প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-তে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯১৮-তে। কিন্তু ভয়াবহ এই যুদ্ধের চার বছর পরেও যুদ্ধের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছিলো চলমান- রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সহ সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু ১৯২২ সাল বেছে নেয়া কেন? কারণ যুদ্ধ চলেছিলো চার বছর ধরে, তাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক চার বছর পর সমাজ তথা বিশ্ব কোথায় গিয়ে পৌঁছলো সেটা বিশ্লেষণ করাই মূল উদ্দেশ্য। এই বিশ্লেষণ করেছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড ওভারি, তিনিই প্রথম ‘বিবিসি বিশ্ব ইতিহাস’ এ ১৯২২ সালের ঘটনাবহ তুলে ধরেছিলেন।
১৯১৮-তে হয়তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু রাজনৈতিক আর সামাজিক সমস্যা ইউরোপের পশ্চিম অংশে আরো কিছু দিন হজম করতে হয়েছিলো। ১৯২২ সাল নাগাদ যুদ্ধোত্তর ক্ষমতার ভারসাম্যের রূপ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। এই ১৯২২ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার জয়লাভের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ, যা ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে শুরু হয়েছিলো।
এর ফলেই গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, কদিন পরেই জোসেফ স্ট্যালিনকে কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। নতুন ধারার আরম্ভ ঘটে ইতালিতেও, একই সময় ফ্যাসিবাদি নেতা বেনিতো মুসোলিনি রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলকে চাপ সৃষ্টি করে বাধ্য করেন তাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে। মুসোলিনির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম স্বৈরতন্ত্রের।
এদিকে ১৯২২ সালে তুরস্কে মোস্তফা কামাল নামে এক সামরিক কর্মকর্তা তুর্কি সেনাবাহিনীকে সুসংগঠিত করে বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন গ্রিসের দখলে থাকা পশ্চিম আনাতোলিয়া ছিনিয়ে নিতে। ব্যাপক যুদ্ধ আর নৃশংসতার পর তুরস্ক গ্রিসের কাছ থেকে ‘ইজমির বন্দর’ ছিনিয়ে নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯২৩ সালে গঠিত হয় আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র।
একই সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের টালামাটাল অবস্থা শুরু হয়। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তি’র মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় ব্রিটেন। ভারতীয় উপমহাদেশেও তখন চলেছে তীব্র আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে ১৯২০ সাল নাগাদ, যা প্রতিনিয়ত তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। এরপর এই ১৯২২ সালেই মহত্মা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হয়, অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের। তাঁকে ছয় বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
নারী স্বাধীনতা
১৯২২ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন, আয়োজক ছিলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। সম্মেলনে উপস্থিত হয় অসংখ্য নারী রাজনৈতিক কর্মী, যাদের অনেকেই আবার তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে নিয়েই সম্মেলনে হাজির হয়েছেন। এই নারী রাজনৈতিক কর্মীরা সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে তাদের অকুন্ঠ সমর্থন জানানোর জন্য। সেসময় ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় নারীরা যে পরিমাণ অবদান রেখেছেন তা ছিলো তৎকালীন পশ্চিমা বিশ্বের চেয়েও অগ্রগণ্য।
শিল্পকর্মের ভবিষ্যত রূপায়ণ
বিশ্বখ্যাত রুশ চিত্রশিল্পী ভাসিলি ক্যান্ডিস্কি ১৯২২ সালে আঁকেন তার জগদ্বিখ্যাত পেইন্টিং ‘Untitled’। একই বছরে তিনি জার্মানির ওয়েইমারে ‘বাউহাউজ আর্ট এন্ড ডিজাইন স্কুল’ এ অধ্যাপনায় ঢোকেন। বিমূর্ত চিত্রশিল্পের জগতে ভাসিলি ক্যান্ডিস্কিকে একজন অগ্রগণ্য শিল্পী হিসেবে মানা হয়। তিনি সেসময় বিমূর্ত চিত্র নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করা শুরু করেন এবং শিল্পের প্রথাগত নিয়ম কানুনকে চ্যালেঞ্জ করেন। এর মাধ্যমে তিনি অনেক সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল মতবাদ তৈরী করেছিলেন, যা কয়েক প্রজন্মের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে আজকের তরুণ শিল্পীদের মাঝে স্থায়ী হয়েছে।
দারিদ্র্য-পোষা কুকুর নিয়ে বিপাকে বার্লিনবাসী
১৯২২ সালের কোনো এক সকাল বেলায় বার্লিনের পশু চিকিৎসা কেন্দ্রের বাইরে লম্বা লাইন। বার্লিনের অসচ্ছল মানুষেরা তাদের কুকুরগুলো নিয়ে এসেছেন চিকিৎসকের মাধ্যমে মেরে ফেলতে, কারণ কুকুরকে খাওয়ানোর পয়সা নেই তাদের। সদ্য শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে জার্মানির অবস্থা তখন বিধ্বস্ত, তার উপর রয়েছে মিত্রদেশগুলোর ক্ষতিপূরণের দাবিদাওয়া। ১৯২২ সালে শুরু হয় উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ফলে লাখো জার্মান অধিবাসী পড়ে তীব্র খাদ্য সংকটে। এরকম অবস্থায় কুকুর পোষা একটা বিলাসিতার নামান্তর।
উচ্চতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা
কাজটা সেই সময় ছিলো উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়েও বেশি কিছু, মাউন্ট এভারেষ্টে আরোহণ। ১৯২২ সালে বৃটিশ পর্বতারোহীদের একটি দল প্রথমবারের মতো ৮,৩২৬ মিটার পর্যন্ত উঠতে সক্ষম হয়। এটা ছিলো এভারেষ্টের চূড়ায় আরোহণের প্রথম অভিযান। পর্বতারোহীরা প্রথমে ৭,০০০ মিটার উচ্চতায় উঠে ক্যাম্প স্থাপন করে, এরপর বাকিটা ওঠার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু অভিযানটি ব্যর্থ হয় এক তুষার ধসে, অভিযাত্রীদের মধ্যে ৭ জন সেই ধসে নিহত হয়। ১৯২২ সালের এই দুঃসাহসিক অভিযান ব্যর্থ হলেও এটিই ছিল পথ প্রদর্শকদের প্রথম পদক্ষেপ।
একজন শিল্পীর প্রতিকৃতি
উপরের ছবিটি আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জোয়েসের, এটি ১৯২২ সালে তোলা। এই বছরেই তিনি প্রকাশ করেন তার উপন্যাস ‘ইউলিসিস’, যেটাকে বিবেচনা করা হয় মর্ডানিজম ঘরানায় একটা মাস্টারপিস হিসেবে, যা তিনি লিখেছিলেন সমসাময়িক সাহিত্যের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে, কিন্তু রীতিবিরুদ্ধ কিছু বিষয়াদি ও ভাষার প্রয়োগে। ফলে ব্রিটেনে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সাহিত্যের ইতিহাসে এটা পরিণত হয় মর্ডানিজম ঘরানার পথিকৃৎ হিসেবে।
মর্ডানিজমের দুনিয়ায় স্বাগতম
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে একটা পোস্টার দেখা গেলো, যেটায় আছে একটা বিজ্ঞাপন ‘Semana de Arte Mordena’ (আধুনিক শিল্প সপ্তাহ)। এটা ছিলো ব্রাজিলের আধুনিকতাবাদী শিল্পীদের আয়োজনে একটি সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান, যার মধ্যে ছিলো চিত্র প্রদর্শনী, কবিতা পাঠ এবং শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে বিতর্ক ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে ব্রাজিলে ‘মর্ডানিজম’ ধারণা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলেও, ঐ সময় অনুষ্ঠানটি প্রথাগত শিল্পী ও সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রতিকূল আচরণের শিকার হয়।
জাহাজী ‘রানওয়ে’তে এলো সাফল্য
রাজকীয় জাপানি নৌবাহিনীর জাহাজ ‘আই জে এন হোশো’ পৃথিবীর প্রথম বিমানবাহী রণতরী, যেটা কমিশন্ড হয়েছিলো ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে। ‘ওয়াশিংটন নৌ চুক্তি’ অনুসারে (এই চুক্তিটিও ১৯২২ সালেই সাক্ষরিত হয়) জাপান তার নৌবাহিনীর আকার ছোট রাখতে চুক্তিবদ্ধ ছিলো। ফলে এই সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে নিতে জাপান এই বিমানবাহী রণতরীটি তৈরী করে এবং নৌবাহিনীতে যুদ্ধ বিমান সংযোজন করে। এটা ছিলো খুবই কার্যকরী এক উদ্যোগ, যার জোরে ১৯ বছর পরে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার ঘাঁটি হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এরপর থেকেই শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ বিমানবাহী রণতরী তৈরীতে মনযোগ দেয়, যেগুলো আজ বিশ্বে সামরিক শক্তিমত্তার প্রতীক।
ইতালির ‘কালো দিবস’
১৯২২ সালের অক্টোবরে ইতালির ফ্যাসিবাদি দলের নেতা বেনিতো মুসোলিনি একটি প্রোপাগাণ্ডা পোস্টকার্ড ছাড়লেন, যাতে ‘কালো পোষাকধারী মিলিশিয়া’দের আহ্বান জানানো হয়েছে রাস্তায় নেমে রাজা ইমানুয়েলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে। যুদ্ধোত্তর ইতালি তখন সমস্যায় জর্জরিত, ফলে মানুষ অতিষ্ঠ। মুসোলিনির এই ফিকিরটা কাজে দেয়, প্রায় ২৫,০০০ লোক কালো শার্ট পরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে রাজাকে উৎখাত করে মুসোলিনির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। যদিও তার ছিলো সংসদে মাত্র ৩৫টি আসন।
নারীর তৈরী আগ্নেয়াস্ত্র
১৯২২ সালে তুরস্কের সমরাস্ত্র কারখানায় মহিলারা নিজ হাতে অস্ত্র তৈরী করা শুরু করে, উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদী গ্রিসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে সৈন্যদের পাশে দাঁড়ানো। মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে চালানো তীব্র যুদ্ধে গ্রিসের বাহিনীকে পশ্চিম আনাতোলিয়া থেকে বিতাড়িত করে তুর্কি সেনারা। তাই উল্লসিত কবি কাজি নজরুল লিখে ফেললেন,
ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর সে সামাল-সামাল তাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
সমাধি অভিযান
বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২২ সালেই আবিষ্কার করেন মিসরীয় ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি প্রকোষ্ঠ। কবরটির ভেতরে অলংকৃত লিপি পাওয়া যায়, যেটা প্রচুর ধনসম্পদ ও অলংকারাদি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলো। এই অভিযান প্রায় ৭ বছর ধরে চলমান থাকে এবং প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধার করা হয়। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই পশ্চিমা বিশ্বে প্রাচীন মিসর নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
ফিচার ছবি- কোলাজ