> আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?
>> Yes.
> আপকো লে যায়েগা।
>> Why?
আফসোস, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা কোনোদিন সেই ‘Why’ এর জবাব জানতে পারেননি। কারণ, রাতটা ছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর, আমরা বাংলাদেশিরা যাকে ‘পঁচিশ মার্চের কালরাত’ হিসেবেই চিনি।
…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলায় সপরিবারে থাকতেন অধ্যাপক গুহঠাকুরতা। ভয়াবহ সেই রাতে আনুমানিক ন’টার দিকে সবাই রেডিও খুলে বুঝতে চাইছিল দেশের পরিস্থিতি। তেমন কিছুই জানতে না পেরে অধ্যাপক সাহেব পরীক্ষার খাতা দেখতে বসে যান।
হঠাৎ ধুপধাপ শব্দ শুনে অধ্যাপক গুহঠাকুরতা ও তার স্ত্রী বাসন্তী রানী গুহঠাকুরতা বাইরে গিয়ে দেখেন, মানুষজন গাছ, পানির ট্যাঙ্ক আর ইটপাটকেল দিয়ে যেভাবে পারছে সেভাবেই প্রতিরোধ সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে অধ্যাপক গুহঠাকুরতা ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ আটকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আবারও খাতা দেখতে বসে যান।
ইতোমধ্যে চারদিকে শুরু হয়ে গেছে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। রাত আনুমানিক দুটোর দিকে এক পাঞ্জাবী মেজর অধ্যাপক গুহঠাকুরতার ফ্ল্যাটের গেটের লোহার শিকল হাত দিয়ে ছিঁড়ে ভেতরে প্রবেশ ঢোকে। এরপর রান্নাঘরের দরজা ভেঙে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেই পাঞ্জাবী মেজরের সাথে এরপর মিসেস গুহ ঠাকুরতার আলাপচারিতা ছিল এরকম:
> প্রফেসর সাহাব হ্যায়?
>> হা।
> উনকো লে যায়েগা।
>> কাহা লে যায়েগা?
> লে যায়েগা।
>> হোয়াই?
> ফ্লাটমে অওর কোয়ি জোয়ান আদমি হ্যায়?
>> নাহি, হামারা একহী লাড়কি হ্যায়।
> ঠিক হ্যায়। লাড়কি কা ডার নাহি হ্যায়।
এরপরই শোবার ঘরে গিয়ে অধ্যাপক গুহঠাকুরতার সন্ধান পায় সেই সেনা। চলে এই লেখার একেবারেই উপরে উল্লেখিত আলাপচারিতা।
…
নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ এন এম মুনীরউজ্জামান, তার ছেলে, ভাগ্নে এবং এক প্রতিবেশী যুবককেও। খানিক পর থেমে থেমে আটটি গুলির শব্দ ভেসে আসে।
গুলি লেগেছিল অধ্যাপক গুহঠাকুরতার ঘাড়ের ডানদিকে। শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল তার। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী উপর থেকে পানি এনে গুলিবিদ্ধ সবাইকে একে একে পান করালেন। এরপর বাসন্তী রানীর কাছে দৌড়ে এসে জানালেন, “দিদি, আপনার সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন, আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি বাঁচবেন।”
এই কথা শুনে মা-মেয়ে দৌড়ে নিচে ছুটে যায়। অধ্যাপক গুহঠাকুরতা তখন বলেছিলেন, “আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে। তারপর ধর্ম। আমি হিন্দু বলতেই গুলি করার অর্ডার দিয়েছে। গুলি আমার ঘাড় ও কোমরে লেগেছে। আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না। শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে…।”
পাকসেনারা চলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আতঙ্কে কেউই সেদিন তাদের আর্তচিৎকারে এগিয়ে আসার সাহস করেনি। বাইরে কার্ফু থাকায় অধ্যাপক গুহঠাকুরতাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেয়া যাচ্ছিলো না। এভাবেই চলে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত। ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরে চলেছিল অধ্যাপক সাহেবের। সেদিন সকালে কয়েকজন লোকের মাধ্যমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
দুর্ভাগ্য সেখানেও যেন পিছু ছাড়েনি তাদের। কারণ, হাসপাতালে কোনো ডাক্তারই ছিলেন না। দায়িত্বরত নার্সরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তাকে বাঁচানোর। কিন্তু ৩০ মার্চ বিনা চিকিৎসাতেই মানুষটি পরলোকগমন করেন। এরপর যে পরিবারের মানুষেরা মৃতদেহ সৎকার করবে সেই সুযোগও ছিলো না। কারণ, অধ্যাপক গুহঠাকুরতার মৃত্যুর পরপরই পাকিস্তানি সেনারা হাসপাতাল ঘিরে ফেলে। ফলে লাশ রেখেই চলে আসতে হয় তাদের। চারদিন পর পর্যন্ত লাশটি হাসপাতালেই ছিলো। এপ্রিলের ৩ তারিখেও তাদের ড্রাইভার ওয়ার্ডের বারান্দায় অধ্যাপক সাহেবের নিথর দেহকে পড়ে থাকতে দেখেছে।
এরপর? এরপর অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহের কী হলো তা আর কেউই বলতে পারবে না…
…
১৯২০ সালে ময়মনসিংহে জন্ম নেয়া অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পড়াশোনা করেছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। মেট্রিক ও আইএ উভয় পরীক্ষাতেই ১ম বিভাগ, বিএ (ইংরেজি) অনার্সে ১ম শ্রেণী এবং এমএ-তে ২য় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া সেই স্বাক্ষ্যই দেয়।
নিজের বিপদের কথা জানতেন তিনি নিজেও। তারপরও ছাত্রদের ফেলে যাবার চিন্তা তিনি করেননি। একজন প্রকৃত অভিভাবকের মতোই তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, “সবাই আমাকে সাত দিন দূরে থাকতে বলছে। আমি হলের প্রভোস্ট। আমি কী করে ছাত্রদের ফেলে যাব? ওদের জন্যই তো এ কোয়ার্টার আমাকে দিয়েছে, ফোন দিয়েছে। আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।”
লেখাটির ইতি টানছি ৩০ মার্চের নিজের বাবার মৃত্যু নিয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতার স্মৃতিচারণ দিয়েই। পান্না কায়সার সম্পাদিত ‘হৃদয়ে একাত্তর’ বইয়ে ‘স্বাধীনতার ক্ষতচিহ্ন’ শিরোনামের সেই লেখায় তিনি বলেন, “… বাবা আর নেই। আমার কান্না সেদিন আর কেউই থামাতে পারেনি। মা, আমার শিক্ষক, ডাক্তার, বন্ধু বান্ধব। শুধু পেরেছিল একজন নার্স- সম্পূর্ণ অচেনা, অপরিচিত নার্স। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে কেবল বলেছিল- ‘তুমি কেঁদে কী করবে? সারাদেশে তোমার বাবার মতো কত মানুষকে মেরেছে ওরা। সারা দেশটাই তো আজকে কাঁদছে।”
একাত্তরের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো-
১) একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাহিনী
২) মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী