Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রহস্যময় পাঁচ জাহাজডুবির কাহিনী

সমুদ্রের বুকে মানুষের বিচরণের ইতিহাস যতদিনের, জাহাজডুবির গল্পও চলছে ঠিক ততদিন ধরে। সম্প্রতি ইউনেস্কো প্রদত্ত একটি হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে ডুবে গেছে প্রায় তিন মিলিয়ন জাহাজ! হাজার বছরের এই জাহাজডুবির ইতিহাস মানুষের মুখে মুখে ঘুরেফিরে জন্ম দেয় রূপকথার। কিছু কিছু কাহিনী খুব সুন্দর করে নথিভুক্ত করা হয়েছে, আবার কিছু জাহাজডুবি ঘটেছে একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে। ইউনেস্কোর মতে, স্থানীয়দের বাধার কারণে জলসীমায় অনুপ্রবেশ করতে না পেরে যে জাহাজগুলো ডুবে গেছে, তার হিসাব কম-বেশি জানা যায়। কিন্তু অন্য যে জাহাজগুলো মাঝ সমুদ্রে ডুবে গেছে, তার সাথে মিশে আছে হাজারো রহস্য। সমুদ্রের ঢেউয়ে নয়, রহস্যময়ভাবে ডুবে যাওয়া বা সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যাওয়া পাঁচটি জাহাজের কাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন।

১) হারিয়ে যাওয়া প্যাট্রিয়ট

অ্যারন বার, যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রাক্তন কোষাগার সচিব আলেকজেন্ডার হ্যামিল্টনকে দ্বৈত লড়াইয়ে হত্যা করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু বারের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে অন্য এক মৃত্যু। তার কন্যা, থিওডোসিয়া, মাত্র ২৯ বছর বয়সে হারিয়ে যায় সমুদ্রের বুকে। ‘প্যাট্রিয়ট’ নামক একটি জাহাজ থিওডোসিয়া সহ বেশ কয়েকজন যাত্রী এবং নাবিককে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় চিরদিনের মতো। ১৮১২ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ক্যারোলিনা থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে যাচ্ছিল প্যাট্রিয়ট। থিওডোসিয়া বার যাচ্ছিলেন বাবার সাথে দেখা করতে। জাহাজটিকে শেষবারের মতো দেখা যায় ১৮১৩ সালের ২ জানুয়ারি। সে রাতে সমুদ্রে উত্তাল ঝড় ওঠে, উত্তর ক্যারোলিনা থেকে এমনই একটি খবর পাওয়া যায়। তারপর জাহাজটির কী হয়েছিল, সে খোঁজ পাওয়া যায়নি আর কখনো।

প্যাট্রিয়ট; Source: staticflickr.com

বার তার বাকি জীবন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে, জাহাজটি ডুবে গেছে আর তার মেয়ে মারা গেছে। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে জাহাজটি সম্পর্কে। কেউ কেউ বলেন, প্যাট্রিয়ট একবারও ঝড়ের কবলে পড়েনি, বরং জলদস্যুরা আক্রমণ করে যাত্রীদের যাবতীয় মালামাল লুট করে তাদের খুন করে। বছরের পর বছর ধরে আশায় বেঁচে থাকেন অনেকে, থিওডোসিয়া হয়তো বেঁচে আছে। সে হয়তো কোনোদিন ফিরে আসবে বাবার কাছে, অন্তত তার লাশ ভেসে উঠবে সমুদ্রের পাড়ে। কিন্তু বিধি বাম, এমনটা আর হয়নি কখনো। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, ১৮৬৯ সালে উত্তর ক্যারোলিনার এক বাড়িতে এক নারীর পোর্ট্রেট পাওয়া যায়, যার চেহারা হুবহু থিওডোসিয়ার সাথে মিলে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঐ বাড়ির কয়েকজন সদস্য জলদস্যু ছিল। তারা নাকি থিওডোসিয়াকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে চিকিৎসা করায়, কিন্তু যাত্রার দীর্ঘ ধকল আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণে হতবিহ্বল থিওডোসিয়া সেখানেই মারা যান। চিকিৎসারত সেবিকাকে জানান, নিউ ইয়র্কে বাবাকে উপহার দেয়ার জন্য ছবিটি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আফসোস, ছবিটি উদ্ধার করা গেলেও বাবার কাছে আর পৌঁছায়নি তা। মেয়ের জাহাজডুবির ২৩ বছর পরেই মারা যান অ্যারন।

২) দ্য মেরি রোজ

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির আমলে নির্মিত একটি রণতরী ‘দ্য মেরি রোজ’। রাজা হেনরি সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরেই অর্থাৎ ১৫০৯ সালের দিকে বানানো হয় এই জাহাজটি। সমুদ্রযাত্রার ইতিহাসের প্রথম দিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেয় মেরি রোজ, তবে তখন তার ভূমিকা ছিল অনেকটা স্টোর রুমের মতো। অর্থাৎ অন্য যুদ্ধজাহাজ থেকে লুণ্ঠিত মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো এই জাহাজটিকে। ১৫৪৫ সালে রাজা অষ্টম হেনরির সাথে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন পোপ। রাজার একের পর এক বিয়ে এবং ইউরোপের রাজতন্ত্রের সাথে ক্রমবর্ধমান সংকটপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের ফায়দা নিয়ে পোর্টসমাউথে ইংল্যান্ডের উপর আক্রমণের চেষ্টা চালায় ফ্রান্স।

দ্য মেরি রোজ; Source: bbci.co.uk

এ যুদ্ধে মেরি রোজকে প্রথমবারের মতো রণতরী হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। কামান থেকে চলতে থাকে তীব্র গোলাবর্ষণ। এই যুদ্ধের কোন ফাঁকে প্রায় ৩০০ নাবিক ও যোদ্ধা নিয়ে ডুবে যায় মেরি রোজ কেউ তা ঠিক করে বলতে পারেনি। এতগুলো তাজা প্রাণ নিয়ে কোথায় সলীল সমাধি হলো রণতরীটির, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। তার স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করা হয় একটি জাদুঘর। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে, খুব সম্ভবত সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ জাহাজটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দূরের কোনো উপকূলে। অথবা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ফলে ডুবেও যেতে পারে মেরি রোজ। কিংবা অপর যুদ্ধ জাহাজের গোলার আঘাতে জাহাজ ফুটো হয়ে পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়াও অসম্ভব না। ১৯৮২ সালে মেরি রোজ বলে যে জাহাজটি উদ্ধার করা হয়েছে তা আসলেই মেরি রোজ কিনা, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এই মেরি রোজ উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে পারেনি। জাহাজটি রাখা হয়েছে মেরি রোজ জাদুঘরে, এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষ দর্শনার্থী জাহাজটি দেখতে এসেছেন।

৩) দ্য হানলে

গৃহযুদ্ধকালীন সাবমেরিন, এইচ. এল. হানলে আদতে তিনবার জাহাজডুবির সম্মুখীন হয়। ১৮৬৩ সালে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে নামা হানলে, একদম শুরুর দিকের বেশ উন্নত একটি রণতরী হিসেবে ইতিহাসে সমাদৃত। মিত্রপক্ষের নেভি অফিসার থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবরোধকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টায় লিপ্ত শার্লেস্টন হারবার পর্যন্ত কতজনকে যে সে সওয়ারি বানিয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রথম মিশনে ডকের কাছে এক জলাবদ্ধ জায়গায় অদৃশ্য কিছু শেকড়-বাকড় জাহাজটিকে টেনে নেয় পানির নিচে। হানলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, পাঁচজন লোক মারা যায় সেবার। উদ্ধার অভিযান চালিয়ে খুঁজে বের করা হয় হানলেকে। কয়েক মাস পরেই আবার যাত্রা শুরু করে দেয় সে। কেউ একজন এর ভাল্‌ভ খোলা রেখে কাজে চলে যায়, যার ফলে মোট আটজন ক্রুকে সাথে নিয়েই ডুবে যায় হানলে।

দ্য হানলে; Source: history.com

একের পর এক বিপর্যয়ের পরেও নৌবাহিনী পরাস্ত করতে পারেনি হানলে, তাদের আশা-ভরসার এই প্রতীককে আবারও খুঁজে বের করে ১৮৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাজে নিযুক্ত করা হয়। এবার ইউ. এস. এস. হৌসাটোনিককে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করে হানলে। এই দুর্ঘটনা অবশ্য হানলের নাবিকদের জন্যই আত্মঘাতী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ১৯৯৫ সালের আগ পর্যন্ত সাবমেরিনটির কিংবা এর নাবিকদের কারো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধ্বংসাবশেষ শিকারীরা প্রায় ২২ বছর আগে খুঁজে বের করে হানলেকে, ভেতরে ছিল আট নাবিকের কঙ্কাল। ২০০০ সালে ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া হানলে। এখনো পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি, শেষ মিশনে কী এমন হয়েছিল সাবমেরিনটির সাথে, যা তাকে এভাবে ধ্বংস করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলে! রণতরীটির নিজস্ব যুদ্ধ সরঞ্জামই তার প্রাণনাশের কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অথবা সমুদ্রে কোনো ঝড় উঠলে নাবিকরা সবাই অ্যাসফিক্সিয়া বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, এমনটাও হতে পারে। কিংবা অন্য কোনো জাহাজ থেকে ছোঁড়া গুলি হয়তো সোজা এসে আক্রমণ করে হানলের ক্যাপ্টেনকে, আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায় হানলে। সম্ভাবনার কোনো অভাব নেই, নেই এখন আর তা নিশ্চিত করার কোনো উপায়ও।

৪) দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার শিপ

৯/১১ এর পর, গ্রাউন্ড জিরোকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সময় নির্মাণ শ্রমিকরা অস্বাভাবিক কোনোকিছুর দেখা পায়। টুইন টাওয়ার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার দক্ষিণ দিকে মাটির নিচে কাঠের একটি জাহাজের সন্ধান পায় তারা। কঙ্কালসার অবস্থায় জঞ্জালের মতো পড়ে আছে ওটা। কেউ জানে না, কোত্থেকে এখানে এলো এই জাহাজ!

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার শিপ; Source: dailymail.co.uk

প্রায় চার বছর পর, গাছের গুড়ির বলয় থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার জাহাজ নামে পরিচিতি পাওয়া জাহাজটির সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য উদ্ধার করেন। জানা যায়, জাহাজটি ১৭৭০ সালের শুরুর দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময় এ ধরনের জাহাজ বানানোর চল ছিল ফিলাডেলফিয়ায়। কিন্তু ফিলাডেলফিয়া থেকে এই জাহাজ কীভাবে নিউ ইয়র্কে আসলো, এর মালিকই বা কে ছিল সে সব প্রশ্নের উত্তর বোধ করি আর জানা সম্ভব হবে না কখনো। দুর্ঘটনাবশত ম্যানহাটনের কাছাকাছি কোথাও ডুবে গিয়েছিল জাহাজটি, এমনটাই মনে করছেন গবেষকরা। আবার এমনও হতে পারে, প্রাচীন কোনো বিশ্বাস অনুযায়ী টুইন টাওয়ারের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য স্বেচ্ছায় কেউ মাটির নিচে পুঁতে রেখে যেতে পারে এটি। কিন্তু ১৯৭৩ সালে নির্মিত একটি ভবনের জন্য ১৭৭০ সালের একটি জাহাজ ব্যবহার করার বিষয়টি খুব একটি গ্রহণযোগ্য নয়।

৫) মহামূল্যবান স্যান জোস

প্রায় ৩০৭ বছর ধরে স্প্যানিশ গ্যালিওন বা রণতরী স্যান জোস নিখোঁজ ছিল। তার সাথে নিখোঁজ ছিল রাশি রাশি স্প্যানিশ গুপ্তধন, যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতো যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে। সোনা, রূপা, হীরা, চুনি, পান্না সহ অসংখ্য দামি দামি রত্নবাহী এই জাহাজ স্পেন থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় যাচ্ছিল। পথিমধ্যে ১৭০৮ সালে চারটি ইংরেজ জাহাজের সাথে যুদ্ধ বাধে তার। এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় মোট ৬০০ নাবিক। কিন্তু দুর্দান্ত সব অস্ত্রশস্ত্র আর দক্ষ নাবিক থাকার পরেও কেন স্যান জোস কেন হারিয়ে গেল, তার কোনো উত্তর মেলেনি আজও।

স্যান জোস; Source: wikimedia.org

কেউ কেউ বলেন, স্যান জোসের পাউডার রুমে আগুন ধরে গেছিল। আবার কারো কারো মতে, ইংরেজদের গোলাবর্ষণের সামনে টিকতেই পারেনি স্প্যানিশরা। সে যা-ই হোক না কেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্ধার করা হয়েছে জাহাজটিকে। তারপর থেকে একদিকে জাহাজের মালিকানা নিয়ে শুরু হয়েছে বিরোধ, অপরদিকে উদ্ধারকৃত গুপ্তধন নিয়েও তৈরি হয়েছে লুকোচুরি। ২০১৭ সালের জুন মাসে কলম্বিয়ার সরকার জাহাজটি উদ্ধার করার জন্য একটি সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের ঘোষণা দেয়। যদিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বহু আগে থেকেই স্যান জোস উদ্ধারের কৃতিত্ব দাবি করে আসছিল। এখন আবার স্প্যানিশ সরকারেরও টনক নড়েছে, ভাগ ছাড়তে রাজি নয় তারাও। শেষ পর্যন্ত কে হবে স্যান জোসের প্রকৃত মালিক, এই নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন রহস্য।

ফিচার ইমেজ- ytimg.com

Related Articles