আপনারা যারা ১৯৭৩ সালের গেটি অপহরণ কাণ্ড সম্পর্কে জানেন না, তাদের কাছে বোধহয় সাম্প্রতিক হলিউড সিনেমা ‘All the money in the world’ কিছুটা হাস্যকর আর অদ্ভুত লাগতে পারে। কেননা বাস্তবে এরকম হয় নাকি! কোটিপতি ব্যবসায়ীর নাতি অপহৃত হবে আর সে কিনা অপহরণকারীদের এক পয়সা দিতে রাজি হবে না! কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাস্তবেও অনেকটা এরকরমই হয়েছিলো প্রায়। তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যক্তি, তার নাতির মুক্তিপণের পয়সা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। চলুন জেনে নেয়া যাক আসলে কী ঘটেছিলো, আর ফলস্বরূপ ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ।
নাতির ব্যাপারে যাওয়ার আগে নানার আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া যাক। পুরো নাম জ্যঁ পল গেটি। গেটি নামটা পরিচিত ঠেকবে অনেকের কাছেই। সেটা মূলত ফটোগ্রাফি সংস্থা Getty Images এর কারণে। Getty Image হচ্ছে এই জ্যঁ পল গেটির আরেক নাতি মার্ক গেটির তৈরী সংস্থা। তো এই জ্যঁ পল গেটি ছিলেন আমেরিকায় জন্ম নেয়া একজন ব্রিটিশ শিল্পোদ্যোক্তা, যিনি ষাট-সত্তরের দশকে আরবে তেলের খনির ব্যবসা করে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী হয়েছিলেন। ‘৫৭ সালের ‘ফরচুন’ পত্রিকার জরিপ অনুযায়ী তিনি ‘বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আমেরিকান’ তকমা পান।
অনর্গল আরবি বলতে পারা এই ব্যবসায়ী সৌদি আরব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদকে ৯.৫ মিলিয়ন ডলার নগদ দিয়ে সৌদি আরবের একটি অঞ্চল ৬০ বছরের জন্যে ইজারা নিয়ে নেন, এখান থেকে উত্তোলিত তেল তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনীতে পরিণত করে। শেষ জীবনে তিনি শিল্প সংষ্কৃতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে বিনিয়োগে মনোনিবেশ করেন, গড়ে তোলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প সংগ্রহ। গেটি ফাউন্ডেশন, গেটি শিল্প জাদুঘর ইত্যাদি তারই গড়ে তোলা। তার আরেক নাতি মার্ক গেটির তৈরী Getty Images এই তেলের পয়সাতেই গড়া।
জ্যঁ পল গেটি পরিচিত ছিলেন খুবই কৃপণ হিসেবে। পাঁচবার সংসার ভেঙে যাওয়া এই ব্যক্তি একবার তার পঞ্চম স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করেছিলেন শিশু পুত্রের চিকিৎসায় পয়সা বেশি খরচ করার জন্যে। তার কৃপণতার আরেকটা কাহিনী রীতিমতো বিশ্ববিখ্যাত, আর সেটা হলো নিজের বাড়িতে কয়েন চালিত ‘পে ফোন’ চালু করা! বাড়িতে আগত অতিথিদের কারো ফোন করার দরকার হলে গাঁটের থেকে পয়সা ফেলে ফোন করতে হতো। তো এমন একজন ব্যক্তি নাতির মুক্তিপণ দিতে চাইবেন না, সেটাই তো স্বাভাবিক!
অপহরণ কাণ্ড
১৯৭৩ সালে জ্যঁ পল গেটির নাতি, যার নাম জন পল গেটি বা পল গেটি । ইতালির রোম শহরে বসবাসরত ১৬ বছর বয়েসি এক কিশোর, লম্বা চুলে কেতাদুরস্ত, বাধাহীন আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। পরিবার থেকে সে ছিলো বিচ্ছিন্ন, উপরন্তু বাবার সাথে তার মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে নানা জ্যঁ পল তো দূরের কথা, বাবার সাথেও তার প্রায় এক দশকের মতো যোগাযোগ ছিল না। রাতে চলত ক্লাবে বল্গাহীন জীবন যাপন, চিত্রকর্ম আর হাতে তৈরী অলংকার বিক্রি করে খরচ চালাতো সে। সে যে সম্ভ্রান্ত গেটি পরিবারের সদস্য অনেকেই সেটা জানত, ফলে তার নাম ছিলো ‘The golden hippie’
১৯৭৩ সালের জুলাইয়ের ১০ তারিখ দুপুর আনুমানিক ৩ টার দিকে জন গেটি তার বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটছিলো, এমন সময় একটা গাড়ি তার পাশে এসে থামে। গাড়ির ভেতরকার এক লোক জিজ্ঞাসা করে “এক্সকিউজ মি জনাব, আপনি কি পল গেটি?” জবাবে সে “হ্যাঁ” বলার সাথে সাথে অপহরণকারীরা তাকে জোরপূর্বক ভেতরে টেনে তুলে নেয় এবং ইতালির দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে রওনা দেয়।
ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের এক পাহাড়ি গুহায় তাকে আটকে ফেলে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। অপহরণকারীরা তাকে একটা রেডিও দিয়েছিলো সময় কাটানোর জন্যে। পর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়াও দেয়া হতো এবং গুহার নিকটকার একটা পাহাড়ি ঝর্ণায় গোসলের ব্যবস্থাও করা হয়েছিলো। অর্থাৎ যাবতীয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা হয়, আসলে অপহরণকারীরা মনে করেছিলো যে মুক্তিপণ আদায়ের পুরো কাজটা তাড়াতাড়িই হয়ে যাবে।
তাকে অপহরণের দুদিন পর, অপহরণকারীরা তার মা গ্যালি হ্যারিসকে ফোন করে পুরো ব্যাপারটি জানায়। ফোন কলের পর আরো দশ দিন পর পলের মাকে তারা একটা ম্যাগাজিন থেকে কেটে কোলাজ করে বানানো ‘শৈল্পিক রঙচঙা’ চিঠিতে করে ১৭ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। চিঠিতে পুলিশের কাছে না যেতে হুমকি দেয়া হয়, জন পলের একটা চিরকুটও জুড়ে দেয়া হয় “প্রিয় মা, সোমবার থেকে আমি অপহরণকারীদের কবলে আছি, আমাকে বাঁচাও”।
পলের মা গ্যালি হ্যারিসের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগেই, তার উপর সাবেক স্বামীর সাথে যোগাযোগ নেই দশ বছরের উপরে। ফলে গেটি পরিবারের অঢেল সম্পত্তিতে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তিনি সেটা অপহরণকারীদের কাছে উল্লেখ করে বলেন যে এত টাকা তার নেই। এর জবাবে তারা জানায়, “আপনার শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা আনুন”।
শ্বশুরের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতে গ্যালি প্রথমে সাবেক স্বামীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্বামী জ্যঁ পল জুনিয়রও ছিলেন তার বাবা জ্যঁ পল গেটির থেকে বিচ্ছিন্ন এবং মদ্যপ। ফলে আর্থিক সাহায্য এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই তার দ্বারা সম্ভব ছিলো না, উপরন্তু সে তার বাবার কাছে টাকা চাইতেও অস্বীকৃতি জানায়। ফলে গ্যালিকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই শ্বশুর জ্যঁ পল গেটির সাথে যোগাযোগ করতে হয়।
কিন্তু গ্যালিকে দেখা দিতে শ্বশুর জ্যঁ পল গেটি গড়িমসি শুরু করেন। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন অন্তহীন প্রতীক্ষার পর দেখা দিলেন তিনি। কিন্তু সরাসরিই তিনি মুক্তিপণের জন্যে এক পয়সাও দিতে অস্বীকৃতি জানান। তার বক্তব্য ছিলো “আমার ১৪ জন নাতি আছে, আমি যদি এখন এক পয়সাও মুক্তিপণ দিই তাহলে পর্যায়ক্রমে আমার বাকি নাতিরাও অপহৃত হবে”।
প্রেসের সামনে যত নীতি কথাই আওড়ানো হোক না কেন, পত্রপত্রিকা সব জায়গায় জ্যঁ পল গেটি তার কৃপণতার জন্যই নিন্দিত হতে থাকলেন। জ্যঁ পল গেটির সেই সময়কার একদিনের আয় মুক্তিপণ পরিশোধের জন্যে যথেষ্ট ছিলো। আসলে তিনি শুরু থেকেই সন্দেহ করছিলেন যে তার নাতি তার কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্যে এই অপহরণ নাটক সাজিয়েছে।
মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে করতে অপহরণকারীরা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো। ফলে আগ্রাসী হয়ে একদিন তারা পলের কান কেটে ফেলে, এরপর কেটে ফেলা কান খামে ভরে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয় আসলেই পল গেটি অপহৃত হয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্যে। এরপর জ্যঁ পল গেটি কিছুটা নমনীয় হন অপহরণ কাণ্ড সম্পর্কে।
কিন্তু কিপটে নানার মন তখনো গলেনি! তিনি ফ্লেচার চেজ নামে এক সাবেক সিআইএ এজেন্টকে নিয়োগ করেন অপহরণ কাণ্ড তদন্তে। তো এই সাবেক সিআইএ’র গোয়েন্দা মহাশয় কিছু ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া আর উত্তেজনার যোগান দেয়া ছাড়া কাজের কাজ তেমন কিছুই করতে পারেন নি, যেসব ঘটনা আপনারা সিনেমায় দেখতে পাবেন।
পুরো কর্মকাণ্ডে একপর্যায়ে মার্কিন সরকার জড়িয়ে পড়ে, এফবিআই এর এক সদস্য অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগে সক্ষম হলে তিনি দর কষাকষি করে মুক্তিপণ ৩.২ মিলিয়ন ডলারে নামাতে সক্ষম হন।
জ্যঁ পল গেটি এতকিছুর পরও টাকা দিতে রাজি হলেন না। তিনি যেটা করলেন তা হলো, তার ছেলে জ্যঁ পল জুনিয়রের (অপহৃত পলের বাবা) উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির ভাগ হিসেবে ২.২ মিলিয়ন ডলার আর বার্ষিক ৪% হারে ১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিলেন! এই টাকা দিয়ে মুক্তিপণ পরিশোধ করা হয়, এরপর ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের অপহরণের পাঁচ মাস পর পল গেটিকে মুক্তি দেয়া হয়।
এই কাহিনী নিয়ে ২০১৭ সালে হলিউডে মুক্তি পায় জমজমাট থ্রিলার ‘All the money in the world’, যেটিতে ১৯৭৩ সালের এসব ঘটনা বেশ উপভোগ্য আকারে দেখা যাবে। আগ্রহীরা সিনেমাটি চাইলে দেখতে পারেন।
ফিচার ছবি- AP, Sony, UPI