আমুন রা- মিশরীয় দেবতাদের রাজা

প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাসগুলো প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা আর পাঁচটা রূপকথার মতোই। যেহেতু মিশরীয় সভ্যতা ছিল বিশাল, তাদের চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি বর্তমান মানবসমাজকে একটু হলেও আকার দিয়েছে। মিশরের তখনকার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জানতে হলে যাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না কোনোমতেই, তিনি হলেন আমুন রা
“সত্যের প্রভু, দেবতাদের পিতা, বিশ্বমানবের স্রষ্টা, প্রাণীদের কারিগর, সকল স্রষ্টারও প্রভু” – আমুন রায়ের প্রার্থনাসঙ্গীত এমনই। মিশরীয় দেবতাদের মাঝে সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দেবতা সূর্য এবং জীবনের প্রতীক। অনেক আগে মিশরীয়রা ‘আমুন’ ও ‘রা’ নামে দুজন আলাদা দেবতার পূজা করত। আমুন এবং রা একজন দেবতা হয়ে ওঠেন খ্রিষ্টপূর্ব ২০৪০ সালের দিকে। তাদের একত্বতার তাৎপর্য বুঝতে পৃথক সত্ত্বা সম্পর্কে বিশদভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।

থিবসের দেবতা আমুন

মাথায় হামানদিস্তাসহ নীল থিবীয় দেবতা আমুন; image source: Self Help Warehouse

আগে থেকেই থিবস প্রাচীন মিশরের বেশ গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। কিন্তু ২০৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে মিশরে রাজনৈতিক পট বদলায়, সাথে বদলায় থিবসের ভাগ্যও। থিবসকে ঠিক করা হয় মিশরের রাজধানী হিসেবে। এরপর প্রায় এক হাজার বছর ধরে থিবসই ছিল মিশরের রাজধানী। পরের সময়কালে রাজধানী হিসেবে টিকে না থাকলেও মিশরের প্রধান ধর্মীয় শহর হয়ে ওঠে এটি। আর এর ফলেই থিবসের আঞ্চলিক দেবতা আমুন মিশরের সবচাইতে শক্তিশালী দেবতায় পরিণত হয়েছিলেন।

আমুন কিন্তু প্রথম থেকেই থিবসের প্রভু ছিলেন না। ঈশ্বর হিসেবে তাকে আরাধনা প্রথম থিবস থেকে শুরু হয়নি। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে, আমুন আসলে ছিলেন মিশরের শাসকশ্রেণীর মানুষদের আরাধ্য। থিবসে তার মহিমা উচ্চারিত হওয়ার আগে তিনি দক্ষিণ মিশরে হারমোপোলিসের আঞ্চলিক দেবতা ছিলেন। তার ক্ষমতা তখন অত মহিমায়িত হয়নি। হারমোপোলিসের স্থানীয়রা তাকে বাতাসের নিয়ন্ত্রক ভেবে পূজা করত। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে থিবস পর্যন্ত আমুনের আরাধনার চল চালু হয়। থিবসের শাসকেরা তার পূজারী ছিলেন, ফলে তাকে জাতীয় দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। পদমর্যাদার সাথে সাথে আমুনের ক্ষমতার গল্পও বাড়তে থাকে।

১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে হিক্সোস জাতির আক্রমণকারীরা যখন উত্তর মিশর দখল করে নেয় তখন শুধু দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা আমুনের পূজা চালু রাখে। ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরীয়রা হিস্কোসদের থেকে মিশর পুনরুদ্ধার করে। যেহেতু তখন মিশরের মানুষের জন্য সর্বময় ঈশ্বর ছিল আমুন, তারা ধরে নেয় আমুনের কৃপাতেই তাদের এই সৌভাগ্য। ফলে আমুনের প্রভাব আরো বাড়ে। একই সঙ্গে বাড়ে তার মন্দিরের আকার, সংখ্যা, সৌন্দর্য ও পূজারী।

তাকে থিবসে বলা হতো লুকানো ঈশ্বর। কারণ তিনি বায়ুর মতো বিমূর্ত জিনিসের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। মিশরীয়রা মানত, সবখানে আমুন আছেন, কিন্তু তাকে দেখা যায় না। পরে তাকে উর্বরতার দেবতা বলেও মানা হতো। খোদাই করা ছবিতে আমুনকে দেখানো হয়েছে মাথায় কাপড় পেঁচানো একজন পুরুষ হিসেবে। তার মুখে দাড়ি, হাতে মিশরীয়দের জীবনের চিহ্ন, অপর হাতে রাজদণ্ড। মাথায় একটা হামানদিস্তা, তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে দুটো উটপাখির পালক। আরেকটা রূপে তার মাথা ছাগলের। আমুনকে বেশিরভাগ সময় ফারাওয়ের মতো রাজসিংহাসনে বসে থাকতে দেখা যায়। আমুনের স্ত্রী আমোউনেত হলেন আকাশের দেবী। তাকে আঁকা হয়েছে মাথায় সাপওয়ালা এক নারীর রূপে।

প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে বড় দুটি মন্দির অবস্থিত লুক্সর আর কারনাক-এ। এদের দুটোই আমুনের সেবায় নিয়োজিত ছিল। মন্দিরের ঐশ্বর্য দেখলে বোঝা যায় আমুনের কাল্ট কতটা সম্পদশালী ছিল।

কারনাকের মন্দিরে আমুন রা এর মূর্তি; image source: Egypt Tours Portal

প্রথমত আমুন আর পাঁচটা মিশরীয় দেবতার মতো রোজকার নৈবদ্যে খুশি ছিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছার চেয়ে বড় কথা তার পূজারীদের ইচ্ছা। তার পূজারীদের গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথেই তার গুরুত্ব বাড়াতে রা দেবতার সাথে তাকে যুক্ত করা হল। সূর্যদেবতা রা এর সাথে মিলে তৈরি হল নতুন উপাস্য আমুন রা। মিশরীয়দের কাছে তিনি শুধু দেবরাজ নন, বরং ফারাওদের পিতা ছিলেন। যার অসীম ক্ষমতাবলে ফারাওরা একের পর এক যুদ্ধ জিতে যায়।

হায়ারোগ্লিফিকে পাওয়া আমুন

আমুন সম্পর্কে লিখিত যত তথ্য পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই অতি প্রাচীন। তখনও আমুন মিশরের সর্বোচ্চ ঐশীশক্তি হয়ে ওঠেননি। তখনও আমুনকে আর সব সাধারণ দেবতাদের কাতারেই ফেলা হতো। ফলে আমুনের নামে খুব বেশি লিপি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাতে তৎকালীন আমুনকে সমুদ্র অভিযাত্রীদের রক্ষক আর পথপ্রদর্শক করে দেখানো হয়েছে। এখানে আমুনের গায়ের রঙ নীল।

সূর্যের দেবতা রা

খোদাই করা সূর্যদেবতা রা; image source: Wikimedia Commons

রা’কে কিন্তু আমুনের মতো অনেকদিন সময় নিয়ে খ্যাতি অর্জন করতে হয়নি। তিনি সবসময়েই মিশরের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন। তিনি সূর্যের দেবতা। মানা হতো সকল প্রাণ এসেছে সূর্য থেকে, সুতরাং সূর্যের মতো তার দেবতাও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমদিকের ফারাওদের মনে করা হত রা এর অবতার। মানুষ ভাবত রোজ সকালে সূর্য জন্মায়, সন্ধ্যায় মারা যায়। ঠিক যেন ফারাও। পরের সকালে আবার নতুন সূর্য আসে, যেমন আসে নতুন ফারাও। এখান থেকে তারা ভাবতে শুরু করে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে। সেই জীবনে যেন ফারাওয়ের কষ্ট না হয়, আর ফারাও পুনর্জন্মে ঠিকমত রাজা হতে পারেন তাই তার দেহ অক্ষত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল প্রাচীন মিশরীয়রা।

একবার তো রা ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তার বয়স হয়েছে বলে মানবসমাজ তাকে আর আগের মতো মর্যাদা দেয় না। তার বাবা ‘নু’ দেবতাদের মাঝে সবচেয়ে প্রাচীন। নু তাকে বললেন, তোমার এত রেগে কাজ কী? এটা চোখ দিলেই তো মানবজাতি শাস্তি পেয়ে যাবে। রা শাস্তি দিতে হাথর আর সেখমেথ কে পাঠিয়েছিলেন, তারা পুরো মানবজাতি ধ্বংস করে দিতে চায়। রা এত বেশি শাস্তি চাননি। তিনি হাথর আর সেখমেথকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা করেন। এমন আরো গল্প প্রচলিত আছে সূর্যদেব রা কে নিয়ে। 

রা কে চেনা যায় বাজপাখির মাথা দিয়ে। মাথার উপর আছে সূর্যের চাকতি। মেম্ফিস মিশরের রাজধানী থাকাকালে প্রধান দেবতা ছিল রা। কিন্তু ২০৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাজধানী বদল হওয়ার পর রা মিলে গেল থিবীয় ঈশ্বর আমুনের সাথে। তাদের এই জুটি মিশরের স্বর্ণযুগে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেবতা হিসেবে পূজো পেয়ে গেছেন।

কিশতিতে চড়ে রা রোজ পূর্ব থেকে পশ্চিমে যান; image source: National geographic society

আমুন রা, মহান দেবতা

একসাথে মিলে যাওয়ার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্য, রূপ ও ক্ষমতারও মিল হয়। মিলিত সত্ত্বার মাঝে আমুনের মতো উর্বরতা শক্তি বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা যেমন ছিল, তেমনই ছিল রা এর মতো সূর্যের মালিকানা আর পূনর্জন্মের শক্তি। আরো বেশি শক্তিশালীরূপে তিনি উচ্চারিত হতেন ফারাওদের সাথে। নাবিকদের রক্ষক হয়ে গেলেন সম্রাটদের রক্ষক।

আমুন রা’র রূপ

প্রভাবশালী দেবতা আমুন রা; image source: Flickr

পাথরের খোদা করা লিপিতে আমুন রা’র বিভিন্ন রূপ আমরা পেয়েছি। এদের একটা হলো আমুন রা দুটি ভূমির এক সিংহাসনের মালিক। এখানে আমুন রা’র মাথায় শোভা পায় লাল ও সবুজ অথবা লাল ও নীল রঙের দুইটি পালক। এই রূপটির হাতে আছে রাজদণ্ড। আরেকটি বিশেষ রূপ হল ‘আমুন রা আতুম’। এটি থিবীয় আমুন রা এর রূপ। এখানে দেবতার মাথা বাজপাখির ন্যায়, মাথার উপর সূর্যের চাকতিকে ঘিরে আছে একটা সাপ। একটা ব্যতিক্রমী রূপ হলো ‘আমোন মিন কামু্তেহপ’ । দেবতা এখানে একটা বাচ্চা ষাঁড়। সকাল বেলায় তিনি বাচ্চা থাকেন। বেলা বাড়ার সাথে সূর্যের গতিতে তার বয়স বাড়ে। সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। আবার পরের দিন তিনি নবজীবন লাভ করেন।

রোমানদের জুপিটার আর গ্রিকদের জিউসের মতো আমুন রা জায়গা করে নিয়েছিলেন মিশরের সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি আর সাহিত্যে। আর সময়ের স্রোতে তিনি বেঁচে রয়েছেন উপকথার মাঝে। 

ফিচার ইমেজ: Heroes From Newerth Lore

Related Articles

Exit mobile version