দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংগঠিত সব থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা বললে সবার আগেই আসবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধের মারা গিয়েছিল প্রায় ৩৭ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ভিয়েতনামি নাগরিক।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে খুব কম সাহিত্য বা সিনেমাই হয়তো আমাদের নজরে এসেছে। যার অন্যতম কারণ এই যুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন বাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং পরাজয়।
অত্যন্ত বিতর্কিত এই যুদ্ধের পটভূমি আজকে আলোচনা না করে আজকে আমরা এই যুদ্ধের সময় সংগঠিত মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বম্বিং ক্যাম্পেইন ‘অপারেশন রোলিং থাণ্ডার’ নিয়ে আলোচনা করব, যা এই যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের অন্যতম প্রধান কারণ।
১৯৫৫ সালে কম্যুনিস্ট উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র কম্যুনিস্ট বিরোধী মনোভাবের জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সহায়তা দেওয়া শুরু করে। কম্যুনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামও দক্ষিণে তাদের গেরিলা বাহিনী (ভিয়েতকং) ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (National front for the liberation of South Vietnam; NLF) গঠন করে, এবং তাদের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখে। যদিও দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি ছিল কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করে ১৯৬৪ সালে।
এর কারণ হিসাবে তারা গালফ অভ তনকিনে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ইউ.এস.এস ম্যাডক্সের ওপর উত্তর ভিয়েতনামের পেট্রোল-বোট হামলাকে দায়ী করে। অনেক বিশেষজ্ঞই এই ঘটনাকে সাজানো নাটক হিসাবে আখ্যায়িত করলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি. জনসন এই হামলাকে আগ্রাসন হিসাবে আখ্যায়িত করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৬৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, যখন তিনি এবং তার নিরাপত্তা মন্ত্রী রবার্ট এস. ম্যাকনামারার অপারেশন রোলিং থান্ডার পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন এর উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাজনৈতিক। প্রেসিডেন্ট জনসন মার্কিন সামরিক সক্ষমতার নমুনা প্রদর্শনের মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনামের নেতৃত্বকে যুদ্ধে বিরতি টানতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উত্তর ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট নেতারা যে মার্কিন এই এরিয়াল বম্বিং ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে পুরোপুরি অসহায় এবং দেশ পরিচালনায় অক্ষম- তা প্রমাণ করাও ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
মার্কিন বিমান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কার্টিস লিমেয় অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রেসিডেন্টকে কথা দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী বিমান বাহিনী মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কম্যুনিস্টদের প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা ভিয়েতনামের জনগণের সাথে যে অপরাধ করেছিলেন, তার বোঝা এখনো ভিয়েতনামের জনগণ বয়ে বেড়াচ্ছে।
১৯৬৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন পেলেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দক্ষিণ ভিয়েতনামকে নিয়ে প্রথম হামলা চালায় মার্চের ২ তারিখ। উভয় বাহিনীর প্রায় ১০০ বিমান ইয়ন বাং-এর একটি অস্ত্রাগারে হামলা চালায়। শুরুতে অপারেশন রোলিং থান্ডার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরিচালনার কথা থাকলেও মার্কিন বিমানবাহিনী এবং ইউ.এস মেরিন (প্যাসিফিক কমান্ড) এই বিমান হামলা প্রায় তিন বছর অব্যাহত রাখে।
ধারণা করা হয়, এই তিন বছরে মার্কিন বিমানবাহিনী এবং ইউ.এস মেরিন ভিয়েতনামে প্রায় ৪০ লক্ষ থেকে ৮০ লক্ষ টন বোমা ফেলেছিল, যা ছিল সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিস্ফোরকের চেয়েও বেশি। প্রেসিডেন্ট লিনডন বি. জনসন আশা করেছিলেন, এই অপারেশনের চাপে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনী এন.এল.এফকে সহায়তা করা বন্ধ করবে। তিনি মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নো দিন দিয়েনের পরামর্শে উত্তর ভিয়েতনামেরও বিমান হামলা জোরদার করেন। তারা মূলত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম্যুনিস্ট ভিয়েতনামের প্রশাসনিক এবং সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করে তাদের বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, অপারেশন রোলিং থান্ডারের আগেও মার্কিন বাহিনী ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু বম্বিং ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছিল। যার উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট জন ফ্রাঙ্কলিন কেনেডি অনুমোদিত অপারেশন র্যাঞ্ছ হ্যান্ড। যুদ্ধে সফলতা পাওয়ার জন্য এবং এন.এল.এফ গেরিলাদের গোপন আস্তানা ধ্বংস করার জন্য এজেন্ট অরেঞ্জ এবং এজেন্ট ব্লু নামক কুখ্যাত রাসায়নিক প্রয়োগ করে প্রায় দশ লক্ষ হেক্টর বনভূমি এবং প্রায় ছয়শো আশি লক্ষ একর কৃষি জমি বিনষ্ট করে। এই হামলার মাধ্যমে তারা এন.এল.এফকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করলেও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর সব থেকে বড় ভুক্তভোগী ছিল ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণ।
এখনো ভিয়েতনামে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি, যার জন্য বিশেষজ্ঞরা এইসব ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থকেই দায়ী করেন। এসময় মার্কিনীরা নাপাম নামক অত্যন্ত দাহ্য আগ্নেয় রাসায়নিক ব্যবহার করে, যা তখনকার সময়ে অনেক সমালোচনার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ এবং হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম কালো অধ্যায়ের সূচনা করে।
পূর্বে স্বল্প পরিসরে হামলা চালানো হলেও ১৯৬৫ সালের অপারেশন রোলিং থান্ডারের মাধ্যমেই বোমা হামলার তীব্রতা বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।
যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে সেনা, রসদ, অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য এন.এল.এফ পরিচালিত হাজার হাজার সুরঙ্গ ছিল। উত্তর ভিয়েতনামে হামলার পাশাপাশি গহীন জঙ্গলে এন.এল.এফের আস্তানাগুলো ছিল অপারেশন রোলিং থান্ডারের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। মার্কিন বাহিনীর ধারণা ছিল, তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কাছে উত্তর ভিয়েতনাম এবং ভিয়েতকং গেরিলারা ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তেও সক্ষম হবে না।
তারা আশা করছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সমগ্র ভিয়েতনামের আকাশ দখল করে ধরে রাখতে পারলেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করা যাবে। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনাম প্রযুক্তিগতভাবে মার্কিন বিমান বাহিনীর থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ততদিনে কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনও উত্তর ভিয়েতনামকে সামরিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি সেনা প্রেরণ না করলেও মার্কিন বিমান বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রযুক্তি এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা অব্যাহত রাখে। ধারণা করা হয়, যুদ্ধের সময় ভিয়েতকং বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করার জন্য কয়েক হাজার সোভিয়েত সামরিক বিশেষজ্ঞ ভিয়েতনামে উপস্থিত ছিলেন। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।
অপারেশন রোলিং থান্ডারে মার্কিন বিমান বাহিনী এবং মার্কিন মেরিন আলাদা আলাদা অংশ গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় করার দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট জনসন প্রশাসনের। দুর্বল নজরদারি অনেক সময়ই এই দুই বাহিনীর পরিচালিত মিশনগুলোতে জটিলতা সৃষ্টি করত। পরে এই জটিলতা দূর করতে সমগ্র ভিয়েতনামকে আলাদা আলাদা অপারেশন জোনে ভাগ করে নেওয়া হয়।
১৯৬৫ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে অপারেশন রোলিং থান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্কিন বিমান বাহিনীর সেকেন্ড ডিভিশন এবং মার্কিন মেরিনের প্যাসিফিক কমান্ডের টাস্ক ফোর্স-৭৭ এর ওপর। যদিও ১৯৬৬ সালে সেকেন্ড ডিভিশনের জায়গায় মার্কিন বিমান বাহিনীর সপ্তম বিমানবহরকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুরুতে বিমান হামলার জন্য মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রথম পছন্দ ছিল এফ-১০৫ থান্ডারচিফ। ধারণা করা হয়, অপারেশন রোলিং থান্ডারের শতকরা ৭৫ ভাগ বম্বিং এই বিমানটির সাহায্যে করা হয়েছিল। বিমানটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য রাখতে পারলেও ১৯৬৮ সালে এই অপারেশনের শেষে মার্কিন বিমান বাহিনীর অর্ধেক এফ-১০৫ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
এফ-১০৫ থান্ডারচিফ বিধ্বস্ত হওয়ার হার অনেক বেশি হওয়ায় মার্কিন বিমান বাহিনী এফ-৪ ফ্যানটম যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা শুরু করে এবং এর সক্ষমতার প্রমাণ দেয়। অপারেশনের শেষের দিকে সকল এফ-১০৫ থান্ডারচিফ যুদ্ধ বিমানকে এই বিমান দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। এফ-৪ ফ্যানটম যুদ্ধ বিমানের সব থেকে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল ভিয়েতনামের ঝড়-বৃষ্টি প্রবণ আবহাওয়ার জন্য এটি সুবিধাজনক ছিল না।
বি-৫২ ছিল অপারেশন রোলিং থান্ডারের ব্যবহার হওয়া মার্কিন বাহিনীর সবথেকে ভারি বোমারু বিমান। যুদ্ধের সময় ভারি বৃষ্টিপাতের সময় যখন এফ-৪ ফ্যানটম বিমানের ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা দেখা যেত, তখন এই বি-৫২ বিমানই ছিল তাদের প্রধান বিকল্প। উল্লেখ্য যে, ১৯৫০ সালে বাহিনীতে প্রথম সংযোজনার পর থেকে এই বোমারু বিমানটি এখনো মার্কিন বিমান বাহিনীর অন্যতম ভরসার প্রতীক। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৫৮টি বি-৫২ বিমান সক্রিয় দায়িত্ব পালন করছে এবং আরও প্রায় ১৮ থেকে ৩০টি বিমান রিজার্ভে রাখা হয়েছে।
মার্কিন মেরিন কোরের ব্যবহৃত বিমানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ডগলাস এ-১ স্কাই রেইডার, ডগলাস এ-৪ স্কাইহক (অপারেশানের পর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত) এবং গ্রামেন এ-৬ ইনট্রুডার।
অপারেশানের শুরুতে প্রযুক্তিগতভাবে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা মার্কিন বাহিনীর সাথে উত্তর ভিয়েতনামিরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে না ভাবা হলেও তা পুরোপুরি সত্যি ছিল না। যুদ্ধের পুরো সময় সোভিয়েত এবং চীনারা কম্যুনিস্ট ভিয়েতনামিদের অস্ত্র এবং প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করে যায়, যা দিয়ে তারা মার্কিনীদের যথেষ্ট পরীক্ষায় ফেলতে সক্ষম হয়। শুরুতে ভিয়েতনাম বিমান বাহিনীর প্রধান ভরসার প্রতীক ছিল সোভিয়েত মিগ-১৭ বিমান, যা পরবর্তী সময়ে মিগ-২১ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
এছাড়াও মার্কিন বিমান হামলার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র এএ গান (aa; anti-aircraft) এবং সোভিয়েত স্যাম সিস্টেম (SAM; surface to air missile)। স্যাম মিসাইলের ভেতর উল্লেখযোগ্য হিসাবে বলা যায় এসএ-২ গাইডলাইন (SA-2 Guideline; NATO name) বা এস-৭৫ দিভিনা, যা মার্কিন গুপ্তচর বিমান এউ-২ ধ্বংসের জন্য বিখ্যাত।
স্যাম সিস্টেম অধিক উচ্চতায় উড্ডয়নরত বিমানের জন্য অধিক কার্যকর বিধায় মার্কিন বিমান তুলনামূলক কম উচ্চতায় অপারেশন পরিচালনা করত, যার ফলে তারা উত্তর ভিয়েতনামের বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের সহজ শিকারে পরিণত হয়। তাই প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও অধিকাংশ মার্কিনী ক্ষয়-ক্ষতির জন্য এই বিমান প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সেখানে উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি না থাকলে ধারণা করা হয়, সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সোভিয়েত সামরিক বিশেষজ্ঞ মোতায়েন করা ছিল। মার্কিন বিমান বিধ্বংসী স্যাম সাইটগুলো সোভিয়েত জনবল দ্বারা পরিচালিত হতো- এমন তথ্য প্রেসিডেন্ট জনসন প্রশাসনের কাছে ছিল বিধায় তিনি এই স্যাম সাইটগুলোতে বিমান হামলা চালানোর বিপক্ষে ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে, সোভিয়েত নাগরিকদের মৃত্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়নও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই আক্রান্ত হওয়া ছাড়া অথবা খুব জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া তিনি এই বিমান প্রতিরোধ ব্যবস্থা উপর পাল্টা হামলা নিষিদ্ধ করেন।
তাছাড়াও উত্তর ভিয়েতনামের চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চল, হানয় এবং হাইপং শহরকেও বোমা হামলা থেকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন বিধি-নিষেধ, নিশানা নির্ধারণে জটিলতা, আবহাওয়া এবং নিজেদের অনেক ক্ষয়ক্ষতির জন্য অপারেশন রোলিং থান্ডার শুরু থেকেই প্রত্যাশিত লক্ষ্যের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। কম্যুনিস্ট গেরিলা ভিয়েতকং বাহিনী মার্কিনীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলেও বাস্তবে বছরের পর বছর এই নির্মম বিমান হামলার প্রকৃত ভুক্তভোগী ছিল ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে এই এরিয়াল রেইডকেই দায়ী করা হয়।
পরিশেষে এই অপারেশানের সার্থকতা অত্যন্ত বিতর্কিত। অনেকের চোখে অপারেশন রোলিং থান্ডারের আংশিক সাফল্য থাকলেও তা যথেষ্টই প্রশ্নবিদ্ধ। ১৬৯৫ সাল থেকে অপারেশনের শেষ পর্যন্ত মার্কিন বিমান হামলায় প্রতিপক্ষের প্রায় আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এই সুদীর্ঘ তিন বছরের এরিয়াল রাইডে মার্কিন বিমানবাহিনী এবং মার্কিন মেরিন কোরের প্রায় ৭০০ থেকে ৯০০ বিমান বিধ্বস্ত হয়।
শুরু থেকেই দৃশ্যমান কোনো সাফল্য না থাকায় এবং দিন দিন খরচ এবং ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসেই অপারেশন রোলিং থান্ডার সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় এবং দু’মাস পর এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তবে অপারেশন রোলিং থান্ডারের সমাপ্তির মাধ্যমে ভিয়েতনামের মানুষের দুর্ভাগ্যের সমাপ্তি হয়েছিল ভাবলে ভুল হবে। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ক্ষমতায় আসলে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সম্মানজনক বিদায় নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু, ১৯৭২ সালে তিনি নিজেই অপারেশন লাইনব্যাকার নামক নতুন এরিয়াল ক্যাম্পেইন অনুমোদন করেন।
১৯৭৩ সালের ভিয়েতনামে যুদ্ধে মার্কিন ইতিবাচক ফলাফল অসম্ভব বুঝতে পেরে তিনি চুক্তি সম্পন্ন করেন এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে সকল মার্কিন কার্যক্রম এবং সৈন্য প্রত্যাহার করেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ভিয়েতনাম ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন দখল করে নিতে সক্ষম হয়, যার মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটে।