অস্কার শিন্ডলার: নির্মম নাৎসিদের বিরুদ্ধে এক মহত্তম প্রাণ

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের বেশে জন্ম নিয়ে পিশাচের মত জীবন কাটিয়েছে এমন লোকের তালিকা করলে নিশ্চিতভাবে সর্বপ্রথমে আসবে এডলফ হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর হাইনরিখ হিমলারের মত ভয়ঙ্কর খুনে অফিসারদের নাম। হলোকাস্ট বলে পরিচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধন করে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণহত্যা ঘটিয়েছিল এই পিশাচেরা। জার্মানদের তথাকথিত বিশুদ্ধ রক্তের এক বায়বীয় মর্যাদার অহংকারের কারণে সৃষ্ট ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা থেকে উৎসরিত এই গণহত্যার শিকার হয়েছিল ষাট লক্ষ ইহুদি যাদের মধ্যে পনের লক্ষ ছিল শিশু। আরও পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদি নয় এমন মানুষ মিলিয়ে মোট এক কোটি দশ লক্ষ মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল হিটলার বাহিনী। এই ফ্যাশিস্ত বাহিনীকে নিয়ে নয়, বরং নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এই খুনেদের রক্তপিপাসা থেকে এক হাজার দুইশ জন মানুষকে বুক আগলে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন যে বিশালহৃদয় মানুষটি, তাকে নিয়েই আজকের লেখা। তার নাম অস্কার শিন্ডলার।

schindler_oskar

অস্কার শিন্ডলার ;Image Sources: Wikimedia Commons

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘেটো ও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে রাখা হত ইহুদিদের। সেখান থেকে এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে পৈশাচিক সব কায়দায় খুন করা হত তাদের। হিটলারের নাৎসি পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন গেস্টাপো, শুটজস্টাফে বা এসএস ইত্যাদি সামরিক বাহিনীর অফিসারেরা এসব ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে চালিয়েছিল এই হত্যাযজ্ঞ। গ্যাস চেম্বারের হত্যার কথা জানেন নিশ্চয়ই? ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে। গোসল করানোর নাম করে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়া হত সব বয়সী মানুষকে। সেখানে তাদেরকে বলা হত নগ্ন হতে। কেউ ভয় পেলে তাদের বুঝিয়ে ভয় কাটানোর জন্য আবার কিছু মানুষ থাকত যারা তাদের অভয় দিত। সবাই নগ্ন হয়ে গোসলের প্রস্তুতি নেবার পর কক্ষের দরজা আটকে বাইরে থেকে সেখানে ছেড়ে দেয়া হত বিষাক্ত গ্যাস, মৃত্যু হত সবার। এরপর লাশগুলো নিয়ে পোড়ানো হত, কোথাও অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে, কোথাও ক্রিমেটোরিয়া নামে পরিচিত বার্নারের মধ্যে ঢুকিয়ে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা লাশ পোড়ানো হত কোনো কোনো ক্যাম্পে।

auschwitz-fences-p

অশভিৎজ এর ক্যাম্প, চারটি গ্যাস চেম্বারে হত্যার পর এই চিমনীগুলো দিয়ে উঠত প্রতিদিন গড়ে ৬০০০মানুষ পোড়ানোর ধোঁয়া।

এমন ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়েই ইহুদিদের বাঁচানোর দুঃসাহসী চেষ্টা করেছিলেন অস্কার শিন্ডলার। এবং অবাক করা ব্যাপার তিনি নিজেই ছিলেন নাজি পার্টির সদস্য! তার জন্ম হয়েছিল ১৯০৮ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি বর্তমান চেক রিপাবলিকের মোরাভিয়াতে। বাবা ছিলেন কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ী। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা নেয়া হয় নি তার। ব্যবসা বাণিজ্য, গাড়ি চালানো আর যন্ত্রকৌশল বিষয়ে কিছু কোর্স করার পর তিনি বাবার ব্যবসায় কাজ করেন তিন বছর। ১৯২৮ সালে বিয়ে করেন এমিলি পেলজকে। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার চাকরি বদল করেন শিন্ডলার। মাঝখানে চেক সেনাবাহিনীতে দেড় বছর চাকরি করে আবার ফিরে আসেন আগের মোরাভিয়ান ইলেক্ট্রোটেকনিক নামক প্রতিষ্ঠানে যেটি কিছুদিনের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যায়। এদিকে তার বাবার ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এক বছর বেকার থাকবার পর চাকরি নিয়ে প্রাগ শহরের জারস্লাভ সিমেক ব্যাংকে কাজ করেন ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত।

শিন্ডলার সাদেটেন জার্মান পার্টিতে যোগ দেন ১৯৩৫ সালে। হিটলারের শাসনাধীন তৎকালীন নাৎসি জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা ‘আপভেয়া’ এর স্পাই হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।  গোয়েন্দা হিসেবে তার কাজ ছিল রেলওয়ে, সামরিক দপ্তর, সামরিক অভিযান ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য যোগাড়ের পাশাপাশি কাজের জন্য আরও গোয়েন্দা সংগ্রহ করা। ১৯৩৮ সালে চেক পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও পরবর্তীতে মিউনিখ চুক্তির কারণে চেক রিপাবলিকের কিছু অংশ জার্মান নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় চুক্তির শর্ত মোতাবেক তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৩৯ সালে নাৎসি পার্টির সদস্য হন শিন্ডলার।

১৯৩৯ সালে শিন্ডলারকে তার আপভেয়া ইউনিট এর সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়। হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল, এবং এই আক্রমণের আগে পরিকল্পনা করার সময় শিন্ডলারের কাজ ছিল তার ইউনিটের ২৫ জন এজেন্টকে সাথে নিয়ে পোল্যান্ড থেকে পোলিশ সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের তথ্য যোগাড় করা। বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে এটা যদি জানতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এমন কাজে কখনোই যুক্ত হতেন না শিন্ডলার। আবার এও ঠিক, তার এই গোয়েন্দা জীবনের পরিচিতিই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন পরবর্তীতে নাৎসি অফিসারদের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচানোর সময়। যাই হোক, ১৯৪০ সাল পর্যন্ত শিন্ডলার কাজ করেন আপভেয়া’র হয়ে।

os

অস্কার শিন্ডলার

আপভেয়া এর কাজে ১৯৩৯ সালের নভেম্বরে শিন্ডলার পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে একটি বাসা ভাড়া করেছিলেন। সেখানেই শিন্ডলারের পরিচয় হয় ইটজাক স্টার্ন নামের একজন অ্যাকাউন্টেন্ট এর সাথে যিনি কাজ করতেন শিন্ডলারের একজন এজেন্ট জোসেফের অধীনে।

পোল্যান্ড আক্রমণের পরপরই জার্মানরা পোলিশ ইহুদিদের বাড়ি থেকে শুরু করে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছিল। তেমনই এক প্রতিষ্ঠানে এর আগে কাজ করতেন স্টার্ন। একদিন শিন্ডলার তাকে ক্র্যাকোর একটি তৈজসপত্র বানানোর কারখানার ব্যালেন্স শিট দেখান যে কারখানাটির মালিকানায় থাকা ইহুদি ব্যবসায়ীদের একটি সংস্থা সে বছরেই দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছিল। শিন্ডলার ওই কারখানাটি দখলে নিতে চাইছিলেন। স্টার্ন তাকে বুদ্ধি দিলেন, নাৎসি বাহিনীর নিয়মানুয়ায়ী কারখানাটি দখল না করে বরং এটি কিনে নিলে বা লিজ নিয়ে নিলে শিন্ডলারকে নাৎসিদের কথামত কারখানা চালাতে হবে না আর ইচ্ছেমত সস্তায় ইহুদি শ্রমিক নিতে পারবেন।

os-factory-2

শিন্ডলারের কারখানার সম্মুখভাগ

শিন্ডলার স্টার্নের পরামর্শ অনুযায়ী কারখানাটি লিজ নিলেন এবং ১৯৪০ সালের জানুয়ারি থেকে নতুনভাবে এর কাজ শুরু হল। কারখানার নাম দেয়া হল  Deutsche Emaillewaren-Fabrik যার মানে হল ‘জার্মান এনামেলওয়ার ফ্যাক্টরি’। পরবর্তীতে ‘এমালিয়া’ নামেই ফ্যাক্টরিটি পরিচিতি পেয়েছিল। শুরুতে ফ্যাক্টরিতে নিয়োগ দেয়া হল সাত জন ইহুদি এবং আড়াইশ ইহুদি নন এমন কর্মী। ইহুদিদের একজন আব্রাহাম ব্যাঙ্কিয়ার কারখানার ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে এই কারখানার কর্মী সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৭৫০ এ, যার মধ্যে ১০০০ জনই ছিল ইহুদি।

os-factory

শ্রমিকদের সাথে অস্কার শিন্ডলার

আপভেয়াতে কাজ করার সুবাদে এবং সেই সূত্রে এর সামরিক অফিসারদের সাথে পরিচয় থাকার কারণে শিন্ডলার সহজেই তার কারখানায় সেনাবাহিনীর জন্য থালা-বাসন-হাঁড়ি ইত্যাদি ধরণের তৈজসপত্র তৈরির কাজ যোগাড় করেন। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই পরিচয় থাকলেই কেবল চলত না, কাজ আদায়ের জন্য অফিসারদেরকে দামি দামি ঘুষ দিতে হত। ঘুষ দেয়ার জন্য মূল্যবান জিনিসপত্র ও কারখানার দুর্লভ কাঁচামালগুলো কিনতে হত কালোবাজার থেকে যেখানে শিন্ডলারকে সহায়তা করতেন কারখানার ম্যানেজার ব্যাঙ্কিয়ার।

শিন্ডলার এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন যুদ্ধের মৌসুমে ভালো টাকা কামানোর উদ্দেশ্য নিয়েই, আর ইহুদিদের বেশি কাজে নিয়েছিলেন কারণ তারা ছিল পোলিশদের চেয়ে সস্তা শ্রমিক। কিন্তু ধীরে ধীরে শিন্ডলারের মনোভাব পাল্টাতে লাগল। দেখা গেল, কারখানার শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যই বরং তার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। যখনই নাৎসি বাহিনীর কোনো ঘেটো কিংবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তার কারখানার কোনো ইহুদি শ্রমিককে ধরে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম হত, তখনই শিন্ডলার তাকে ছাড়িয়ে আনতেন অফিসারদের মোটা রকমের ঘুষ দিয়ে। নাৎসি বাহিনীর কাছে তিনি নারী, শিশু এমনকি বয়স্কদেরকেও কারখানার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক হিসেবে দেখাতেন এবং তাদেরকে যাতে ধরে নিয়ে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করতেন। একদিন গেস্টাপো পুলিশের দুই অফিসার আসে ফ্যাক্টরিতে তার বিরুদ্ধে জাল ডকুমেন্ট তৈরি করে এক ইহুদি পরিবারকে বাঁচানোর অভিযোগে তাকে ধরার জন্য। পরবর্তীতে শিন্ডলারের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তাদেরকে বসিয়ে খাবার আর মদ দিয়ে টানা তিন ঘণ্টা আপ্যায়নের সেই দুই পুলিশ এতটাই মদ্যপ হয়ে যায় তারা ভুলেই গিয়েছিল তারা কেন এসেছিল। এরপর সে দুজন আর আসে নি সেখানে।

majdanek-gas-chamber-p

পোল্যান্ডের একটি গ্যাস চেম্বার, বিষাক্ত জাইক্লন-বি গ্যাসের ব্যবহারে দেয়ালে নীল দাগ পড়েছে

১৯৪০ এর আগস্টে পোল্যান্ডের নাৎসি গভর্নর জেনারেল ঘোষণা করল ক্র্যাকোতে বসবাসরত সকল ইহুদিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে শহর ছাড়তে হবে, থাকতে পারবে শুধু জার্মান সৈন্যদের কোনো কাজের সাথে যুক্ত ইহুদিরা। প্রায় ষাট থেকে আশি হাজার ইহুদি শহর ছেড়ে গেল এবং ১৯৪১ সালে ক্র্যাকোতে ইহুদি বাকি রইল মাত্র পনের হাজার জন। এরপর নাৎসিরা ক্র্যাকোতে তৈরি করল চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ‘ক্র্যাকো ঘেটো’ এবং শহরের সমস্ত ইহুদিকে নিজস্ব বাড়িঘর থেকে বের করে এনে একসাথে থাকতে বাধ্য করা হল এই ঘেটোতে।

১৯৪১ সালের শেষ দিকে এসে নাৎসিরা ঘেটো থেকে ইহুদিদের ধরে ধরে পাঠাতে লাগল বেলজেক এর এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে যেখানে হত্যা করা হত তাদের। রাস্তাঘাটে যখন তখন নাৎসি বাহিনীর গুলি করে মেরে ফেলা তো ছিলই। দুই বছরের মধ্যে সেখানকার কর্মক্ষম নয় এমন নারী শিশু ও বৃদ্ধদের সবাইকে মেরে ফেলা হল এভাবে। যারা কাজ করত তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হল প্লাশজোতে, নতুন নির্মিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। শিন্ডলার আগে থেকেই খবর নিতেন কখন ঘেটোতে নাৎসি বাহিনী মানুষ শিকারে আসবে, ঐ অনুযায়ী তার ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের রাতের বেলা কাজ করানোর নামে রেখে দিতেন যাতে এমন অতর্কিত ভাবে তাদের মারা পড়তে না হয়। ক্র্যাকোর ঘেটো থেকে ধরে ধরে নির্বিচারে ইহুদিদের হত্যা করার ঘটনা শিন্ডলারকে প্রচণ্ড রকম নাড়া দেয়, নিজের পার্টির বাহিনীর নির্মমতা চোখের সামনে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। তখনই শিন্ডলার সিদ্ধান্ত নেন, যত পারেন রক্ষা করবেন ইহুদিদের।

buchenwald-prisoners-1-p

মানুষ বন্দী আছে মানুষের তৈরি খাঁচায়। জার্মানির বুশেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।

প্ল্যাশজো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খোলা হয়েছিল ১৯৪৩ সালের মার্চে, শিন্ডলারের ফ্যাক্টরি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল এসএস বাহিনীর অফিসার অ্যামন গোথ। অ্যামন গোথ ছিল ভয়ঙ্কর রকমের নিষ্ঠুর প্রকৃতির। প্ল্যাশজোতে বসবাসরত ইহুদিদের যখন তখন গুলি করে মারত সে। সেখানে বন্দি প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকত কখন গোথের গুলিতে মারা পড়তে হয়। শিন্ডলারের স্ত্রী এমিলি বলেছিলেন তার জীবনে দেখা জঘন্যতম ব্যক্তি ছিল এই গোথ।

গোথ পরিকল্পনা করেছিল স্থানীয় সবগুলো ফ্যাক্টরি ক্যাম্পের গেটের ভেতরে নিয়ে আসবে। কিন্তু শিন্ডলার তার কুটনৈতিক দক্ষতা, কথার খেল আর অতি অবশ্যই পর্যাপ্ত উৎকোচ দিয়ে তার ফ্যাক্টরিটি গেটের ভেতরে না নেবার ব্যবস্থা করলেন। একই সাথে গোথকে রাজি করালেন যাতে তাকে নিজ খরচে নিজের কারখানার শ্রমিকদের জন্য একটি সাবক্যাম্প করার অনুমতি দেয়া হয়। এই ক্যাম্পে শিন্ডলারের ফ্যাক্টরি ইমেলিয়ার শ্রমিক ছাড়াও আরও সাড়ে চারশ ইহুদি থাকার বন্দোবস্ত করা হল। এখানে যারা থাকত তাদের অন্তত যখন তখন গোথের গুলি খেয়ে মরবার ভয় ছিল না। ভালো থাকার জায়গা, ভালো খাবার এমনকি ধর্মীয় আচার পালনের সুযোগও তারা পেল শিন্ডলারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই ক্যাম্পে। গোথ যদি জানতে পারত সে যে মানুষদের রাস্তাঘাটে পায়ের নিচে পিষে মারা পড়া কীটের চেয়েও অধম মনে করে শিন্ডলার তাদেরকে একটু মানবিক জীবন যাপনের সুযোগ দিচ্ছে, তাহলে শিন্ডলারের পরিণতি কী হত সেটা বলাই বাহুল্য।

buchenwald-survivors-p

বুশেনওয়াল্ড ক্যাম্পের এই বন্দীরা বেঁচে গিয়েছিল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। মাঝখানের বাংকে শুয়ে থাকা বাম থেকে সপ্তম জন নোবেল জয়ী সাহিত্যিক এলি উইজেল।

শিন্ডলার কালোবাজারের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দুবার গ্রেফতার হয়েছিলন। প্রথম বার ১৯৪১ সালে, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল এক রাত, নাৎসি বাহিনীতে তার যোগাযোগের সূত্র ধরে এরপর ছাড়া পান। পরের বার ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে, সেবারে অভিযোগ ছিল গুরুতর, কালোবাজারের সাথে সম্পৃক্ততা ছাড়াও অ্যামন গোথকে ঘুষ দেয়ার বিষয়টিও ছিল অভিযোগে। প্রায় এক সপ্তাহ আটক থাকার পর সেবারেও ছাড়া পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মাঝখানে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯৪২ সালে, ন্যুরেমবার্গ আইন ভঙ্গ করার অপরাধে, কারণ তার ফ্যাক্টরিতে আয়োজিত এক ইহুদি কিশোরির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার গালে চুমু দিয়েছিলন তিনি। নাৎসি পার্টির করা ন্যুরেমবার্গ আইনে ‘জার্মান বিশুদ্ধ রক্ত’ ধারী ব্যক্তিদের সাথে ‘নিকৃষ্টতম রক্ত’ধারী ইহুদিদের কোনো রকম মানবিক সম্পর্ক করাই অপরাধ ছিল। এই অভিযোগে গ্রেফতার করে পাঁচ দিন আটক করে রাখা হয় শিন্ডলারকে।

১৯৪৩ সালে শিন্ডলার বেশ কয়েকবার জার্মানির বুদাপেস্টে যান যুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা ইহুদিদের নেতাদের সাথে দেখা করতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ইহুদিদের উপর নাৎসি বাহিনীর চালানো অত্যাচারের বর্ণনা করে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য।

১৯৪৪ সালের জুলাই মাসের দিকে রাশিয়ান রেড আর্মি কাছে চলে আসার কারণে এসএস বাহিনী তাদের পূর্বদিকের ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে সেখান থেকে ইহুদিদের পশ্চিম দিকের অশভিৎজ ও গ্রস-রোজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। অশভিৎজ ছিল নাৎসিদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্যাম্প, দশ লক্ষ ইহুদিকে এই এক ক্যাম্পেই হত্যা করা হয়। অ্যামন গোথের ব্যক্তিগত সহকারি মিয়েটেক পেম্পার এর সাথে শিন্ডলারের সখ্যতা ছিল। সে তাকে জানায় নাৎসি বাহিনী পরিকল্পনা করছে যুদ্ধের কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এমন ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ করে দেবার। পেম্পার শিন্ডলারকে পরামর্শ দেয় তার ফ্যাক্টরিতে তৈজসপত্রের পরিবর্তে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গ্রেনেড তৈরির কাজ শুরু করার যাতে এটি বন্ধ হয়ে না যায়। গোথকে প্রচুর পরিমাণ ঘুষ দিয়ে শিন্ডলার রাজি করায় তার কারখানাটি সাদেটেনল্যান্ডের ব্রিনলিটজে সরিয়ে নেবার জন্য অনুমতি দিতে। শিন্ডলারের কারখানার এক হাজার ও হুলিয়ান ম্যাদ্রিশ নামক আরেক ব্যবসায়ীর কারখানার দুইশ, মোট ১২০০ ইহুদি শ্রমিকের নামের তালিকা তৈরি করে দেয় পেম্পার। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে তাদেরকে ব্রিনলিটজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

auschwitz-ovens-p

অশভিৎজ ক্যাম্পের ওভেন, যেখানে পোড়ানো হত লাশ

১৫ অক্টোবরে শিন্ডলারের তালিকার ৭০০ ইহুদি পুরুষকে তুলে দেয়া হয় ট্রেনে। তাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রস-রোজেন ক্যাম্পে, সেখান থেকে ব্রিনলিটজের কারখানায়। এরপরই ঘটে এক ভয়াবহ বিপত্তি। আরেকটি ট্রেন ৩০০ ইহুদি নারীকে নিয়ে চলে যায় অশভিৎজে। যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এসে অশভিৎজে তখন রাত দিন ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মারা হচ্ছে আর লাশ আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে সেই তিনশ নারীকেও এই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। শিন্ডলার খবর পেয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেন তার সহকারি হিলড এলব্রেশটকে, সাথে কালোবাজারের দামী জিনিসপত্র, মূল্যবান খাবার আর হীরা। নাৎসি অফিসারদের সেগুলো উৎকোচ দিয়ে সেই তিনশ জনকে অশভিৎজ থেকে ব্রিনলিটজে পাঠানোর ব্যবস্থা করে করা হয়।

শিন্ডলার আড়াইশটি ওয়াগনে করে নতুন ফ্যাক্টরির জন্য যন্ত্রপাতি আর কাঁচামাল নিয়ে ব্রিনলিটজে আসেন। ফ্যাক্টরি স্থাপিত হল, কিন্তু খুব অল্প পরিমাণে কামানের গোলা ছাড়া আর কিছু তৈরি করা হল না। সামরিক মন্ত্রণালয় থেকে তলব করা হল শিন্ডলারকে, তার কারখানার উৎপাদন এত অল্প কেন জানতে চেয়ে। তখন শিন্ডলার কালোবাজার থেকে গোলা বারুদ বোমা ইত্যাদি কিনে সেগুলো নিজের কারখানায় তৈরি বলে বিক্রি করতে লাগলেন। এসএস বাহিনী যে রেশন দিত তা ছিল খুবই সামান্য, তাই শিন্ডলার তার অধিকাংশ সময় কাটাতে লাগলেন ক্র্যাকোতে, সেখানকার কালোবাজার থেকে শ্রমিকদের জন্য খাবার আর বিক্রির জন্য গোলা বারুদ কিনতে গিয়ে। তার স্ত্রী এমিলি লুকিয়ে বেশি করে রেশনের খাবার দাবার নিয়ে আসতে লাগলেন শ্রমিকদের জন্য। এদিকে শিন্ডলার অনেক জায়গায় ঘুষ দিয়ে আরও ৩,০০০ ইহুদি নারীকে অশভিৎজ থেকে সাদেটেনল্যান্ডের বিভিন্ন ছোট ফ্যাক্টরিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে অন্তত তাদের বেঁচে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা হলেও থাকে।

oskar-list

শ্রমিকদের তালিকার একটি পাতা

১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে পোল্যান্ড এর একটি খনি থেকে বিতাড়িত আড়াইশ ইহুদি শ্রমিকদের নিয়ে একটি ট্রেন পৌঁছায় ব্রিনলিটজে। ট্রেনের বক্সকারের ভেতরে ছিল শ্রমিকেরা। ঠাণ্ডায় বক্সকারের দরজাগুলো এঁটে গিয়েছিল। এমিলি শিন্ডলার সেখানে আগে থেকেই ছিলেন শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের ফ্যাক্টরির এক ইঞ্জিনিয়ার গরম লোহা দিয়ে সেই বক্সকারগুলোর দরজা খুলে বের করে আনে শ্রমিকদের। ১২ জন মারা গিয়েছিল ভেতরেই, বাকিরা ছিল প্রচণ্ড অসুস্থ। এমিলি তাদের সবাইকে নিয়ে আসেন ফ্যাক্টরিতে এবং সেখানকার অস্থায়ী হাসপাতালে শ্রমিকদের রাখা হয়। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অস্কার শিন্ডলার এসএস অফিসারদের ঘুষ দিয়ে গেছেন নিয়মিত যাতে তার কারখানা আর হাসপাতাল থেকে শ্রমিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া না হয়। পিশাচদের ভীড়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করেছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে।

sl4

শিন্ডলার্স লিস্ট (১৯৯৩) সিনেমায় বাঁ থেকে অ্যামন গোথের ভূমিকায় র‍্যালফ ফিঁয়াস, ইটজাক স্টার্নের ভূমিকায় বেন কিংসলে, পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ও অস্কার শিন্ডলারের ভূমিকায় লিয়াম নিসন

১৯৪৫ সাল। অস্কার শিন্ডলারের দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম অবশেষে সফল হল মে মাসে। ৭ মে শিন্ডলার এবং তার শ্রমিকেরা জড়ো হলেন কারখানার নিচতলায়। রেডিওতে তারা শুনলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ঘোষণা। জার্মানি আত্মসমর্পন করেছে। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মানব ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যার অবসান ঘটেছে। আর ছোট্ট একটি কারখানার মাঝে দিনের পর দিন অসীম হৃদ্যতা নিয়ে আগলে রেখে বারোশতটি জীবন রক্ষা করেছেন অস্কার শিন্ডলার।

নাজি পার্টির সদস্য এবং আপভেয়া গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা হওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আটক হবার সম্ভাবনা ছিল তার। তাই আব্রাহাম ব্যাঙ্কিয়ার, ইটজাক স্টার্ন এবং আরও কজন মিলে একটি কাগজে স্টেটমেন্ট তৈরি করে সেখানে তার ইহুদিদের রক্ষা করার সাক্ষ্য দেয় যাতে কাগজটি দেখালে শিন্ডলারকে গ্রেফতার না করা হয়।

emilie_schindler

এমিলি শিন্ডলার, ২০০০

oskar-schindler4

কারখানার বেঁচে যাওয়া শ্রমিকের পরিবারের সাথে শিন্ডলার

সেই সময়ে ১০,৫৬,০০০ মার্কিন ডলার খরচ করেছিলেন শিন্ডলার শ্রমিকদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, কালোবাজার থেকে তাদের খাবার ও অন্যান্য জিনিস কেনা এবং নাৎসি অফিসারদের উৎকোচ দেয়ার জন্য! যুদ্ধের পর বেশ কিছু ব্যবসা করার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন এবং ১৯৬৩ সালের দিকে এসে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এরপর থেকে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিরা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যে অর্থ তাকে পাঠাত তা দিয়ে তিনি জীবন নির্বাহ করেন। ১৯৭৪ সালের ৯ অক্টোবর মারা যান অস্কার শিন্ডলার। তাকে সমাহিত করা হয় জেরুজালেমের পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত মাউন্ট জিয়ন এ। নাৎসি পার্টির একমাত্র সদস্য হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেন শিন্ডলার।

schindler-grave

যেখানে শায়িত আছেন অস্কার শিন্ডলার

হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনী যত আদর্শের কথাই বলুক না কেন, নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করতে হয় যেখানে, সেটা কোনো মানুষের আদর্শ হতে পারে না, সে আদর্শ কেবল নরাধম পিশাচের। চারিদিকে এমন নরঘাতকদের মাঝে থেকে অস্কার শিন্ডলার মানবতার পতাকা নিয়ে লড়ে গেছেন যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্ত। যুদ্ধ শেষ হবার পর সাইমন জেরেট নামক একজন শ্রমিকের সোনায় বাঁধানো দাঁত থেকে স্বর্ণ নিয়ে তৈরি করা একটি আংটি শিন্ডলারকে উপহার দেয় শ্রমিকেরা, যাতে লেখা ছিল, “Whoever saves one life saves the world entire” অর্থ্যাৎ, যে একজনের জীবন বাঁচালো সে গোটা বিশ্বকেই বাঁচালো। একটি নিরপরাধ ফুলকে বাঁচাতেও অস্ত্র ধরতে হয়, আর হাজারও মানুষের জীবন বাঁচিয়ে যাওয়া অস্কার শিন্ডলার তো সার্থক মানব জনমই কাটিয়েছিলেন!

This article is in Bangla Language. It's about history of Oskar Schindler

Image Sources & References:

  1. http://www.history.com/topics/world-war-ii/the-holocaust/pictures/holocaust-concentration-camps/
  2. http://www.jewishvirtuallibrary.org/jsource/biography/schindler.html
  3. http://www.auschwitz.dk/id2.htm
  4. https://www.pinterest.com/
  5. http://www.aish.com/ho/o/Einsatzgruppen-The-Killing.html

Featured Image: Kyky.org

Related Articles

Exit mobile version