অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান : দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ৪)

অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ৩) এর পর থেকে।

মহাকাশে প্রথম দুর্ঘটনাটা হয়ে গেল এবং কেউ জানল না কী হলো। পৃথিবীতে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না আদৌ কিছু হয়েছে কিনা। তাদের অজ্ঞতার একটি কারণ ছিল স্পেসক্রাফট থেকে আসা টেলিমেট্রির ধরনে ত্রুটি। এটা থেকে সরাসরি জানার উপায় ছিল না যে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ফেটে গেছে। টেলিমেট্রি শুধু জানাতে পারত অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপ ও তাপমাত্রা, ভোল্টেজ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আছে কিনা, এবং নির্দিষ্ট কোনো যন্ত্র চালু আছে কিনা। স্পেসক্রাফটের পরিস্থিতি বোঝার আগে ফ্লাইট কন্ট্রোলারদের এসব তথ্য ঠিকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন ছিল।

ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা এসব তথ্যের সঠিক ব্যাখ্যা উপলব্ধিতে একটু ধীর গতির ছিলেন। কারণ নাসার অন্যরাও ধরে নিয়েছিলেন স্পেসক্রাফটটি চাঁদে যাওয়ার জন্য নিরাপদ। স্পেসক্রাফট নিয়ে নাসার প্রত্যেকেরই প্রচুর আত্মবিশ্বাস ছিল। এমনকি সেখানে থাকা প্রায় সব জিনিসই দুই বা ততোধিক থাকাকে অনেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।

অ্যাপোলো-১৩ এর একটি প্রশিক্ষণ সেশনে জিম লাভেল ও ফ্রেড হাইস; Image Source: NASA

অভিযান শুরু হওয়ার তিন মাস আগে থেকে তারা এই মিশনের মহড়া করে যাচ্ছিলেন, যাকে বলা হতো সিমুলেশনস। তখন ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা কন্ট্রোল রুমে তাদের কনসোলে কাজ করতেন। অন্যদিকে নভোচারীরা স্পেসক্রাফটের মডেলের মধ্যে থেকে মিশন পরিচালনা করতেন। স্পেসক্রাফটের মডেল ছিল অনেকটা বিমানের পাইলট শিক্ষার্থীদের লিংক ফ্লাইট সিমুলেটরের মতো। দুই পক্ষই এমন কম্পিউটারের সাথে যুক্ত ছিলেন, যার প্রোগ্রাম করা ছিল মিশনের সময় সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা। পূর্ববর্তী চাঁদের অভিযানগুলো এত সহজ ছিল যে ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা অভিযোগ করেন, সিমুলেশনের পরিকল্পনাকারীরা বাস্তবের মহাকাশের তুলনায় বেশিই কঠিন পরিবেশ তৈরি করে ফেলছেন। অ্যাপোলো-১৩ মিশনের আগে সিমুলেশনে তাই শুধুমাত্র সম্ভাব্য বেশি বিপর্যয় তৈরি করার মতো পরিস্থিতি নিয়েই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

নভোচারী ফ্রেড হাইস; Image Source: NASA

ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা স্পেসক্রাফটের এই বিপর্যয় মেনে নেওয়ার আগে বেশ কিছু দিক চিন্তা করেন যেগুলো স্পেসক্রাফটের বড় কোনো বিপর্যয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। কী হয়েছে বুঝতে তাদের ১৫ মিনিট সময় লাগে। আর স্পেসক্রাফট যে মেরামতের অযোগ্য হয়ে গেছে এটা বুঝে উঠতে তাদের এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। বিশেষ করে ইইকম লিবারগট সতর্কতাটা ধরতে পারেননি। কারণ তিনি এটা খেয়াল করেননি যে ২ নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপ হঠাৎ করে খুব বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে এটা বুঝতে পারেননি যে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ফেটে গেছে। তখন এতগুলো সমস্যা একসাথে দেখা দিচ্ছিল যে তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোথা থেকে শুরু করবেন। অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে যেহেতু তার চিন্তা করার কোনো কারণ ছিল না, তিনি তখন বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার কী সমস্যা সেটা বের করার জন্য পেছনের ধাপগুলো পরীক্ষা করছিলেন। তার কাছে একমাত্র ইঙ্গিত ছিল হাইসের কাছ থেকে পাওয়া বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সতর্কবার্তা এবং তার নিজের কনসোলেও পাওয়া একইরকম বার্তা।

কন্ট্রোল রুমে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা; Image Source: NASA

তিনি তখন ‘মেইন বাস বি আন্ডারভোল্ট’ সিগন্যাল দেখতে পান। মেইন বাস ছিল দেওয়ালের অনেকগুলো প্লাগের মতো একটি সেট। জ্বালানি কোষ থেকে বিদ্যুৎ এই বাসে গিয়ে সংরক্ষিত থাকত। সেখান থেকে স্পেসক্রাফটে থাকা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হতো। বেশি বিদ্যুতের জন্য দুটি মেইন বাস এ ও বি রাখা হয়েছিল। লিবারগট দেখতে পান মেইন বাস বি-তে বৈদ্যুতিক ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছে। ফলে এর সাথে যুক্ত থাকা যন্ত্রপাতিগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। স্পেসক্রাফটের প্রায় অর্ধেক যন্ত্রই এই বি বাসের সাথে যুক্ত ছিল। এদিকে কমান্ড মডিউলে থাকা হাইস ইতোমধ্যে ডুবন্ত মানুষের মতো অনুভব করছিলেন। কারণ চাঁদে অবতরণ করার জন্য দুই মেইন বাসই কার্যকর থাকার কথা ছিল।       

এরপর কিছু সময়ের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময় হলো সবার। হাইস দেখতে পেলেন তার মাথার উপর থাকা সতর্কবার্তা দেওয়া বাতিটি বন্ধ হয়ে গেছে। কন্ট্রোল রুমে থাকা লিবারগটের কনসোলেও তা-ই হলো। লাভেল তখন ক্যাপকমের কাছে রিপোর্ট করলেন বাসের বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে। এদিকে লিবারগট তখন ক্রাঞ্জকে বললেন, বাসে সম্ভবত বিদ্যুতের কোনো সমস্যাই হয়নি, বরং যে যন্ত্রগুলো সতর্ক বার্তা দিচ্ছিল সেগুলোতেই হয়তো সমস্যা আছে। হাইস ক্যাপকমকে বলেন, তিনি ওই ঘটনার সময় ‘বড় বিস্ফোরণের শব্দ’ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু ফ্লাইট কন্ট্রোলাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিকই আছে। অদ্ভুতভাবে ক্রাঞ্জ এর আগে নভোচারীদের কাছ থেকে ‘বিস্ফোরণ’ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করতে শোনেননি। তখন তার কনসোলে থাকা একটি বাতি জ্বলে উঠল। এটা নির্দেশ দিচ্ছিল স্পেসক্রাফট থেকে বেতার তরঙ্গ বিশ্লেষণের দায়িত্বে থাকা ফ্লাইট কন্ট্রোলার ইনকো তার সাথে কথা বলতে চান।

ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সার্ভিস মডিউল; Image Source: NASA

ইনকো রিপোর্ট করেন, বিস্ফোরণের সময় স্পেসক্রাফট থেকে পাঠানো বেতার তরঙ্গের কিছু পরিবর্তন হয়, যার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন হঠাৎ করে সরু তরঙ্গ প্রশস্ত হয়ে যায়। ক্রাঞ্জ তখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু পাননি। স্পেসক্রাফট থেকে বেতার তরঙ্গ পাঠানো হচ্ছিল উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টেনার মাধ্যমে। এটা ছিল একপ্রকার লাঠির সাথে প্রতিফলকযুক্ত, যা ঠিক রাইফেলের মতো লক্ষ্য করে তরঙ্গ পাঠাত।

ক্রাঞ্জের তখন মনে পড়ে, এই অ্যান্টেনা কাজ করছিল মেইন বাস বি থেকে পাওয়া বিদ্যুতের মাধ্যমে। সেখানে বিদ্যুতের সরবরাহ হঠাৎ কমে যাওয়ায় তরঙ্গের প্রস্থের পরিবর্তন হতে পারে। বাসের বিদ্যুৎ তখন স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় তিনি এটা নিয়ে আর ভাবেননি। অনেক পরে এটা স্পষ্ট হয় যে, সার্ভিস মডিউলের সাইড প্যানেল ভেঙে মহাকাশের মধ্যে বের হয়ে যায় এবং দ্রুতগতিতে অ্যান্টেনাতে আঘাত করে। এ কারণেই রেডিও সিগন্যালের পরিবর্তন দেখা যায়।

দুর্ঘটনার পর এক মিনিট সময়ও তখন পার হয়নি। স্পেসক্রাফট  থেকে একজন বললেন, বিস্ফোরণের কারণে দুই নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের পরিমাণে প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। শুরুতে অক্সিজেনের পরিমাণ ২০-৬০ ভাগের মধ্যে ওঠানামা করছিল। কিন্তু এখন দেখাচ্ছে নিচের দিকে। তখনও এটা লিবারগট বা ক্রাঞ্জকে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে চিন্তিত করেনি। তারা পুরো সময় জুড়ে অক্সিজেনের হিসাব নিয়ে সমস্যায় ছিলেন, ধরে নিয়েছিলেন এটাও একই সমস্যা হবে।

এমন সময় লাভেল জানান, মেইন বাস বি-তে কোনো বিদ্যুৎ নেই এবং মেইন বাস এ-র বিদ্যুৎ সরবরাহও কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ, একটা মেইন বাস অকার্যকর হয়ে গেছে এবং আরেকটা মেইন বাসও বৈদ্যুতিক ক্ষমতা হারাতে বসছে! যদি দুটো মেইন বাসই অকার্যকর হয়ে যায়, তাহলে কমান্ড মডিউল ও সার্ভিস মডিউলের কার্যক্রমের জন্য বিদ্যুৎ অবশিষ্ট থাকবে কেবল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফেরার জন্য তিনটি ব্যাটারিতে সংরক্ষিত অল্প কিছু বৈদ্যুতিক শক্তি। লিবারগট তখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। দুটো মেইন বাস সংযুক্ত করা হয়েছিল অতিরিক্ত বিদ্যুতের জন্য। তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত তিনটি জ্বালানি কোষ থেকে। একটা বাস অকার্যকর হয়ে গেলেও অন্য বাস অবশ্যই বিদ্যুৎ ধরে রাখার কথা।

লিবারগট তখন চুপ করে চিন্তা করছিলেন বিষয়টা নিয়ে। দীর্ঘ নিরবতা ভেঙে লাভেল তখন উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

ওকে হিউস্টন, আপনারা কি এখনো অ্যাপোলো-১৩’কে শুনতে পাচ্ছেন?

লাউজমা তখন উত্তর দেন, “আমরা আপনাদের শুনতে পাচ্ছি। আমরা এখনো চেষ্টা করছি আপনাদের জন্য কী করা যায় তা বের করতে।

তারপর লাউজমা মাইক্রোফোনের ওপর হাত রেখে দ্রুত ক্রাঞ্জকে জিজ্ঞেস করেন,

আমরা কি তাদের কোনো নির্দেশনা দিতে পারি, নাকি আমরা কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে কাজ করছি, নাকি আমরা আসলেই বড় কোনো সমস্যায় পড়েছি? হচ্ছেটা কী?

This is Bengali article written about Apollo 13 space accident in 1970. It is translated from the article of New Yorker titled "A Space Accident: How Apollo 13 got lost in space- then made it back" published in November 3 1972. 

Reference: 

1. New Yorker 

Featured Image: NASA

Related Articles

Exit mobile version