পুরো পৃথিবীতে যতগুলো সাম্রাজ্য টিকে ছিল, সেগুলোর ভেতর দক্ষিণ এশিয়ার সাম্রাজ্যগুলোর কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমির গঠন এবং জলবায়ুর বৈচিত্র্য হাজার বছর ধরে অনেকগুলো গল্প তৈরির কারিগর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বসবাস করে, যার আয়তন রাশিয়াকে বাদ দিলে ইউরোপকে যেমন দেখায়, ঠিক ততটুকু। আবার দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলের ভেতর রয়েছে মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, রেইনফরেস্ট আর তুষরাবৃত এলাকা।
পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্য এবং নগররাষ্ট্রের বিপরীতে এসব এলাকার সাম্রাজ্য কিংবা শহরগুলো একটা আরেকটির সঙ্গে সহাবস্থান করত। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক কাঠামো ইউরোপের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। কীভাবে একটি উপমহাদেশ একটিমাত্র সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হতো, সেটি ঐতিহাসিকদের কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। যেখানে সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা রাজ্যগুলো এক চমৎকার উপায়ে সহাবস্থান করত, এতে সাম্রাজ্য হয়ে উঠতো প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী।
তবে সবকিছুর মতো সাম্রাজ্যেরও পতন আছে, সেটা সময়ের চাহিদাকে পূরণ করতেই। এভাবেই সময় বদলে যায় আর এক সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপরেই আরেক সাম্রাজ্য গড়ে উঠে। আজকের লেখায় মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম ও ইউরোপিয়দের আগমনের পূর্বের পাঁচটি সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা হবে।
১. মৌর্য সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০-১৮৫)
প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর ভেতর একটি হলো ‘মৌর্য’। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ রাজবংশকে পরাজিত করে এই সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী সময়ে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ যখন ভারতীয় উপমহাদেশে নিজের সামরিক অভিযান শেষ করে ইউরোপে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মধ্য ও পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যগুলোকে পরাজিত করে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান।
আভ্যন্তরীণ শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির পাশাপাশি মৌর্য সাম্রাজ্য কূটনৈতিক দিক থেকেও সফল ছিল। আর এসব নীতি তৈরির কৃতিত্বের বড় একটা অংশের ভাগীদার চন্দ্রগুপ্তের পরামর্শক চাণক্যের। তার দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার ফলে মৌর্যরা আলেকজান্ডারের সেনাপতিদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং সহজেই আফগানিস্তান এবং ইরানের কিছু ভূখণ্ড নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক কলিঙ্গ (বর্তমান উড়িষ্যা) জয় করার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সবটুকু নিজ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন।
কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ সালে অশোকের মৃত্যু হলে সাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করে এবং তার মৃত্যুর ৫০ বছরের মাথায় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। অনেক ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে অশোকের হিন্দু থেকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণকে দায়ী করেন। যেখানে অন্য ঐতিহাসিকেরা অশোক পরবর্তী দুর্বল প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সাম্রাজ্য পতনের কারণ মনে করেন।
২. কুষাণ সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫-৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ)
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫ সালে উয়েঝি নোমাডসরা চীনের জিনজিয়াং থেকে হানদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে উত্তর আফগানিস্তানের ব্যকট্রিয়া অঞ্চলে তাঁবু ফেলে। তারা ক্রমে জনসংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং একসময় গ্রেসো-ব্যাকট্রিয়ানদের বিতাড়িত করে সেই অঞ্চল থেকে। একসময় কুষাণরা বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করে।
একসময় গঙ্গানদীর অববাহিকার প্রায় পুরোটা জুড়ে কুষাণ সাম্রাজ্যের সীমারেখা ছড়িয়ে পড়ে এবং আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া এবং জিনজিয়াং তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যার ফলে ইন্ডিয়া, চীন, পারস্য এবং রোম পর্যন্ত একটি সুবিশাল ব্যবসায়িক পথের উত্থান ঘটে।
কুষাণ সাম্রাজ্যের রাজধানী একসময় পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে সরিয়ে ভারতের মথুরায় স্থানান্তর করা হয়। এর ফলে বিশাল একটি অঞ্চল জুড়ে ভারতীয়দের প্রভাব বাড়তে থাকে এবং বৌদ্ধধর্ম এশিয়া জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সম্রাট কনিষ্কের শাসনামলে বৌদ্ধধর্ম সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম হয়ে যায়, যার ফলে মধ্য ভারতেও একসময় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেড়ে যায়।
কিন্তু একসময় বিশাল সাম্রাজ্যটি নিজের গৌরব হারাতে শুরু করে এবং অসংখ্য ছোট-ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে উত্তর ভারত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় এবং কুষাণ সাম্রাজ্যের আফগানিস্তান অংশ পার্সিয়ানরা দখল করে নেয়।
৩. গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩২০-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে গুপ্ত সাম্রাজ্যের নামও উঠে এসেছে, যারা মৌর্য সাম্রাজ্যের মতো মগধ অঞ্চল শাসন করেছিল। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একসময় তারা আধিপত্য বিস্তার করলেও শেষমেশ উত্তর ভারত জুড়েই কেবল সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যার রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়সীমাকে ‘সোনালি সময়‘ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এ সময়েই ভারতীয় সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্রাটের হাতে থাকলেও মূলত ছোট-ছোট রাজ্যগুলোকে স্বাধীনভাবে শাসনের এখতিয়ার দেওয়া হয়।
এরকম ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোই গুপ্ত সাম্রাজ্যের শক্তি ছিল, যারা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিলাভে অংশগ্রহণ করেছিল। সাম্রাজ্য জুড়ে ন্যায়বিচার কায়েম আর প্রজাদের সুখ-শান্তির প্রসারের কারণে সাহিত্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ভারতীয়দের জন্য নতুন দ্বার খুলে যায়। গুপ্ত বংশের সম্রাটদের আনুকূল্য পেয়ে ভারতে নতুন এক যুগের সূচনা হয়। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যায় বহু মানুষ অবদান রাখতে শুরু করেন, যাদের ভেতর কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ অন্যতম। গাণিতিক সংখ্যা শূন্যের ব্যবহার শুরু হয় গুপ্তের সময়ে, তাছাড়া দাবা খেলারও জন্ম হয় এই সোনালি সময়ে। হিন্দু সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার পেছনে গুপ্তদের অবদান ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের কল্যাণেই ভারতীয় উপমহাদেশে দু’ শতাব্দী ধরে ‘হানরা’ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তাদের ভেতর গুপ্তরাই সর্বপ্রথম বাংলায় আগমন করে। কিন্তু একসময় ছোট-ছোট রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় শাসন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করলে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে।
৪. প্রতিহার সাম্রাজ্য (৬৫০-১০৩৬ খ্রিস্টাব্দ)
প্রতিহার সাম্রাজ্যকে অনেকে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্য হিসেবে অভিহিত করে থাকে। পশ্চিমাদের কাছে তো বটেই, ভারতীয়দের কাছেও সাম্রাজ্যটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই! অথচ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সময়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানকার অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় তারা অনেক বেশি সময় ধরেই টিকে ছিল। প্রতিহার সাম্রাজ্যের সময়কালেই গুজরাট ও রাজস্থানে ‘রাজপুতদের’ উত্থান ঘটে। রাজপুতরাই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে এক শক্তিশালী যোদ্ধা জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং তাদের ইউরোপিয়ান নাইটদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। রাজপুতরা স্বাধীন ছিল এবং একসময় মুঘল ও পরবর্তীতে ইংরেজদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে।
প্রতিহার সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর তারা ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের যুদ্ধে আরবদের পরাজিত করে। আরবদের এই পরাজয় পরবর্তী ৩০০ বছরের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। প্রতিহার সাম্রাজ্যের রাজধানী একসময় দিল্লির নিকটবর্তী কনৌজে স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে এই অঞ্চলেও প্রতিহারদের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। পশ্চিম ও মধ্যভারতে অসংখ্য দুর্গ গড়ে তুলেছিল তারা, যার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছিল।
সাম্রাজ্যের আনুকূল্য পেয়ে হিন্দুধর্ম আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত প্রসার পেতে শুরু করেছিল। ধর্মের এই নতুন স্রোতে বৌদ্ধরা মোটামুটি টিকে থাকলেও মুসলিমরা সুবিধা করতে পারেনি। যার কারণে মুসলিমদের সংখ্যাও অনেক কমে যায় একসময়। কিন্তু ইতোমধ্যে সাম্রাজ্যও ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে শুরু করে এবং একাদশ শতকে গজনির সুলতান মাহমুদ কনৌজ আক্রমণ করলে প্রতিহার সাম্রাজ্যের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে।
৫. চোল সাম্রাজ্য (৮৪৮-১২৮৯ খ্রিস্টাব্দ)
ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ সাম্রাজ্যই স্থলকেন্দ্রিক ছিল, যেখানে চোল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তাদের নৌশক্তির উপর ভর করে। ঐতিহাসিক ‘জন কে’ চোল সাম্রাজ্য নিয়ে মন্তব্য করেন,
“সমুদ্র যে কেবল বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যম না হয়ে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে একটি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, এ ধারণা ভারতীয়দের ছিল না এর আগে।”
চোল সাম্রাজ্য ছিল মূলত একটি তামিল সাম্রাজ্য, যারা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে দক্ষিণ ভারতে বসবাস করে আসছে। খ্রিস্ট পরবর্তী দশম শতাব্দী থেকেই মূলত তারা এই অঞ্চলের পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পুরোটা শাসন করে। ভূমির গঠনগত পার্থক্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিগুলো এই অঞ্চলের বাইরে খুব কমই সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পেরেছে। ফলে এখানকার সাম্রাজ্যগুলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভেতর সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তো। কিন্তু সমুদ্রপথে এই নিয়ম খাটে না। সমুদ্রে কেউ যদি নিজেদের নৌশক্তি বাড়াতে পারে, তবে সহজেই ভারত মহাসাগর জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের অধীনে চলে আসবে।
চোলরা এই ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল, পরবর্তীতে ইংরেজরাও তাদের কৌশল ব্যবহার করেছিল। চোলরা নৌশক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করে নেয় এবং ১০২৫ খ্রিস্টাব্দের ভেতর মালদ্বীপ, শ্রীলংকা এবং মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলোকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। চোলরা ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। পরবর্তী সময়ে পাণ্ড্য সাম্রাজ্যের হাতে চোল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ঘুরির হাতে হিন্দু জোটের পরাজয়ের পরপর উত্তর ভারতে ইসলামিক শাসন কায়েম হতে থাকে আবার। এই সময়ে দিল্লি সালতানাত (১২০৬-১৫২৬) এবং মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮) ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে। এই যুগে অন্যান্য সাম্রাজ্যের ভেতর দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর (১৩৩৬-১৬৪৬), দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে মারাঠা ১৬৭৪-১৮১৮) এবং সর্বশেষ ব্রিটিশরা মুঘল, মারাঠা ও শিখদের পরাজিত করে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/