্মক্ষেত্রে নিউরোডাইভার্সিটি ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। এখানে নিউরোডাইভার্সিটির মধ্যে অটিজম, ডাইসলেক্সিয়া এবং এডিএইচডির মতো ব্যাপারের কথা বলা হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাদ দিলেও, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশেও কর্মক্ষেত্রে অটিজমে আক্রান্ত কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় সমস্যাটি হয় সাধারণ আচরণ করার ক্ষেত্রে। এই যেমন- আপনি আপনার একজন সাধারণ কর্মীকে যেমন সময় বেধে দিতে পারেন বা নির্দিষ্ট আচরণ করতে বলতে পারেন। অটিজমে আক্রান্ত কর্মীরা সেক্ষেত্রে শুধু আচরণে নয়, কাজেও হন অসাধারণ। তাই, তাদেরকে ঝরে পড়তে হয় চাকরিতে আবেদন করার আগেই। অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা এই মানুষটিকে আপনি ‘পাঁচ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান’ এমন গৎবাঁধা প্রশ্ন করলে তিনি সেটাকে নিয়ে মানসিক চাপে পড়তে পারেন। সাধারণ কোলাহলে ভরপুর একটি কর্মক্ষেত্র তার জন্য সুবিধাজনক না-ও হতে পারে। একটি দলে কাজ করার মানসিকতা হয়তো সবসময় তার থাকবে না। তবে হ্যাঁ, তার কাজ, সেটা কিন্তু চমৎকার হবে। আপনার প্রতিষ্ঠানকে অসাধারণ কিছু উপহার দিতে সক্ষম এই প্রতিভাবান মানুষটি। একটু আলাদা হওয়ায় ঝরে পড়ার এই সম্ভাবনাটি বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আরও বেশি থেকে যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে নিউরোডাইভার্সিটি থাকা স্বত্ত্বেও একজন মানুষ পড়াশোনা শেষ করতে পারছেন। কিন্তু তারপর? তারপর চাকরিক্ষেত্রে নিজের জায়গাটা খুঁজে পেতে তার কষ্ট হচ্ছে। এজন্য কর্মী নিয়োগের পদ্ধতিকেই দায়ী করেন রাজেশ আনন্দ। তার মতে, নিয়োগ পদ্ধতি বদলাতে হবে। আল্ট্রানট ঠিক এই পদ্ধতিটিই অবলম্বন করেছে। প্রথমে প্রার্থীদের কিছু কাজ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের কাজ করার ক্ষমতা এবং নির্দেশনা নেওয়ার ক্ষমতা দেখে পরবর্তী ধাপে ঘরে বসে নিজের সুবিধামতো সময়ে এক সপ্তাহের একটি প্রজেক্ট দিয়েছে। ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে যে, এই প্রক্রিয়ায় চাকরি পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির ৭৫ শতাংশ কর্মীই অটিজমে আক্রান্ত।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং বিআইএমএ-এর একটি গবেষণায় জানানো হয় যে, কর্মক্ষেত্রে নিউরোডাইভার্সিটি থাকলে এতে করে প্রতিষ্ঠানটি সহজেই সাফল্য লাভ করে। কারণ, একেকজন মানুষ একেকভাবে ভাবতে সক্ষম হওয়ায় উদ্ভাবন সহজে হয়। আর কোনো সমস্যা তৈরি হলে সেটার সমাধান করাও সহজ হয়। আপনি হয়তো যতটা আশা করছেন তার চেয়ে অনেকগুণ ভালো ফলাফল নিয়ে আসছে এই একটু ভিন্ন মানুষটিই। তার কারণ, সে আপনার চেয়ে ভিন্নভাবে ভাবছে। নিউরোডাইভার্সিটিতে ভুগছেন এমন ব্যক্তিকে কর্মী হিসেবে নিয়োগ করলে শুধু যে ব্যক্তি নিজে উপকৃত হচ্ছেন তা নয়। একইসাথে, প্রতিষ্ঠানের বাকিরাও নতুনভাবে চিন্তার অনেকগুলো পদ্ধতি শিখতে সক্ষম হয় এর মাধ্যমে।
কর্মক্ষেত্রে একজন অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি তখনই কাজ করতে পারবেন, যখন তিনি সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাবেন। আর এই সহযোগিতাটুকু করার জন্য আপনার এটা জানতে হবে যে, এর সঠিক কৌশল কোনগুলো। চলুন, দেখে নেওয়া যাক-
১) সবাই এক নয়
অনেকেই অটিজমে আক্রান্ত সবাইকে একইরকম ভেবে থাকেন। তাই তাদের সাথে একই ব্যবহার করেন এবং একই ব্যবহার প্রত্যাশা করেন। কিন্তু ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। অটিজমে আক্রান্ত দুজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ দু’রকম হয়ে থাকে। আপনি যেমন অন্য একজন মানুষের চেয়ে আলাদা, এখানেও সেই একই ব্যাপার কাজ করে।
২) অটিজম সবসময় সমানভাবে প্রকাশ পায় না
আপনার কোনো মানুষকে দেখে অটিস্টিক মনে হচ্ছে না বা কোনো একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে কাজ করছেন, সফল হচ্ছেন- এর মানে এই নয় যে তিনি অটিজমে আক্রান্ত নন। অটিজমে আক্রান্ত হওয়া মানে এই নয় যে তিনি পাগলামি করবেন। সবসময় কিছু শোনা কথার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করুন। অটিজমের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় থাকতে পারে। তাই, অটিজম সংক্রান্ত পুরো জ্ঞান না থাকলে সেখান থেকে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যাচাই না করাটাই ভালো।
৩) যোগাযোগে সহজ হোন
এমন নয় যে, অটিজমে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি সবসময় আপনার সাহায্য চাইবেন বা কখনো চাইবেন না। ব্যাপারটি ঠিক আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই সহজ। বাড়তি কোনো সাহায্যের বদলে আপনার পাশের মানুষটি যখন কিছু জানতে চাইছেন বা কোনো ব্যাপারে আপনার সাহায্য আশা করছেন, তখন তাকে সেটা দিন। সরাসরি কথা বলা, আলোচনা ও সাহায্য করা- আর সবার মতো অটিস্টিক মানুষের জন্যও এটিই যথেষ্ট।
৪) তার চারপাশটা নিজের মতো করে সাজাতে দিন
সাধারণ আর দশটা মানুষের থেকে অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি বেশি কাজ করে। হয়তো খুব ছোট্ট একটি জিনিস, হয়তো টেবিলের ফুলদানিটা ডান থেকে বামপাশে রাখা আছে, সেটাতেও বড় রকমের মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন অটিস্টিক একজন ব্যক্তি। তার কাজে এর প্রভাব পড়তে পারে। আর তাই তিনি যেভাবে থাকতে পছন্দ করেন, তাকে সেভাবেই থাকতে দিন। খুব ভালোভাবে সবার সাথে সামাজিকতা রক্ষা করা হয়তো এই মানুষটির পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আপনি তাকে নিজের মতো থাকতে দিলে পুরো ব্যাপারটি তার জন্য অসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্যের হয়ে উঠবে।
৫) প্রয়োজন অনুসারে সাহায্য করুন
আপনার পাশের অটিজমে আক্রান্ত মানুষটি হয়তো আপনার চেয়েও ভালোভাবে কাজটি করতে পারবেন। তবে এজন্য তার দরকার হবে নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের। অনেকের এক্ষেত্রে খুঁটিনাটি তথ্য জানার দরকার হয়, অনেকের তার প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর জানার দরকার হয়, অনেকে আবার চান সামনের মানুষটা যেন তার কথা মন দিয়ে শোনে। এই সাহায্যটুকু করুন। তাহলেই নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারবেন পাশের মানুষটি।
৬) সুযোগ যেন সমান হয়
একজন অটিস্টিক ব্যক্তি কিন্তু সাধারণ একজন মানুষের চাইতে কম বুদ্ধিমান নন। ক্যারিয়ার নিয়ে ঠিক সাধারণ একজনের মতোই ভাবেন তিনি। ভালো কিছু অর্জন করলে খুশি হন। তাই অটিজমে আক্রান্ত বলেই কাউকে নিয়োগ দিয়ে অবহেলা করাটা মোটেই উচিত কাজ নয়। অন্যদের মতোই ভালো কাজে তারও প্রশংসা করুন, তাকে স্বীকৃতি দিন।
অটিজম কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। বরং, সাধারণের চাইতে একটু আলাদা এই মানুষগুলো নিজের মতো করেই অসাধারণ। তাই নিজেকে মানসিকভাবে গড়ে তুলুন, বিকশিত করুন। কর্মস্থলে আপনার পাশাপাশি এই বিশেষ মানুষগুলোকেও সুযোগ দিন। তার কাজ করার পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে আরও লাভবান হোন।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
অটিজম নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) অটিজম : আমাদের অ-সাধারণ শিশুরা
২) এবিএ : অটিজম ম্যানেজমেন্ট টেকনিক
৩) অটিজম সম্পর্কে বিস্তারিত জানবেন যে বইগুলো পড়ে।