আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ কতশত গোপন বা পরীক্ষামূলক অপারেশন চালিয়েছে, তার হিসাব নেই। সেগুলোর অনেকগুলোই প্রকাশিত হয়নি, অনেকগুলো হয়েছে তবে পুরোপুরি নয়। প্রকাশিত হওয়া সিআইএ’র এমন দশটি গোপন অপারেশন নিয়েই আজকের আলোচনা, যেগুলো ব্যর্থ এবং অনৈতিক।
১০. সেক্স টেপ!
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হওয়া লীড নিউজ দেখে মুহূর্তে আপনার ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো, এটা কি আসলেই সত্য? ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনকে এরকমই একটি সংবাদের শিরোনাম করতে চেয়েছিল আমেরিকার সিআইএ। যে শিরোনামটি দেখে আঁতকে উঠতে পারতেন, তা হতে পারতো এরকম, “ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন সমকামী!” তবে ভাগ্যিস এরকম কোনো সংবাদ আমাদের পড়তে হয়নি!
২০০৩ সালে, আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পূর্বে এরকমই এক হাস্যকর ‘প্রোপাগান্ডা অপারেশন’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিআইএ। সাদ্দামের মতো দেখতে চেহারার কারো সাথে কোনো অল্পবয়সী ছেলের যৌন সঙ্গম করানো হবে এবং তা এমনভাবে ভিডিও করা হবে, যেন দেখে মনে হয় তা গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত একটি ‘সেক্স টেপ’! ভাগ্যক্রমে উপরমহলের অনেক সিআইএ কর্মকর্তা এই উদ্ভট পরিকল্পনার পরিণাম উপলব্ধি করে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। সিআইএ’র উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ভিডিওটি দেখে সাদ্দামের সমর্থকরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে শেষপর্যন্ত এ ধরনের কোনো ভিডিও তৈরি করা হয়নি।
৯. অপারেশন মারলিন
ইরানে শুরু হয়েছে পারমাণবিক কর্মসূচী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই ভাঁজ মিলিয়ে দিতে সিআইএ হাজির হলো তাদের এক ‘অভূতপূর্ব’ পরিকল্পনা অপারেশন মারলিন নিয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমেরিকাতে অবস্থান করছে এমন একজন রাশিয়ান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করা হবে ইরানের সাথে যোগাযোগের জন্য। এই বিজ্ঞানীর কাজ হবে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট সরবরাহ করা। সেই ব্লুপ্রিন্ট দেবে আমেরিকা, যা কিনা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে ভরপুর থাকবে!
১৯৯৭ থেকে শুরু হলো অপারেশনের কাজ। একজন সাবেক রাশিয়ান পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানীকে নিয়োগ করা হলো মাসিক ৫ হাজার ডলার বেতনে, যা পরে বেড়ে ৬ হাজার হয়েছিল। এই রাশিয়ান বিজ্ঞানীর দ্বারাই ২০০০ সালের ৩ মার্চ ‘টিবিএ-৪৮০ ফায়ার সেট’ মডেলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানীদের সরবরাহ করে সিআইএ। মজার ব্যাপার হলো, রাশিয়ান বিজ্ঞানীও জানতো না যে এই ব্লুপ্রিন্টে রয়েছে সিআইএ’র ‘মোডিফিকেশন’। বরঞ্চ সিআইএ’র পক্ষ থেকে এই মডেলকে, তখনকার সময়ের চেয়ে অন্তত ২০ বছর অগ্রসর বলে দাবি করা হয়!
সিআইএ’র জন্য নিছক পরিতাপের বিষয় যে, রাশিয়ান সেই পরমাণু বিজ্ঞানী ‘২০ বছর অগ্রসর’ মডেলে কিছু মারাত্মক ভুল ধরে ফেলেন এবং ইরানিদের অবহিত করেন। তখন সিআইএ’র নিকট নিজেদের পরিকল্পনাই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো হয়। কারণ ২০ বছরের অগ্রসর দাবি করার জন্য তারা প্রকৃতপক্ষেই অনেক উন্নত ডিজাইন পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে সূক্ষ্মভাবে কিছু ভুল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে ইরানি বিজ্ঞানীদের জন্য এই ভুলগুলো জেনে যাবার পর, সঠিক অংশগুলো কাজে লাগানো আরো সহজ হয়ে যায়!
৮. অপারেশন মনগুজ
১৯৬১ সালে কিউবায় সিআইএ পরিচালিত ‘বে অব পিগস’ ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র আরো মরিয়া হয়ে ওঠে ক্যাস্ট্রোকে হটানোর জন্য। তবে এবার ভিন্ন কৌশলে আগাতে হবে। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনার নাম ‘কিউবান প্রোজেক্ট’ রাখা হলেও পরে তা ‘অপারেশন মনগুজ’ নামে পরিচিতি পায়। বে অব পিগসের ব্যর্থতার পরপরই সিআইএ তাদের নতুন পরিকল্পনা তৈরিতে লেগে পড়ে। ১৯৬২’র ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং মার্চে তা প্রেসিডেন্ট ও সিকিউরিটি কাউন্সিলের অনুমোদন পায়। এবারের পরিকল্পনা একাধিক, যেমন- গুপ্তচর দ্বারা কিউবান মানুষকে ক্যাস্ট্রোবিরোধী করে তোলা, ক্যাস্ট্রো প্রশাসনে নিজেদের গুপ্তচর ঢোকানো, কিউবার অর্থনীতি দুর্বল করে দেয়া এবং ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার নানাবিধ ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি। পরিকল্পনা সফল তো হবেই। কারণ একটা না হলে অন্যটা হবে!
যা হোক, ১৯৬২ সালের এপ্রিলে অপারেশন মনগুজ ধীরে ধীরে শুরু হয়। কিউবার মিসাইল সংকটের জন্য কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পরে তা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত (কিংবা এর পরেও) চলেছিল। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই এবং অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি এই অপারেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান। আর মূল অপারেশন পরিচালনা করেন সিআইএ’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ল্যানসডেল, হার্ভে এবং ফিটজারেল্ড। প্রাথমিকভাবে ১০টি ৬ সদস্যের গুপ্তচরের দল প্রেরণ করা হয় কিউবায়। তাদের মূল কাজই ছিল কিউবায় নিজেদের সমর্থক খুঁজে বের করা কিংবা বৃদ্ধি করা। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তারা প্রত্যাশিত সংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগেরও কম কিউবান মানুষকে বিদ্রোহের জন্য জড়ো করতে পেরেছিল!
এভাবে আর হবে না বুঝতে পেরে শুরু হয় কিউবার অর্থনীতি দুর্বল করার নানাবিধ চেষ্টা এবং ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করবার ফন্দি ফিকির। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি উদ্ভট পরিকল্পনা ছিলো,
- ক্যাস্ট্রোর ঘরে বিষাক্ত ঔষধ রাখা।
- ক্যাস্ট্রো যে রেডিও স্টেশনে যেতেন, সেখানে অ্যারোসলের মাধ্যমে লাইসারজিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দেয়া।
- সিগারেটের মধ্যে বিস্ফোরক স্থাপন করে দেয়া।
- ক্যাস্ট্রোকে স্কুবা ডাইভিং স্যুট উপহার দেয়া, যার মধ্যে পূর্বেই মরণঘাতী রোগের জীবাণু স্থাপন করা থাকবে।
- ক্যাস্ট্রো যে স্থানে স্কুবা ডাইভিংয়ে যান, সেখানে ঝিনুকের মধ্যে বিস্ফোরক স্থাপন করে দেয়া।
- যেসব মাফিয়া ক্যাস্ট্রোর জন্য কিউবায় ক্যাসিনো চালাতে পারছিলেন না, তাদের সাহায্য নেয়া।
- সিগারেটে বিস্ফোরক না দিয়ে বিষ দিয়ে দেয়া।
- ক্যাস্ট্রোর চা-কফিতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মিশিয়ে দেয়া।
- ক্যাস্ট্রোকে ফাউন্টেইন পেন উপহার দেয়া, যাতে থাকবে বিষ।
এগুলো সহ কমবেশি ৬০০ বার, ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ। ক্যাস্ট্রোর সাবেক প্রেমিকা মার্শিয়া লরেঞ্জের মাধ্যমে ক্যাস্ট্রোর ঘরে বিষাক্ত বড়িভর্তি একটা ঔষধের কৌটাও পৌঁছাতে সক্ষম হয় সিআইএ। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। বাৎসরিক ৫০ মিলিয়ন ডলার হিসেবে, ১৯৬১-৭৫ সাল পর্যন্ত, ৫০০ মার্কিন এবং প্রায় ২,৫০০ কিউবানের পেছনে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিপুল অর্থ ও জনশক্তি ব্যয় করার ফলাফল শূন্যও ছিল না, ছিল তার চেয়েও কম!
৭. জাল টিকাদান
সাবেক আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে কী না করেছে সিআইএ? তাদের মরিয়া প্রচেষ্টা অনেকসময় জন্ম দিয়েছে বিতর্কের। তবে, সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক যে কাজটি করেছিল সিআইএ, তা হচ্ছে নকল টিকাদান কর্মসূচী। তারা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের আশেপাশের অঞ্চলে বিন লাদেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে, টিকাদানের নাম করে হাজারো শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এসব নমুনার কোনোটির সাথে যদি বিন লাদেনের ডিএনএ মিলে যায়, তাহলেই হলো! এই হীন পরিকল্পনাকে বাস্তবতার মোড়কে ঢেকে দেয়া হয় পাকিস্তানি ডাক্তার শাকিল আফ্রিদিকে নিয়োগ করে। তবে, লাদেনের মৃত্যুর দুদিনের মাথায়ই সব ফাঁস হয়ে যায় এবং গ্রেফতার হন শাকিল। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সিআইএর এই অপারেশনের ফলাফল ছিল ভয়াবহ। পোলিও প্রবণ পাকিস্তানে এই ঘটনার পর থেকেই টিকাদান কর্মসূচী একরকম বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ প্রকৃত টিকাদান কর্মসূচীকেও গোয়েন্দাদের ষড়যন্ত্র বলে ভাবতে শুরু করে!
৬. অপারেশন কেওস
১৯৬৭-৭৪ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর সিআইএ পরিচালনা করে তাদের ইতিহাসে অন্যতম ‘উদ্দেশ্যহীন’ এক অপারেশন। দেশের যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন কিংবা অন্যান্য আন্দোলনরত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো বৈদেশিক প্রভাব আছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে আমেরিকার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের উপর নজরদারি শুরু করে সিআইএ। ‘ম্যায় হু না’র রাম শর্মা হয়ে সিআইএ কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সাথে এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ‘Students for a Democratic Society’, ‘Black Panther’, ‘Young Lords’ সহ আরো বেশকিছু জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনের উপর প্রধানত মূল নজরদারি চালায় সিআইএ। আট বছরে সর্বমোট ১ হাজার সংগঠনের ৩ লক্ষাধিক মানুষের উপর চলা এই নজরদারিতে তালিকাভুক্ত করা হয় ৭ হাজার মানুষের নাম। এই অপারেশন চলাকালীন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অসংখ্য মানুষ গ্রেফতার করে সিআইএ। হত্যা করা হয় ব্ল্যাক প্যান্থারের ডজনখানেক সদস্যকে।
৫. অপারেশন অ্যাকাউস্টিক কিটি
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আড়ি পাতার জন্য কিছুই বাদ রাখেনি সিআইএ। নির্বিঘ্নে আড়িপাতার জন্য তারা শুরু করেছিল বিড়ালকে প্রশিক্ষণ দেয়া! ‘অপারেশন অ্যাকাউস্টিক কিটি’ নামক এই অপারেশনে, প্রথমে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিড়ালের কানে মাইক্রোফোন এবং মাথায় রেডিও ট্রান্সমিটার বসানো হয়। আর এ দুইয়ের মধ্যে সংযোগের জন্য সূক্ষ্ম তার বসিয়ে দেয়া হয় বিড়ালের লোমের মাঝে। ব্যস, কথা রেকর্ড করার জন্য বিড়াল প্রস্তুত। এরপর একে বিশেষ কায়দায় ট্রেনিং দেয়া হতো ক্রেমলিনের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর জন্য। ১৯৬৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ওয়াশিংটনের রাশিয়ান দূতাবাসে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে একটি প্রশিক্ষিত বিড়াল ছেড়ে দেয়া হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে বিড়ালটি একটি ট্যাক্সির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। পরবর্তীতে সিআইএ’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অপারেশন বাস্তবসম্মত নয় বলে মত প্রকাশ করলে, এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পর সিআইএ’র ব্যর্থ অপারেশনের তালিকায় নতুন যুক্ত হয় এই অপারেশনের নাম।
৪. অপারেশন মোকিংবার্ড
বহিরাগত কোনো প্রভাব দ্বারা, বিশেষ করে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা পরিচালিত সাংবাদিক সংস্থাকেই বলা হয় ‘ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন অব জার্নালিস্টস’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাশিয়া এরকম প্রায় ডজনখানেক ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন চালু করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল কেজিবি নিয়ন্ত্রিত ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব জার্নালিস্টস’ বা আইওজে। আইওজে’র কমিউনিজম বিষয়ক প্রচারণার বিপরীতে কমিউনিজম বিরোধী প্রচারণা করবার জন্য সিআইএ শুরু করে ‘অপারেশন মোকিংবার্ড’। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই প্রজেক্ট শুরু হয় ১৯৫১ সালে। ২৫টি সংবাদপত্র এবং সংবাদসংস্থার সাথে যোগাযোগ করে সিআইএ। সাংবাদিকদের ঘুষ দেয়া সহ সব ধরণের তদবির করে, কমিউনিজম বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে সিআইএ। আর এসবের পেছনে বছরে খরচ হতো ২৩৫ মিলিয়ন ডলার! ১৯৭৬ নাগাদ এই ‘অর্থহীন সাদা হাতি’ গোপন অপারেশন শেষ হতে হতে বেঘোরে ব্যয় হয়ে গেছে বিশাল অঙ্কের অর্থ! যদিও প্রথম দিকে খরচ অনেক কমই হতো। তথাপি, নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও, মোট খরচটা ২ বিলিয়নের নিচে যায়নি কোনো তাত্ত্বিকের অনুমানেই!
৩. অপারেশন আর্টিচোক
“আমরা কি মানুষের মনের উপর এমন নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারবো, যেখান থেকে সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সহায়তা করবে?” এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই সিআইএ শুরু করেছিল একটি কুখ্যাত গোপন প্রজেক্ট, যার নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লুবার্ড’। এর নামই ১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অপারেশন আর্টিচোক’। তবে ১৯৫২ সালে যখন মূল প্রজেক্ট শুরু হয়ে যায়, তখন আরেক দফা নাম পরিবর্তন করে ‘অপারেশন এমকে-আলট্রা’ করা হয়।
যা-ই হোক, সিআইএ’র সাথে এই অপারেশনে যুক্ত ছিল আমেরিকান সেনাবাহিনী, নেভি, বিমানবাহিনী এবং এফবিআইও। ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন গোপন স্থানে, অসংখ্য মানুষকে এই অপারেশনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে মানসিক চাপের সম্মুখীন করা হয়। তাদেরকে এলএসডি আর মরফিনের মতো মাদকে আচ্ছন্ন রাখা হতো টানা তিনদিন। নানা প্রক্রিয়ায় সম্মোহিত করার মাধ্যমে নিদ্রাহীনতা ঢুকিয়ে দেয়া হতো পরীক্ষা চলতে থাকা মানুষটির উপর। আর এই মানসিক অত্যাচারের শিকার হতো মূলত সমকামী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং জেলের বন্দীরা। মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই, শারীরিক নিপীড়ন না করে, কেবল মানসিক অত্যাচার দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদ সফল করা যায় কিনা, তা দেখা। এই হীন পরীক্ষামূলক অপারেশনের বলি ঠিক কতজন হয়েছিল, কবে শেষ হয়েছিল এসব জানা যায় না। কারণ, ৮০’র দশকে এই অপারেশন আর্টিচোকের কথা ফাঁস হবার পূর্বেই সকল ক্লাসিফায়েড তথ্য ধ্বংস করে ফেলা হয়!
২. অপারেশন নর্থউডস
- কিউবা থেকে আসতে থাকা ক্যাস্ট্রোপন্থী অনেক শরণার্থীর নৌকা ডুবিয়ে দিতে হবে।
- আমেরিকায় বসবাসরত কিছু কিউবান অভিবাসীকে হত্যা করতে হবে।
- কিউবার সমুদ্রসীমার কাছাকাছি একটি আমেরিকান জাহাজ ডুবিয়ে দিতে হবে।
- আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে কিছু সাধারণ মার্কিনকে হত্যা করতে হবে।
এই পরিকল্পনা কারা করতে পারে? আমেরিকা নিজেদের নাগরিক কেন হত্যা করবে? আর রাশিয়ান পরিকল্পনায়ও কিউবানদের ক্ষতি থাকার কথা না। তাহলে? এরকম পরিকল্পনা কেবল একটি সংগঠনই করতে পারে, আর তারা হচ্ছে সিআইএ! হ্যাঁ, নিজেদের নাগরিক হত্যা করে, নিজেদের কিছু প্রধান শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, কিউবানদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করাই ছিল এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য! এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে সেগুলো কিউবার নামে চালিয়ে দিলে, কিউবাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ফেলা যাবে। পাশাপাশি, প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে সরাসরি কিউবা আক্রমণও করা যাবে! আর এই পরিকল্পনার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন নর্থউড’। তবে, এই অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যা সম্পর্কিত তথ্যাবলীর সাথে এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার কথা প্রথম জনসমক্ষে আসে। তবে ভাগ্যক্রমে, এই অশুভ পরিকল্পনাটির অনুমোদন দেননি প্রেসিডেন্ট কেনেডি। যদিও আমেরিকান প্রতিরক্ষার সকল উর্ধ্বতন হর্তাকর্তাই এই পরিকল্পনাকে ‘সময়োপযোগী’ আখ্যা দিয়ে অনুমোদন করেছিলেন, শুধুমাত্র কেনেডির বাধায় এর কার্যক্রম শুরু হচ্ছিল না। এসময় কেনেডি এই পরিকল্পনা অনুমোদনের দায়ে যৌথবাহিনীর চেয়ারম্যান লেমনিটজারকে বরখাস্ত করেন। আর কিউবান মিসাইল দুর্যোগের সময়ও কেনেডির উদারনীতিক চিন্তাভাবনা ক্ষুব্ধ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদেরকে। কেনেডির হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর মধ্যে এটিও একটি যে, অপারেশন নর্থউড অনুমোদন না করা এবং লেমনিটজারের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়াই তার এই পরিণতি ডেকে এনেছিল!
১. ফিনিক্স প্রোগ্রাম
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব সাউথ ভিয়েতনাম’ বা ভিয়েত কং বাহিনীর মূল অবকাঠামো ধ্বংস করা, তাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে ধরে নিষ্ক্রিয় করে দেয় কিংবা হত্যা করার জন্য ‘ফিনিক্স প্রোগ্রাম’ নামে এক ভয়াবহ ও নৃশংস গোপন পরিকল্পনা হাতে নেয় সিআইএ। ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রোগ্রামে অবর্ণনীয় বর্বরতা চালায় সিআইএ। প্রমাণিত কিংবা সন্দেহভাজন ভিয়েত কং, কেউ বাদ যায়নি সিআইএ’র অত্যাচার থেকে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলা এই প্রোগ্রামে সিআইএ’র অত্যাচারের কিছু রোমহর্ষক পদ্ধতি উল্লেখ করছি।
- ধর্ষণ, গণধর্ষণ থেকে শুরু করে সাপ, পাঁকাল মাছ নামক একপ্রকার সাপের মতো মাছ, শক্ত সরু বস্তু ইত্যাদি ব্যবহার করে ‘সৃজনশীল’ উপায়ে নারীদের উপর বর্বরতা চালানো!
- জিহ্বা, জননাঙ্গের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া!
- মাথা নিচের দিকে করে বারবার পানিতে ডোবানো।
- দুই হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো।
- হাত-পা বেঁধে বন্দীর উপর আক্রমণাত্মক কুকুর ছেড়ে দেয়া।
- দিনের পর দিন আটকে রেখে অনাহারে হত্যা করা।
- কানের মধ্য দিয়ে সরু রড, কাঠ বা এ জাতীয় কিছু প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা!
১৯৭২ সালে মূল প্রোগ্রাম শেষ হলেও, ফিনিক্স প্রোগ্রামের বেশ কিছু কার্যক্রম চলতে থাকে ১৯৭৫ সালে সাইগন শহরের পতন পর্যন্ত। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সিআইএ’র বর্বরতার শিকার হয়ে ২৬,০০০-৪১,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে! প্রাণহানি এবং বর্বরতার ধরন বিবেচনায়, সিআইএ’র সকল গোপন অপারেশনের মধ্যে ফিনিক্স প্রোগ্রাম সবচেয়ে নৃশংস অপারেশনের তালিকায় সহজেই প্রথমে চলে আসে।
ফিচার ছবি: wallpaperswide.com