ভূ-রাজনীতির এক অবাক করা বিষয় হলো এর প্রাসঙ্গিকতা। আপাতভাবে দুটো জিনিস শুনে হয়তো মনে হতে পারে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্কই থাকতে পারে না। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার লড়াইয়ে হয়তো এমন কোনো দেশের নাম চলে আসতে পারে যার নামই হয়তো আমরা কখনো শুনিনি।
আফ্রিকার নাম না জানা কোনো এক দেশের ভেতরকার একটি ঘটনার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের গদিচ্যুত হওয়ার উপক্রম হয়, আবার এক দেশের ধর্মীয় কোনো কারণে আরেক দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। সাদামাটাভাবে ভাবলে কারণগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও মূলত এগুলো একই সূত্রে গাঁথা। আর এ জাতীয় ব্যাপারগুলোই ভূ-রাজনীতির মজাদার দিক।
তেমনই একটি ঘটনা হলো ‘ইরান-কন্ট্রা অ্যাফেয়ার’ বা বাংলায় বলতে গেলে কিছুটা শব্দ বদলে বলতে হয় ‘ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারী’।
আশির দশকের শুরুতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে হোয়াইট হাউজে যোগ দেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী রিগ্যান পর পর দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আর এই ঘটনার শুরুটা তার প্রথম মেয়াদে, অর্থাৎ ১৯৮১ সালের পর শুরু হলেও মূল কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটে তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে, ১৯৮৫ সালের পর।
ঘটনাটি যখন প্রকাশ পায় তখন রিগ্যানের ক্ষমতাও প্রায় শেষের দিকে, এজন্য রিগ্যানকে দোষ স্বীকার করতে হলেও আইনী ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কিন্তু প্রায় অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের উপক্রম হয়ে ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারীর পর এটাকেই বলা হয় মার্কিন রাষ্ট্রপতির জন্যে সবচেয়ে অপমানজনক ঘটনা।
পুরো ঘটনার জাল শাখা-প্রশাখা সমেত অনেক লম্বা। ফলে সব দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা না জানলে চলবে না। এই ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো কত জটিল হয়ে থাকে।
অধ্যায় ১: নিকারাগুয়া- ঘটনার শুরু যেভাবে
আশির দশকের শুরুতে স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। পুঁজিবাদ নাকি কমিউনিজম কোনটা টিকে থাকবে শেষ পর্যন্ত সেটার লড়াই চলছে সারা বিশ্বে। রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিলো যেকোনো মূল্যে তিনি কমিউনিজম প্রতিহত করবেন। রিগ্যানের শাসনামলে সিআইএ’র সহযোগীতায় সারা বিশ্বেই কমিউনিস্ট বিরোধী গেরিলাদের প্রকাশ্যে ও গোপনে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
রিগ্যান নিকারাগুয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন। এই দেশে ১৯৭৯ সালে কিউবার সহায়তায় কমিউনিস্টপন্থী স্যান্ডানিস্টাস নামক দল ক্ষমতা দখল করে নেয়। স্যান্ডানিস্টাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল ডানপন্থী গেরিলা সংগঠন ‘কন্ট্রা’। রিগ্যান এই কন্ট্রা গেরিলাদেরকে মার্কিন জাতির পিতাদের সাথে তুলনা করে অভিহিত করেন ‘Moral equivalent of our founding fathers’ এবং যেকোনো মূল্যে এদেরকে সহায়তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এখন সমস্য হলো এই ডানপন্থী গেরিলা দল কন্ট্রা মধ্য আমেরিকার কোকেন বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিলো। ফলে এই তথ্য যখন সামনে এলো তখন এরকম একটা গেরিলা দল, যারা কি না মাদক চোরাকারবারের সাথে যুক্ত, তাদেরকে সামরিক সহায়তা দেয়ার কোনো নৈতিক ভিত্তি আর থাকে না। ফলে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ‘বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’ নামে এক আইন পাস করে যার মূল বক্তব্য ছিলো কোকেন বাণিজ্যে যুক্ত এই সংগঠনকে কোনো প্রকার সহায়তা করা যাবে না।
সিআইএ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় উভয়কেই কন্ট্রাকে কোনো প্রকার সাহায্য না করার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে রিগ্যান সরকারের কন্ট্রাকে সহায়তা করার আর কোনো আইনগত ভিত্তি থাকলো না। কিন্তু রিগ্যান সিআইএকে নির্দেশ দিলেন, কংগ্রেস যা-ই বলুক, কন্ট্রাকে গোপনে অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে যেতে। যদিও তখনো ঠিক হয়নি কংগ্রসকে পাশ কাটিয়ে এই অর্থ আসবে কোথা থেকে।
অধ্যায় ২: ইরান প্রসঙ্গ
১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামিক বিপ্লবীরা ক্ষমতায় আসে। ঐ সময় ইরানী বিপ্লবীরা ইরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নিয়ে প্রায় ৫২ জন মার্কিনীকে জিম্মি করে ফেলে। এ নিয়ে ২০১২ সালের অস্কার প্রাপ্ত সিনেমা Argo মুক্তি পায়।
এই জিম্মি ঘটনার পর মার্কিন সরকার তাৎক্ষণিক ইরানের সাথে সব রকম সম্পর্ক তো ছিন্ন করেই, ইরানের উপর বাণিজ্যিক ও সামরিক অবরোধ আরোপ করা হয়। এর ফলে ইরান যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো বাণিজ্যিক ও সামরিক সহায়তা পাবে না। যদিও ইসলামী বিপ্লবের আগপর্যন্ত পূর্বের মার্কিন অনুগত সরকার ঢালাওভাবে মার্কিনী অস্ত্র পেয়ে আসতো। ফলে তৎকালীন ইরানের অস্ত্রভান্ডার ছিলো মার্কিনী অস্ত্রে পরিপূর্ণ।
ইরান যাতে কোনোভাবেই অস্ত্র না পায় সেজন্য মার্কিন সরকার ‘অপারেশন স্টান্স’ নামে এক কূটনৈতিক মিশন হাতে নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিলো সারা বিশ্বে মার্কিন কূটনৈতিকদের দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও অস্ত্র উৎপাদনকারীদের বোঝানো যে ইরান সন্ত্রাসবাদের সমর্থক, সুতরাং ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা অনৈতিক।
এখন ব্যাপার হলো, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরে তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা না হলেও ঝামেলা হলো ১৯৮০ সালে ইরাকের সাথে ইরানের যুদ্ধ বেঁধে গেলে। ইরানী অস্ত্র ভান্ডার মার্কিনী অস্ত্রে ঠাসা। ফলে এগুলোর গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশ যা লাগে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ইতিমধ্যে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে, ফলে কোনো দিক থেকে ইরানকে সহায়তার প্রশ্নই আসে না। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালের এক গবেষণার পর রিগ্যানের কিছু উপদেষ্টা তাকে এটা বোঝালেন যে, ইরানের উপর এই সামরিক নিষেধাজ্ঞার কোনো মূল্য নেই। কারণ ইরান চাইলেই অন্য কোনো দেশ, যাদের কাছে মার্কিনী অস্ত্র আছে, তাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, মার্কিনীরা অস্ত্র বিক্রি না করলে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারস্থ হতে পারে। ফলে ইরান ‘সোভিয়েত বলয়ে’ চলে যেতে পারে।
তো যা-ই হোক, দেখা গেল ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করাটাই বেশি লাভজনক। টাকা তো আসবেই, উপরন্ত সোভিয়েত প্রভাবও ঠেকানো যাবে। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা কি আর এত সহজে সমাধান হওয়ার জো আছে!
অধ্যায় ৩: মার্কিন নাগরিক জিম্মি- মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
এর মধ্যে আরেক ঘটনা হয়ে গেলো ১৯৮৫ সালে। লেবাননে ইরানপন্থী এক গেরিলা গ্রুপ (ধারণা করা হয় হিজবুল্লাহ) ৭ জন আমেরিকানকে অপহরণ করে জিম্মি করে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান তার উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন যেকোনো উপায়ে এই জিম্মিদের উদ্ধার করার। তিনি তার উপদেষ্টাদের বলেন,
I want you to do whatever you have to do to help these people keep body and soul together
যদিও রিগ্যান সংবাদমাধ্যমের কাছে বললেন চিরায়ত সেই বাণী, যা সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট সকাল সন্ধ্যা বলে থাকেন, “We will not negotiate with terrorists.”
অধ্যায় ৪: সমাধান
নিকারাগুয়ার কন্ট্রা গেরিলাদের অর্থ-অস্ত্র দিতে কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা, ইরানে অস্ত্র রপ্তানির মতো লোভনীয় ব্যাপারেও কংগ্রেসের নিষেধ, তার উপর আবার লেবাননে মার্কিন নাগরিকদের জিম্মি হওয়া ইত্যাদি সব কিছু তালগোল পাকালেও এই সব কিছু দাবার গুটির মতো এদিক ওদিক করে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
রিগ্যান ইরানের সাথে গোপনে চুক্তি করেন যে তাদের প্রয়োজনীয় প্রায় ১,৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র তাদেরকে দেয়া হবে। বিনিময়ে ইরানকে যেটা করতে হবে তা হলো লেবাননের গেরিলা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে জিম্মিদের মুক্তি দিতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, এই গেরিলারা ইরানপন্থী এবং এদের উপর ইরান সরকারের প্রভাব ছিলো। ইরান কথা দেয় অস্ত্র সরবরাহ করা হলে তারা মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
ইরানের কাছে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ১,৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করা হয়। এর বিনিময়ে ইরান সরকারের প্রচেষ্টার ফলে গেরিলারা ৩ জন জিম্মি মুক্তি পায়। অস্ত্রের বিনিময়ে মার্কিন সরকার ৩০ মিলিয়ন ডলার পায়। মজার বিষয় হলো, এই ৩০ মিলিয়ন ডলারের পুরোটা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে না পাঠিয়ে মাত্র ১২ মিলিয়ন কোষাগারে জমা হয়। বাকি ১৮ মিলিয়ম ডলার নিকারাগুয়ার কন্ট্রা গেরিলাদেরকে সহায়তা হিসেবে পাঠানো হয়।
সুতরাং সংক্ষেপে যা হলো-
- ইরানকে গোপনে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র বিক্রি করা হলো (নিজেদেরই আরোপ করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে)
- অস্ত্র পেয়ে ইরান গেরিলাদের উপর চাপ দিয়ে কিছু জিম্মিকে মুক্ত করে
- ৩০ মিলিয়ন থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে তা কন্ট্রা গেরিলাদের দেয়া হয় বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট আইন উপেক্ষা করে
কেলেঙ্কারীর শুরু
১৯৮৬ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ লেবাননের আস-শীরাআ কোনো মারফত জানতে পেরে পত্রিকায় ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির ঘটনা ফাঁস করে দেয়। ফলে কীভাবে জিম্মিরা ছাড়া পেয়েছে সেটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এই নিয়ে তদন্ত শুরু করেন।
তদন্তে শুরু হলে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এক মেরিন কর্নেল অলিভার নর্থ কিছু কাগজ ও প্রমাণাদি নষ্ট করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তদন্তে দেখা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপদস্থ পাঁচ-ছয়জন এই কাজে লিপ্ত, যারা প্রেসিডেন্টের নির্দেশেই এই কাজ করেছেন। পরিহাসের বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র যে সময় এই অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো, ঠিক সেই একই সময়েই মার্কিন কূটনীতিবিদরা ‘অপারেশন স্টান্স’ এর মাধ্যমে সারা বিশ্বকে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছিলো কেন ইরানকে অস্ত্র বিক্রি করা ঠিক না। এর ফলে সারা বিশ্বে মার্কিন কূটনৈতিকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
তদন্তে দেখা যায়, ইরানের কাছ থেকে পাওয়া ৩০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন ডলার গায়েব, যা ‘বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’ ভঙ্গ করে রিগ্যান নিকারাগুয়ার কন্ট্রা গেরিলাদেরকে পাঠিয়েছেন। কন্ট্রা গেরিলাদেরকে বেশ কয়েকটি বিমানে করে অস্ত্রও পাঠানো হয়েছিলো, যার মধ্যে একটি বিমান নিকারাগুয়ার বামপন্থী স্যান্ডনিস্টাস গেরিলারা ভূপাতিত করে পাইলটদের আটক করে।
আটক পাইলট ধরা পড়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন যে তিনি সিআইএ’র হয়ে অস্ত্র নিয়ে আসছিলেন। এর ফলে পুরো বিশ্বের সামনে যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকবার বিব্রত হতে হয়। এই ঘটনার পর রিগ্যানের বোল্যান্ড অ্যামেন্ডমেন্ট ভঙ্গ করার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সামনে চলে আসে।
ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারীর পর ঘটা সবচেয়ে বড় এই কেলেঙ্কারীতে রিগ্যান প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার জেল হয়। যদিও স্বয়ং রিগ্যানকে কোনো আইনী ঝামেলায় পড়তে হয়নি। ক্ষমতা শেষ হতে অল্প কিছু সময় ছিলো, যা তিনি ভালোভাবেই ওভাল অফিসে পার করেন। তবে বিশ্লেষকদের সবারই অভিমত, রিগ্যান শুরু থেকেই সব জানতেন, তিনি দায় এড়াতে পারেন না।