১৫ রাজার হাস্যকর যত ডাকনাম

এমন কি কখনো হয়েছে, বন্ধুবান্ধব আপনাকে মজা করে কোনো ডাকনাম দিয়েছে, আর তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকা বা বন্ধুমহলব্যাপী? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কারো স্বাস্থ্য একটু ভালো হলে ‘ভোটকা’, চশমা পরলে ‘কানা’, এক ডাকে সাড়া না পেলে ‘বয়রা’- এমন কত উদ্ভট ডাকনাম যে প্রচলিত আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! খুব অপছন্দের এই ডাকনামে আপনি যতই অস্বস্তিবোধ করেন না কেন, একে গায়েব করে দেয়ার কোনো উপায় নেই। তবে ইতিহাসের দাপুটে ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত কিছু মানুষের লজ্জাজনক ডাকনামগুলো দেখার পরে নিজের নাম নিয়ে খেদ খানিকটা হলেও মিটে যাওয়ার কথা। মধ্যযুগের এমন ১৫টি রাজকীয় ডাকনাম নিয়েই সাজানো হলো আজকের আয়োজন, যা দেখে সে সময়কার মানুষের রসবোধ খুব ভালো করে টের পাওয়া যায়।

১. কনস্ট্যান্টিন দ্য ডাং (গুবরে কনস্ট্যান্টিন)

গুবরে কনস্ট্যান্টিন; Source: all-that-is-interesting.com

রাজা পঞ্চম কনস্ট্যান্টিন ৭৪১ সাল থেকে ৭৭৫ সাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইনের শাসক ছিলেন। শত্রুরা তার নামে গুজব রটিয়ে দিল, শৈশবে তিনি নাকি একবার উপাসনালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মলত্যাগ করে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছিলেন। একজন রাজার জন্য এহেন গুজব যথেষ্ট লজ্জাজনক। শত্রুদেরই বা কী দোষ? মাত্রই কন্সটেন্টাইনের কাছে হেরে গিয়ে তার খ্যাতি নষ্ট করতে এর চেয়ে বাজে গল্প বানানোর সময় মোটেই তাদের হাতে ছিল না!

২. হেরাল্ড দ্য লাউসি (উকুনে ভরা হেরাল্ড)

উকুনে ভরা হেরাল্ড; Source: all-that-is-interesting.com

মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের কাছে হেরাল্ড ফেয়ারহেয়ার নরওয়ের প্রথম রাজা হিসেবে পরিচিত। ৮৭২ থেকে ৯৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তিনি। কথিত আছে, রাজা হওয়ার আগ পর্যন্ত চুল কাটবেন না- এমন একটি ব্রত করেছিলেন তিনি। রাজা হতে হতে কেটে যায় প্রায় ১০ বছর। এই দীর্ঘসময়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটা নিয়ে একটু প্রশ্ন উঠতেই পারে। কাজেই সবার মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়, কত উকুন আছে ঐ চুলে? একটি, দুটি, নাকি হাজার হাজার?

৩. চার্লস দ্য বাল্ড (টেকো চার্লস)

টেকো চার্লস; Source: all-that-is-interesting.com

ইতালির পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার রাজা চার্লস রাজত্ব করেছেন ৮৭৫-৭৭ খ্রিস্টাব্দ। রোমান শাসক হিসেবে পরিচিত রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আক্ষরিক অর্থে টাক ছিলো না। মাথায় অনেক চুল নিয়েও কীভাবে যে এই বিশেষণ তার কপালে জুটল, তা এক রহস্যই বটে!

৪. এরিক দ্য প্রিস্ট হেটার (পাদ্রী বিদ্বেষী এরিক)

পাদ্রী বিদ্বেষী এরিক; Source: all-that-is-interesting.com

এরিক ম্যাগনুসন বা ‘এরিক দ্য প্রিস্ট হেটার’ ১২৮০ থেকে ১২৯৯ সাল পর্যন্ত নরওয়ের রাজা ছিলেন। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, গির্জার সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। পাদ্রীরা ছিল তার দু’চোখের বিষ। কাজেই এমন একটি ডাকনাম তিনি পেতেই পারেন।

৫. জন দ্য বেবিমেকার (সন্তান উৎপাদক জন)

সন্তান উৎপাদক জন; Source: all-that-is-interesting.com

ক্লেভস শহরের রাজা দ্বিতীয় জন ১৪৮১ সালে সিংহাসনে আরোহণ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫২১ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বিয়ের আগেই তার সন্তানের সংখ্যা ছিল জানামতে ৬৩! আর বিয়ের পর তার সন্তানের সংখ্যা মাত্র তিন। বিয়ের আগের এত কর্মতৎপর জীবনের জন্য ‘বেবিমেকার’ উপাধি তিনি পেতেই পারেন!

৬. উইলিয়াম দ্য গ্রেটেস্ট ডিবুচি অফ দ্য এজ (সময়ের সেরা লম্পট উইলিয়াম)

সময়ের সেরা লম্পট উইলিয়াম; Source: all-that-is-interesting.com

নেদারল্যান্ডের রাজা এবং লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড ডিউক তৃতীয় উইলিয়াম ১৮৪৯ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি তার দারুণ আকর্ষণ ছিল। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকাই তাকে প্রথমবারের মতো সেরা লম্পট হিসেবে অভিহিত করে। উইলিয়াম বেবিমেকার জনের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন বটে!

৭. হেনরি দ্য ইম্পোটেন্ট (নপুংসক হেনরি)

নপুংসক হেনরি; Source: all-that-is-interesting.com

জন আর উইলিয়ামের ঠিক উল্টোটা ছিলেন ক্যাস্টাইলের রাজা চতুর্থ হেনরি। ১৪৫৪ সাল থেকে ১৪৭৪ সাল পর্যন্ত সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। দূর সম্পর্কের বোন ব্লঞ্চকে বিয়ে করার ১৩ বছর পরেও তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত না হওয়ায় হেনরিকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্থানীয় গণিকারা অবশ্য জানিয়ে দেয়, হেনরি একদম ঠিক আছেন। হেনরি নিজে দাবি করেন এক অভিশাপের কথা মাথায় রেখে স্ত্রীকে স্পর্শ করেননি তিনি। পরবর্তীতে আরেক আত্মীয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এই সংসারে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তবে গুজব শোনা যায়, এই কন্যার পিতা হেনরি নন। তবে হেনরির পুরো আত্মজীবনীই লিখেছেন তার সৎবোন, কাজেই ইতিহাস এখানে খুব ‘জটিল’।

৮. বারমুডো দ্য গাউটি (গেঁটেবাতগ্রস্ত বারমুডো)

গেঁটেবাতগ্রস্ত বারমুডো; Source: all-that-is-interesting.com

রাজা দ্বিতীয় বারমুডো শুরুতে ছিলেন গ্যালিসিয়ার রাজা, দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের এক অনবদ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে ৯৯৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র লিওন রাজ্য ছিল তার দখলে। আর্থ্রাইটিসের জটিল এক রূপ গেঁটেবাতে ভুগছিলেন তিনি। জীবনের শেষদিকে রোগটি তাকে এতটাই ভুগিয়েছে যে, তিনি ঘোড়ায়ও চড়তে পারতেন না। মানুষের মুখে মুখে তার নাম হয়ে যায় ‘বারমুডো দ্য গাউটি’।

৯. সেবাস্তিয়ান দ্য ভার্জিন কিং (কুমার রাজা সেবাস্তিয়ান)

কুমার রাজা সেবাস্তিয়ান; Source: all-that-is-interesting.com

১৫৫৭ সাল থেকে ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত পর্তুগাল এবং অ্যালগারভেস শাসন করেন রাজা প্রথম সেবাস্তিয়ান। রাজ্যাভিষেকের সময় তিনি আক্ষরিক অর্থেই শিশু ছিলেন। পরবর্তীতে তার বয়স বিশের ঘরে পড়লে তিনি পরিণত হন লম্বা, চিকন, স্বর্ণকেশী, সুদর্শন এক যুবকে। কিন্তু তার জীবনে নারী বলতে আত্মীয়-স্বজন আর পরিবারের সদস্যরা ছাড়া অন্য কারো অস্তিত্ব ছিল না। কখনো বিয়ে করেননি তিনি। বলা ভালো, সুযোগ পাননি বিয়ে-থা করার। অল্প বয়সেই যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ হারানো সেবাস্তিয়ান তাই ভার্জিন হিসেবে সুপরিচিত।

১০. উইলফ্রেড দ্য হেয়ারি (লোমশ উইলফ্রেড)

লোমশ উইলফ্রেড; Source: all-that-is-interesting.com

আর্জেল আর কারডানয়ার কাউন্ট হিসেবে ৮৭০ সাল থেকে; বার্সেলোনা, জিরোনা আর বেসালুর রাজা হিসেবে ৮৭৮ সাল থেকে আর অসোনার শাসক হিসেবে ৮৮৬ সাল থেকে আধিপত্য বিস্তার করেন উইলফ্রেড। তার গায়ে লোমের প্রাচুর্য থাকার কারণে মানুষজন তাকে ব্যঙ্গ করে এমন নাম দেয়। বার্সেলোনার প্রধান গির্জার সামনে রাখা উইলফ্রেডের একটি ভাস্কর্য আছে।

১১. উগোলিনা দ্য ক্যানিবাল (নরখাদক উগোলিনা)

নরখাদক উগোলিনা; Source: all-that-is-interesting.com

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ডনোরাটিকোর কাউন্ট ছিলেন উগোলিনা ডেলা ঘেরারডেস্কা। একদিকে তিনি যেমন ইতালির মহৎপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, অপরদিকে তার নামে বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ লাগাতার আসতে থাকায় দন্তের ‘ডিভাইন কমেডি’তে পর্যন্ত চলে আসে তার কথা। রাজদ্রোহের অপরাধে সন্তানসহ তার পুরো পরিবারকে জেলে আটকে রাখা হয়। কথিত আছে, জীবন বাঁচাতে নিজের সন্তানদেরও নাকি খেয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তবে ফরেনসিকরা অবশ্য এই বক্তব্যকে সত্য বলে মানেন না। নিজের বাচ্চাদের না খেলেও, ‘টুকটাক মানুষ খাওয়ার’ অভ্যাস যে ছিল সে প্রমাণ পাওয়া গেছে জেলের ভেতরে এবং বাইরে। এ কারণেই নরখাদকের তকমা গায়ে লাগিয়ে দিব্যি ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।

১২. বাল্ডউইন দ্য লেপার (কুষ্ঠরোগী বাল্ডউইন)

কুষ্ঠরোগী বাল্ডউইন; Source: all-that-is-interesting.com

জেরুজালেমের রাজা চতুর্থ বাল্ডউইন ১১৭৪ সাল থেকে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত রাজত্ব করে গেছেন। শৈশবে বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে কখনো আঘাত পেলেও ব্যথা অনুভব না করায় চিকিৎসকরা তাকে কুষ্ঠরোগী হিসেবে ঘোষণা করে। নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যান তিনি। তবু মানুষের মানসিক আক্রোশে নামের সাথে এই বিশেষণটি নিয়েই তাকে আমরণ দিন কাটাতে হয়।

১৩. রিচার্ড কুইন ডিক (ভগ্নদশা লিঙ্গের অধিকারী রিচার্ড)

ভগ্নদশা লিঙ্গের অধিকারী রিচার্ড; Source: all-that-is-interesting.com

১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের ‘লর্ড প্রটেক্টর’ বা রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো রিচার্ড ক্রোমওয়েলকে। তার বাবা অলিভার ক্রোমওয়েলের মৃত্যুর পরে বাবার আসনে আসীন হন রিচার্ড। কিন্তু সামরিক কোনো প্রশংসাপত্র না থাকায় স্বভাবতই তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা, প্রায় সবাই নাখোশ ছিল তার উপর। একপ্রকার বাধ্য হয়েই এক বছরের মধ্যে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাকে। তার উপর যারা নাখোশ ছিলেন তাদেরই দেয়া ডাকনাম ‘রিচার্ড কুইন ডিক’ বা ‘টাম্বেলডাউন ডিক’ অর্থাৎ ভগ্ন শিশ্নের অধিকারী রিচার্ড!  এই নামের সাথে কোনো কেলেঙ্কারি জড়িয়ে নেই, বরং মিশে আছে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষোভ।

১৪. রবার্ট দ্য কাকহোল্ড (অসতীপতি রবার্ট)

অসতীপতি রবার্ট; Source: all-that-is-interesting.com

রবার্ট ডেভেরাক্স, এসেক্সের তৃতীয় আর্ল, ছিলেন ইংলিশ সাংসদ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের নামকরা সৈনিক। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি, কনের বয়স ছিল ১৪ বছর। বিয়ের পরপরই দু’বছরের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার স্ত্রী টের পান, কিশোর স্বামী রবার্ট জড়িয়ে পড়েছে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্কে। রবার্ট বেচারা বুঝতেই পারছিল না তখন কী বলে পরিস্থিতি সামলানো দরকার। কাজেই বিবাহবিচ্ছেদের শুনানিতে সে বলে বসে, শারীরিক অক্ষমতার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে এই সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল। তখন থেকেই কাকহোল্ড বা অসতী হিসেবে পরিচিতি পায় রবার্ট। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, পরবর্তী জীবনে সাবেক স্ত্রী এবং তার নতুন স্বামীর উপর প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়ে যায় সে। তাদের বিরুদ্ধে একটি খুনের অভিযোগ আনা হলে সেখানে বিচারক পদে অধিষ্ঠিত হন স্বয়ং রবার্ট এবং দুজনকেই ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিয়ে পুরনো ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেন।

১৫. আলবার্ট দ্য পিক্যুলিয়ার (আজব আলবার্ট)

আজব আলবার্ট; Source: all-that-is-interesting.com

অস্ট্রিয়ার ডিউক চতুর্থ আলবার্ট ১৩৯৫ সাল থেকে ১৪০৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার নামের সাথে ‘আজব’ কথাটি কীভাবে জুড়ে গেল তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও, ইতিহাস বলে পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রায়ই ঝগড়া করে বেড়াতেন তিনি। কুলাঙ্গার হিসেবে বন্ধুমহলেও পরিচিতি লাভ করা আলবার্টকে দেখে এবং তার জীবনী পড়ে অবশ্য নামটি যথার্থ বলেই মনে হতে পারে।

ফিচার ইমেজ: all-that-is-interesting.com

Related Articles

Exit mobile version