ইউক্রেন রাশিয়ার পর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর এবং পশ্চিমে রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের সীমান্ত আছে বেলারুশ (উত্তর), পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাংগেরি (পূর্ব) এবং রোমানিয়া ও মলদোভার (দক্ষিণ-পূর্ব) সাথে। ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নিপার নদী (Dniper)। এই নদী ছাড়াও বাগ নদী (Buh) এবং নিস্টার নদীকে (Dnister) কেন্দ্র করেই ইউক্রেনে ঘটে মানবজাতির বসবাসের শুরু থেকে সভ্যতার সৃষ্টি। সেই ইউক্রেনের ইতিহাস নিয়েই এই সিরিজটি, যার প্রথম পর্বে থাকছে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস শুরুর ঘটনা থেকে খ্রিস্টাব্দ ২য় শতক পর্যন্ত।
বলা হয়ে থাকে, প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগে কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে ইউক্রেনে আসে ককেশীয় এবং বলকানরা। ইউক্রেনের মাটিতে মানবজাতির পথচলা তাদের মাধ্যমেই শুরু। সেই লম্বা ইতিহাস ফেলে রেখে শুরু করা যাক ইউক্রেনের মাটিতে প্রথম কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সময় থেকে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৪০০০ অব্দের মধ্যে বাগ এবং নিস্টার নদীকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনে কৃষি কাজ শুরু হয়। কৃষিকাজের শুরুর মাধ্যমেই মূলত ইউক্রেনে সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার শুরু হয়। মানুষ যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ানো বাদ দিয়ে নিজেদের জমির কাছাকাছি থাকতে শুরু করে, গড়ে উঠতে শুরু করে গ্রাম। কৃষিকাজের জন্য বাড়তি লোকবল প্রয়োজন, তাই জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে এ সময় থেকেই। সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংঘও হতে থাকে ইউক্রেনের মাটিতে কৃষিকাজকে কেন্দ্র করেই। ইউক্রেনে প্রথম কোনো মেকানিক্যাল যন্ত্র আসে ট্রিপিলিয়ানদের হাত ধরে। গাছ, কাঠ এবং পাথরে ড্রিল করার যন্ত্র ইউক্রেনের প্রথম যান্ত্রিক কোনো কিছু। ট্রিপিলিয়ানদের সংখ্যা তখন থেকে বাড়তে থাকে এবং সেখান থেকে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে তারা।
সাহিত্যে ইউক্রেনের সবথেকে পুরনো উল্লেখ কোথায় আছে? এই প্রশ্নের জবাবে চলে আসে গ্রিক কবি হোমারের লেখা কবিতা ‘ওডিসি (Odyssey)’-এর কথা যেখানে কবি হোমার ‘The land of the Cimmerians’ বলতে বুঝিয়েছিলেন এই ইউক্রেনকে। ইউক্রেনে সিমেরিয়ানদের বসবাস কবে থেকে শুরু হয় তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। অনেকেই বলে থাকেন খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে সিমেরিয়ানরা প্রথমবারের মতো ইউক্রেনে আসে। আবার অনেকেই এই তত্ত্ব অস্বীকার করে বলে থাকেন সিমেরিয়ানরা জন্মগতভাবেই ইউক্রেনের অধিবাসী। তবে যেমনটাই হোক না কেন, ইউক্রেনে ঘোড়ার পিঠে চড়ার শুরুটা এই সিমেরিয়ানদের হাত ধরেই, এবং তা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে। মানুষ ঘোড়ার পিঠে চড়তে শুরু করেছিল অবশ্য তার থেকেও প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দের দিকে)। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দের দিকে সিমেরিয়ানরা রাশিয়ার ডন নদীর তীরে বসতি গড়েছিল, এবং এরপর নতুন আসা যাযাবরদের কারণে সেখানটাও ছেড়ে এশিয়া মাইনরের দিকে চলে যায়। ইউক্রেনের ইতিহাসে এরপরের গল্প সিথিয়ানদের (Scythians)।
ইউক্রেনের ইতিহাসে সিথিয়ানদের আগে তাদের মতো কোনো সংঘবদ্ধ উপজাতি আসেনি। সিথিরানরা ছিল যাযাবর যোদ্ধা, যাদের আদিভূমি বলা হয় বর্তমান সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলকে। সিথিয়ানরা ইন্দো-ইউরোপীয়। এমনও বলা হয় যে, সিথিয়ানরাই ইউক্রেনের ইতিহাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি (tribe) স্লাভসদের (Slavs) পূর্বপুরুষ। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দ থেকে তারা প্রভাব বজায় রেখে চলে একদিকে চীন থেকে অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ (ইউক্রেন) পর্যন্ত। সিথিয়ানরা ছিল ভয়াবহ যোদ্ধা। প্রতিপক্ষের প্রথম যাকে মারতে পারত, তার রক্ত পান করা ছিল তাদের রীতি। শত্রুর হাড় দিয়ে পানীয় পান করার পাত্র বানাত তারা। তাদের উল্লেখ আছে বাইবেলেও। সেখানে বলা হয়েছে:
“Behold! A people comes from the north. They carry bows and short spears. They are most cruel and merciless…” – Jeremiah 50:41-42
গ্রিক ইতিহাসবিদ হিরোডোটাস খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে তার Histories (Book 4)-এ সিথিয়ানদের সমন্ধে লেখেন, “None who attacks them can escape, and none can catch them if they desire not to be found.”
এই সিথিয়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে ইউক্রেনে আসে। ধীরে ধীরে সেখানে বিস্তার লাভ করতে থাকে তারা। নিজেদের মধ্যেও তাদের ভাগ ছিল। নিপার নদীর তীরে বসবাস করতো কৃষিকাজ করে এমন সিথিয়ানরা। সিথিয়ানদের মধ্যে এক শ্রেণীর নাম ছিল ‘Royal Scythians’ যারা নিজেদের ভাবত বাকি সবার থেকে সেরা। রাজনৈতিক ক্ষমতাও ধীরে ধীরে শুধু এই শ্রেণীর সিথিয়ানদের হাতেই পুঞ্জীভূত হয়ে যায়। সিথিয়ানরা যেহেতু যোদ্ধা ছিল, তাই ইউক্রেনে আসা এই সিথিয়ানদের ছিল প্রতিষ্ঠিত আর্মি। তবে তারা নিজেরা নিজেরা ছিল একে অন্যের চরম আস্থাভাজন। সিথিয়ানরা ইউক্রেন থেকে ব্যবসা শুরু করে গ্রিকদের সাথে। মোম, মধু আর দাস-দাসীর বিনিময়ে তারা গ্রিকদের থেকে গ্রহণ করত মদ, দামী অলংকারসহ আরও অনেক সামগ্রীই।
সিথিয়ানদের এই বিশাল আর্মি বাহিনীকে পরাস্ত করে ইরানের সে সময়ের রাজা দারিয়ুস দ্য গ্রেট (Darius the Great)। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৩ অব্দে ইউক্রেনের সিথিয়ানদের হারিয়ে নিজে দখল করে নেয় সেই অঞ্চল। তবে বেশিদিন ইউক্রেনে নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। হারতে হয়েছে আবার তাদের কাছেই। সিথিয়ানদের রাজত্ব বাড়তে থাকার একপর্যায়ে সিথিয়ানরা মুখোমুখি হয় মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের (Philip of Macedonia)। এই ফিলিপ হলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের (Alexandar the Great) বাবা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ অব্দে ম্যাসিডোনিয়ার কাছে ক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়েই শুরু হয় সিথিয়ানদের শেষের শুরু।
এর প্রায় এক হাজার বছর পর সিথিয়ান সংস্কৃতিরই একটি অংশ সারমাশিয়ানরা (Sarmatians) ইউক্রেনে আসে। সিথিয়ানদের মতো সারমাশিয়ানরাও ঘোড়া চালানো এবং যুদ্ধ-বিগ্রহে ছিল দক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে সারমাশিয়ানরা রাশিয়ার ডন নদী (Don) এবং আরাল পর্বতমালার (Urals) মধ্যবর্তী জায়গা দখল করে নেয়। ধীরে ধীরে তারা ডন নদী পার করে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল দখল করতে শুরু করে। এ সময় তারা সিথিয়ানদেরও জয় করে নেয়, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে তারা পুরোপুরি ইউক্রেনের দখল নিয়ে নেয়, মূলত কৃষ্ণ সাগরের উত্তর এবং পূর্ব দিকের দখল নিয়ে নেয় সারমাশিয়ানরা। প্রায় ৪০০ বছর পর খ্রিস্টাব্দ ২য় শতকে পূর্বদিক থেকে হান (Huns), উত্তর দিক থেকে জার্মানীয় গথ (Goth) এবং পশ্চিম দিক থেকে রোমানদের (Roman) আক্রমণে ইউক্রেনের দখল হারায় সারমাশিয়ানরা। এরই মাঝে ইউক্রেনে গ্রিক কলোনিরও আছে বহু উত্থান পতনের গল্প।