সময় গত শতাব্দীর সত্তরের দশক; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে তখন চলছিল ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। এই কারণে শত্রুর অস্ত্রের ভাণ্ডার সম্পর্কে ধারণা রাখতে উন্মুখ হয়ে থাকত উভয়পক্ষ, ধারণা পাওয়ার জন্য গোয়েন্দাগিরি ছিল প্রধান মাধ্যম। কিন্তু চুরি?
হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ঘটে এরকম একটি ঘটনা। কিন্তু, সে যেনতেন চুরি নয়, পৃথিবীর প্রথম ‘হিট-সিকিং’ এয়ার-টু-এয়ার গাইডেড মিসাইলের চুরি। মূল আলাপে যাওয়ার আগে আমরা সাইডউইন্ডার মিসাইলের গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব।
সাইডউইন্ডার মিসাইলের গুরুত্ব
হিট-সিকিং মিসাইলটি আবিষ্কারের আগপর্যন্ত আকাশযুদ্ধে ‘ডগ ফাইট’ই ছিল একমাত্র ভরসা, যেখানে খুব কাছাকাছি এসে দুটি বা তার অধিক বিমানের মধ্যে ক্যানন ফায়ারিং মাধ্যমে যুদ্ধ হতো, যতক্ষণ না যেকোনো একটি বা উভয় বিমানই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, যেটা ছিল উভয়পক্ষের জন্য ভয়ানক।
হিট-সিকার মিসাইলের আবিষ্কার আকাশযুদ্ধের মোড় পুরোপুরি আমেরিকার দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যা ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় তাইওয়ান সংকটকালে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যকার আকাশযুদ্ধে দেখা যায়। ঐ বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের ১২৬টি মিগ-১৫ এবং মিগ-১৭ যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে, যেগুলো ঐ সময়ের অন্যতম সেরা যুদ্ধবিমান ছিল। তাইওয়ান সেগুলোকে প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকার নতুন আবিষ্কৃত সাইডউইন্ডার মিসাইলসজ্জিত ৪৮টি স্যাবর (Sabre) যুদ্ধবিমান প্রেরণ করে। সংঘর্ষে চীন ৯টি যুদ্ধবিমান হারায়, যার মধ্যে ৬টি সাইডউইন্ডার দ্বারা। তাইওয়ানের যুদ্ধবিমানগুলো চীনের যুদ্ধবিমানগুলোর সাথে প্রায় ৯,০০০ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, কিন্তু চীনারা একটু আগেও জানত তাদের শ্যুটডাউন করতে হলে কম করেও হলেও ৭০০-৮০০ ফিট কাছাকছি আসতে হবে। সে কারণেই তাইওয়ানকে একটি বিমানও হারাতে হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে সাইডউইন্ডার
চীন-তাইওয়ান সংঘর্ষে একটি সাইডউইন্ডার চীনের মিগ-১৭-এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, কিন্তু বিস্ফোরিত হয়নি, এবং সেটি বিমানের এয়ার ফ্রেমের সাথে আটকে যায়। পরবর্তীতে চীনারা সেটি সোভিয়েতদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়াররা সেটিকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে তার একটি কপি তৈরি করে।
কিন্তু আমেরিকা ইতোমধ্যে সাইডউইন্ডার মিসাইলের নতুন সংস্করণ তৈরি করে ফেলে। তাই আমেরিকার সাথে প্রযুক্তিগত ব্যবধান ঘুচাতে তাদের প্রয়োজন ছিল সাইডউইন্ডারের আপডেটেড ভার্সন।
স্থপতি, ব্যবসায়ী এবং প্লেবয় যখন সোভিয়েত গোয়েন্দা
ম্যানফ্রেড র্যামিঙ্গার, পশ্চিম জার্মানির একজন স্থপতি, ব্যবসায়ী এবং প্লেবয়- যিনি ছিলেন একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক এবং এসব করতেন মূলত বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য।
ষাটের দশকে তার ভাগ্যের চাকা উল্টোদিকে ঘুরে যায় যখন তার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বিশাল বড় ক্ষতির মুখে পড়ে। সম্পদ এবং বিলাসবহুল জীবন পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি মরিয়া চেষ্টা করতে লাগলেন।
জোসেফ লিনোয়াস্কি, একজন পোলিশ ইঞ্জিনিয়ার যিনি র্যামিঙ্গারের জন্য কাজ করতেন, ১৯৬৩ সালের ২৬ আগস্ট সোহমের সোভিয়েত অ্যাম্বাসিতে উপস্থিত হলেন। তিনি অ্যাম্বাসিতে গিয়ে বললেন যে তার ফার্ম রাশিয়ানদের জন্য যেকোনো কিছু এনে দিতে পারবে, যেটা রাশিয়ানরা বৈধভাবে কিনতে পারবে না। কূটনৈতিকরা প্রস্তাবটি সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি ‘গ্রু(GRU)’-র কাছে প্রেরণ করলেন। গ্রু অফিসিয়ালরা চিন্তাভাবনা করে র্যামিঙ্গারকে মস্কোয় আমন্ত্রণ জানালেন, তাকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝার জন্য।
র্যামিঙ্গার মস্কোতে পৌঁছার পর গ্রু-র সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছলেন, এবং বললেন যে তিনি মিসাইল জাতীয় কিছু দিতে পারবেন।
শতাব্দীর সেরা চুরি
জার্মানিতে পৌঁছে তিনি খবর পাঠালেন, তিনি সাইডউইন্ডার মিসাইলের আপডেটেড ভার্সন চুরি করতে পারবেন, যেটা সোভিয়েতদের অনেকদিনের চাওয়া। গ্রু কর্মকর্তাদের কাছে অফার সত্যি মনে হলো এবং আবার পরামর্শ করার জন্য তাকে মস্কোতে ডাকলেন।
কিন্তু ‘আগে কাজ, পরে কথা’ মন্ত্রে বিশ্বাসী র্যামিঙ্গার মস্কোতে গেলেন, তবে মিসাইলসহ। তাকে মস্কোর হোটেল ইউক্রেনে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে তিনি চুরির গল্পটি খুলে বললেন।
খুব কঠিন কাজ যখন খুব সহজ
র্যামিঙ্গার তার দলে নিলেন জার্মান বিমান বাহিনীর পাইলট উলফ ডায়েটহার্ট নপ (Wolf-Diethardt Knoppe)-কে, যার নিজেরও বেশ নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল। নপের খুব ভালো করে নিরাপত্তা প্রটোকল এবং অ্যালার্ম সিস্টেম সম্পর্কে জানা ছিল। তিনি ওয়্যারহাউজের চাবির একটি মাটির ছাঁচ তৈরি করেন, যেটি দিয়ে লিনওয়াস্কি একটি কপি তৈরি করেন। লিনওয়াস্কি একটি তালা খোলার যন্ত্র, তার কাটার যন্ত্র ও প্লায়ার্স সম্বলিত একটি চুরির কীট ব্যাগের ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে, র্যামিঙ্গার হাইড্রোলিক লিফট ও ট্রলির ব্যবস্থা করেন।
অক্টোবর ২৩, ১৯৬৬; শরতের প্রচণ্ড কুয়াশাঘেরা আবহাওয়ায় বাভারিয়ার নিউবার্গ বিমানঘাঁটিতে র্যামিঙ্গার লিফটের সাহায্যে লিনওয়াস্কি, নপ এবং ট্রলিকে ঘাঁটির কাঁটাতারের দেওয়াল পার করে দিলেন। নপ অ্যালার্মকে ডিঅ্যাকটিভ করে দিলেন এবং লিনওয়াস্কি ওয়্যারহাউজে ঢুকে পড়লেন। তারা মিসাইল বের করে দিলেন, এবং এরপর তালা লাগিয়ে পুনরায় অ্যালার্ম অ্যাকটিভ করে দিলেন। কাঁটাতারের দেওয়ালে একটু গর্ত করে মিসাইলকে ঘাঁটির বাইরে বের করে নিলেন। ব্যস, মূল কাজ শেষ।
এবার মস্কোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার পালা
এবার র্যামিঙ্গার যা করলেন, সেটা কল্পনারও অতীত। তিনি মিসাইলের পার্টগুলোকে গাড়ির পার্ট বলে এয়ার মেইলে মস্কোয় পাঠিয়ে দিলেন, এবং তিনিও অন্য একটি বিমান ধরলেন এটা নিশ্চিত করতে যে মিসাইল ঠিকঠাকমতো পৌঁছেছে।
“মেইল সার্ভিস তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি, শুধুমাত্র অতিরিক্ত ওজনের জন্য ৭৯.২৯ ডলার চার্জ করেছিল।”
কিন্তু মস্কোয় গিয়ে দেখলেন তার পার্সেল আসেনি। রাগান্বিত র্যামিঙ্গার আবার বার্লিনের প্লেন ধরে মেইল সার্ভিসে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এয়ার লাইনটি তার পার্সেল ভুল জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
গ্রু কর্মকর্তারা মিসাইল দেখে যারপরনাই অবাক। গ্রু তাকে ৮,৫০০ ডলার দিল (যা ষাটের দশকে যথেষ্ট) এবং তিনি খুশিমনে জার্মানিতে ফিরে গেলেন।
মিসাইলটিকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করে R-13M এয়ার টু-এয়ার মিসাইল। অর্থাৎ তাদের প্রতিপক্ষের প্রযুক্তি দিয়েই প্রতিপক্ষের সাথে সামরিক প্রযুক্তিগত ব্যবধান ঘুচিয়ে নিয়েছিল।