‘কৃষি’ শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে পুরো মানবজাতির অস্তিত্ব। কৃষি বিপ্লব মানব ইতিহাসের গতিপথকেই অন্যদিকে মোড় দেয়, পথে পথে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর হোমো স্যাপিয়েন্স ঘর বাঁধে। উদ্বৃত্ত খাদ্য আর সময়মতো ফসল পাবার প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি করেছে সামাজিক নিরাপত্তার। কৃষি বিপ্লব আসার আগে কোনো বিনিময় প্রথা ছিলো না, অর্থনীতির ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
কিন্তু আড়াই বিলিয়ন বছর আগে শিকারি গুহামানব তার গাছের ফল খেয়ে বীজ গুহার পাশে ফেলে যখন অনুরূপ একটা গাছের দেখা পেয়ে গেলো, ঠিক তখনই সে সভ্যতার চাবিকাঠির নাগাল পেয়ে গেলো।
শক্তি রূপান্তরের চাবিকাঠি কৃষি
কৃষির বদৌলতে মানুষ প্রকৃতির সবচেয়ে বড় শক্তিটির নাগাল পেয়ে গেলো। সৌরশক্তিকে প্রত্যাশিত গাছের পাতায় বন্দি করে মানুষ এগিয়ে গেলো বহুদূর।
তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে মূলত যে তিনটি বিপ্লব গতি দিয়েছে তার একটি কৃষি বিপ্লব। এই কৃষি বিপ্লবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে শিল্প বিপ্লব আর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। মানুষের এই কৃষি বিপ্লব কীভাবে মানব সভ্যতাকে গড়ে দিলো তাই নিয়ে আজকের লেখা।
সভ্যতার বীজ বুনেছে কৃষি বিপ্লব
নীল নদের পাশের ভূমিতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করা মানুষগুলো যেদিন বুঝতে পারলো তার পাশের ভূমিতে কৃষিকাজ করে, পশুপালন করে অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ্যে খাদ্য জোগাড় করা যায়, ঠিক তখন সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়ে যায়। বন্যায় নদীর পাশের উর্বর পলিমাটিতে দূরের বন থেকে আনা ফলের বীজগুলো পড়ে ছিলো। সেখান থেকে দেখতে ঠিক একই রকম গাছ জন্মালো এবং যাযাবর দলের কেউ একজন সেটি পর্যবেক্ষণ করলো। ঠিক তখনই কৃষির জন্ম হলো!
ধারণা করা হয় প্রথম ফসলটি ছিলো বার্লি কিংবা ভুট্টা। সেই শুরু এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি মানবজাতিকে। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে নয় হাজার বছর আগেই মানবজাতি মটরশুঁটি আর মসুর ডালের চাষাবাদ শুরু করে দেয়।
একক খাদ্যশস্যের উপর নির্ভরশীলতা
মানবজাতির কৃষির উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে মূলত একক খাদ্যশস্যের উপর মনোযোগ দেওয়ার ফলে। মূলত আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে একেক অঞ্চলে একেক খাদ্যশস্যের প্রাধান্য বিস্তার হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যকে কৃষির সূতিকাগার হিসাবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের মেসোপটেমিয়া আর মায়া সভ্যতাতেও কৃষির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। ধারণা করা হয়ে থাকে সিন্ধু উপত্যকায় ধান, গম, যবের মতো ফসলের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটে। মেসোপটেমিয়াসহ জেরুজালেম ও মধ্যপ্রাচ্যে বার্লি, রাই, ডাল, মাশকালাইয়ের একক আধিপত্য দেখা যায়। ইউরোপ জুড়ে আলু, কলা, ডাল চাষ কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। মানুষের পরিভ্রমণ বাড়ার সাথে সাথে ফসলগুলোও উৎপত্তিস্থল ছাড়িয়ে পাড়ি জমায় বহুদূরে।
এই একক কৃষিপণ্যের উপর নির্ভরশীলতা যেমন একদিকে মানুষের দ্রুত খাদ্যচাহিদা পূরণে প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক তেমনি এর অন্ধকার দিকও দেখ যায়।
যেমন: আয়ারল্যান্ডের মানুষ আলুর উপর বেশ নির্ভরশীল ছিলো। ১৮৪৫ সালে আলুর ‘লেইট ব্লাইট’ রোগের কারণে আয়ারল্যান্ডে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। বাংলায় ধানের ফলন কম হবার কারণে বেশ কয়েকবার চরম দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলো।
গৃহপালিত পশুপাখি পালনের শুরু
আমাদের আশেপাশে যে কয়েকটা গৃহপালিত পশু দেখতে পাওয়া যায়, তার বেশীরভাগকেই কৃষি বিপ্লবের শুরুতে পোষ মানানো হয়েছিলো (১৩,০০০ থেকে ১০,০০০ বছর আগে)। মূলত মানুষের ফেলে দেয়া খাদ্যশস্যের ভাগ কুড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করা শিকার করার চেয়ে অনেক সহজসাধ্য। এই কারণে মানুষের আশেপাশে ভিড়তে থাকা পশুদের পোষ মানানো হয়। তাদের অনেককেই আবার কৃষির উৎকর্ষ সাধনে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে যাত্রা করে মানবজাতি।
অর্থনীতির গোড়াপত্তন
কৃষি বিপ্লবের পরেই যাযাবর জাতি পুরোদস্তুর ঘরবাড়ি বানাতে শুরু করে। পশুপালন শুরু হয় ঠিক এ সময়েই। ধারণা করা হয়ে থাকে কৃষিবিপ্লবের আগ পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ বলে কিছু ছিলো না, যা ছিলো তা জাতি কিংবা গোষ্ঠীর সবার। কিন্তু কৃষি বিপ্লব আসার পর প্রথমবার মানুষের মনে আসে ব্যক্তিগত সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারণা। পুঁজিবাদের উত্থান ঘটে সমাজে। চালু হয় বিনিময় প্রথা। ক্রমান্বয়ে মানুষ বুঝতে পারে বিনিময় প্রথায় আর হচ্ছে না। ধরে নেয়া যাক কামারের দরকার মাছ আর জেলের দরকার কাপড়। তখনই মানুষের মাথায় আসে মুদ্রা ব্যবস্থার। যদিও প্রথমেই নোট চলে আসেনি।
পাতা, কানাকড়ি, গহনা, মূর্তি ও মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। মূল্যবান ধাতু যেমন সোনা-রুপার মুদ্রা চালু হয়েছে অনেক পরে। তাই মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর মূলে যে কৃষি বিপ্লবের ভূমিকা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
পরিবারের শুরু
কৃষি বিপ্লবের পরে মানুষ পরিবারের দিকে মনোযোগী হয়। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে তা একক পরিবার ছিলো। এক স্বামী এক স্ত্রীর বদলে আদিম সমাজে কোনো পরিবারে একাধিক স্বামী কিংবা একাধিক স্ত্রী ছিলো বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। আদিম সমাজ মাত্রিতান্ত্রিক ছিলো বলেই ধারণা করা হয়। কারণ হিসাবে সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যেহেতু এক নারীর সাথে একাধিক পুরুষের মিলন হওয়া সমাজে বাধা ছিলো না, সেহেতু সন্তানের পরিচয় তার মায়ের দ্বারাই প্রত্যক্ষভাবে নির্ধারণ করা হত। আর তাই মায়ের কৃষিজমির ভাগ শুধুমাত্র মেয়েই পেত।
শিল্পবিল্পবের শুরু
চায়ের পানি ফুটছে কেতলিতে, কেতলির ঢাকনাটাকে উপরে তুলতে চাচ্ছে। শত শত বছর ধরে প্রতিদিন এই ঘটানটা মানুষ দেখে আসছে। কিন্তু বেচারা জেমস ওয়াট ঘটনাটা উপলব্ধি করে বানালেন এক বাষ্প ইঞ্জিন।
সারা বিশ্বে সাড়াজাগানো এই উদ্ভাবনের পর সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কৃষি। কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠা মানুষকে করেছে অনেক বেশী আয়েশি। পণ্যপরিবহনে কম সময় লাগায় দ্রুত চাহিদা আর যোগানের সামঞ্জস্য আসে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কৃষির অবদান
সহজলভ্য কৃষিজাত পণ্য, নিরাপদ পানি আর মহামারীকে হটিয়ে দিয়ে মানুষ (Homo sapiens) একক প্রজাতি হিসাবে সারা পৃথিবীতে রাজত্ব কায়েম করে। মানুষের এই অতি উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠার পিছনের গল্পটাও এই কৃষি বিপ্লব লিখে দিয়েছে। মূলত কৃষি আর শিল্পের যুগপৎ উন্নয়ন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের দ্বার খুলে দিয়ে মানুষের জন্যে এই পৃথিবীতে বসবাস আরো অনেক সহজসাধ্য করে দিয়েছে। শত খণ্ডে বিভক্ত অসহায় যাযাবর এক জাতি আজ আট বিলিয়নের বিশাল পরিবার।
আধুনিক কৃষি
জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসল, উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান কৃষির চিত্র বদলে দিচ্ছে। অন্যদিকে খাদ্যশস্য রোপণ এবং সংগ্রহে রোবটের ব্যবহায় অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কৃষিকে আরো বেশী গতিশীল করে দিয়েছে।
খোলা মাঠে প্রকৃতির দিকে চেয়ে না থেকে মানুষ সব মৌসুমে তার কাঙ্ক্ষিত ফসল চাষের পন্থাটি আয়ত্ত করে নিয়েছে। পাশাপাশি নিত্যনতুন যুগান্তকারী সব আইডিয়া কৃষিকে আমূল বদলে দিয়েছে। এককালে আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টির জন্যে করুণ প্রার্থনা করার সময় বদলে গেছে। ফসল থেকে শুরু করে কীটপতঙ্গের জিনোম সিকোয়েন্স আজকে কীটনাশকের কার্যকরী বিকল্পের আসনে বসেছে। তাই আধুনিক সমাজ হয়ে উঠেছে অনেক বেশী বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিনির্ভর। কারণ দিনশেষে আপনাকে কৃষিপণ্য খেয়েই বাঁচতে হবে!