মৃত্যু মানুষের অমোঘ নিয়তি। এর সাথে সাথেই সমস্ত প্রাণীজগতের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। জীবনের এই শেষমূহুর্তে অনেকে ধর্মীয় বা নিজস্ব সংস্কৃতিতে চলে আসা নিয়মানুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট দোয়া বা শ্লোক বলে থাকেন। কাউকে কাউকে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে, আবার কেউ হয়তো প্রিয় মানুষের নাম নিতে নিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কেউ আবার রেখে যান মূল্যবান উপদেশ। এমনকি কাউকে কাউকে মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে কৌতুক বা হাসি তামাশা করতেও দেখা গেছে! অনেকে আবার নানা রকম কথা বলেন। কোনোটা অর্থহীন, কোনোটা আবার গভীর তাৎপর্যময়।
এই প্রসঙ্গে নানাজন নানা রকমের মত পোষণ করে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু মৃত্যু মানুষের অন্তিম সময়, তাই এই মুহুর্তে মানুষের মাঝে একধরনের ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে। ফলে অত্যন্ত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথা এসময় বলতে পারাটাই স্বাভাবিক। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ শেষ মুহুর্তে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে না। তাই এসময় গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলা তার পক্ষে সম্ভবই নয়। বরং অন্তিম সময়ে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থহীন কথাবার্তা বলে থাকে।
উপরোক্ত উভয় মতাবলম্বীদের স্বপক্ষে যথেষ্ট শক্ত যুক্তি থাকলেও কেউই আসলে পুরোপুরিভাবে সঠিক নন। কেননা মৃত্যুর পূর্বমূহূর্তে মানুষের কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খুব সাধারণ মানুষও মৃত্যুর আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গেছেন, যা তারা সচরাচর বলেন না, আবার অনেক বিখ্যাত মানুষও মৃত্যুর আগে নিছকই কিছু অনর্থক কথা বলে গেছেন। এর ব্যতিক্রমও নেহায়েত কম নয়।
মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে কী বলে গেছেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা? আসুন জেনে নেওয়া যাক সে সম্পর্কিত কিছু তথ্য।
মহাত্মা গান্ধী
ভারতের অহিংস আন্দোলনের পথিকৃত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যাকে আমরা মহাত্মা গান্ধী নামে কমবেশি সবাই চিনি, খুবই সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতে নয়া দিল্লীর বিরলা ভবনে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। আততায়ী ছিলেন নাথুরাম গডসে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে মহাত্মা গান্ধী শুধু বলেছিলেন ‘হা রাম‘। তার পরপরই সব শেষ হয়ে গেলো।
জন কিটস
ক্ষণজন্মা মহান ইংরেজ সাহিত্যিক জন কিটস জন্ম থেকেই ভুগছিলেন মরণরোগ যক্ষায়। এই ক্ষয়রোগে ভুগেই অবশেষে তার মৃত্যু হয়। ইতালির রোমে ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৬ বছর বয়সে এই মহান কথাসাহিত্যিক মারা যান।
মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন তাঁর বন্ধু যোসেফ সেভার্ন। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে তিনি সেভার্নকে শান্ত থাকতে বলেন। কিটস বলেছিলেন, “সেভার্ন। আমাকে তুলে ধরো বন্ধু। আমি মারা যাচ্ছি। আমি সহজভাবেই মরবো। তুমি ভয় পেয়ো না। নিজেকে শক্ত রাখো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। অবশেষে মৃত্যু এলো।”
বব মার্লে
প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বব মার্লে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেটা ছিলো ১৯৮১ সালের ১১ মে।
মৃত্যুর আগে মার্লে তার ছেলে জিগিকে বললেন, “টাকা দিয়ে জীবন কেনা যায় না“। কথাটি শুনলেই বোঝা যায়, এর সাথে কত আক্ষেপ আর গভীর উপলব্ধি জড়িয়ে আছে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
‘ওল্ড ম্যান এন্ড সী’ এর লেখক কালজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কোনো রোগে ভুগে কিংবা দুর্ঘটনায় মারা যাননি। বিশ্বসাহিত্যের এই অমূল্য কারিগর জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেন। আত্মহত্যার পূর্বে হেমিংওয়ে তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, “শুভরাত্রি আমার বিড়ালছানা“।
এডগার অ্যালান পো
এডগার অ্যালান পোর সৃষ্টিকর্মে বিষণ্ণতা আর অন্ধকারের প্রচ্ছন্ন একটি ছায়া লক্ষণীয়। ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর পো তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শেষ কথা ছিলো, “ঈশ্বর আমার অসহায় আত্মাকে সাহায্য করো“।
গৌতম বুদ্ধ
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ তাঁর মৃত্যুকালে শিষ্যদের সাথেই ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে কিছু অমূল্য কথা বলে যান।
“জন্ম ও মৃত্যুর কারণ এক ও অভিন্ন। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু হবেই। একমাত্র সত্যই চিরস্থায়ী। তোমরা সত্যের সাধনা করে সত্যের পথে এগিয়ে চলো।”
মহাকবি গ্যেটে
মহাকবি গ্যেটের মৃত্যুর আগের শেষ কথা ছিলো “আলো, আরো আলো“।
আর্কিমিডিস
ইতিহাসবিদ প্লুটার্কের মতে, একদিন গণিতের সূত্র নিয়ে বাড়ির উঠোনে দাগ কেটে হিসেব কষছিলেন গ্রিক পন্ডিত আর্কিমিডিস। সেসময়ে রোমান সৈন্যরা গ্রিস আক্রমণ করেছিলো। রোমানরা গ্রিস জিতে নেওয়ার পর রোমান সেনাপতি মার্সেলাস চাইলেন মহাজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সাথে দেখা করতে। তিনি ছিলেন গুণের সমঝদার ব্যক্তি।
সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন আর্কিমিডিসকে খুঁজে সসম্মানে তার কাছে নিয়ে আসতে। সৈন্যরা আর্কিমিডিসের কাছে এলো। কিন্তু আর্কিমিডিসের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত। সৈন্যরা তাকে ডাকতেই তিনি বললেন, “আমার নকশা থেকে দূরে সরে দাঁড়াও।” পরাজিত নাগরিকের এমন কথা শুনে সৈন্যটি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। সৈন্যের তরোয়ালের এক কোপে দ্বিখণ্ডিত হলো মহান এই গণিতবিদের শির।
মেরি আতোয়ানেৎ
ফ্রান্সের রানি মেরি আতোয়ানেৎকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার জন্য যখন রানীকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি ভুলবশত জল্লাদের পা মাড়িয়ে দেন । সাথে সাথে জল্লাদের দিকে তিনি তাকিয়ে বলেন, “মহাশয় আমাকে ক্ষমা করবেন, উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এটা করিনি“। কত বড় ক্ষমতার অধিকারী রানী জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কতটা অসহায় বোধ করছিলেন!
কার্ল মার্ক্স
সমাজতন্ত্রের জনক, দার্শনিক কার্লমাক্স মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “যারা যথেষ্ট বলতে পারেনি শেষকথা তাদেরই জন্য“।
অগাস্টাস সিজার
“আমি কাদা-মাটির রোমকে পেয়েছিলাম। তোমাদের কাছে একে মর্মর বানিয়ে দিয়ে গেলাম“। মৃত্যুর আগে তার প্রজাদের উদ্দেশ্যে বারবার এ কথাই বলছিলেন রোম সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস সিজার।
একইসাথে তিনি তার কাছের মানুষদের বলেছিলেন, “আমি কি আমার দায়িত্ব ঠিকমতন সম্পন্ন করতে পেরেছি? যদি পেরে থাকি, তবে চলে যাওয়ার পর আমাকে স্মরণ করো“।
লুডউইগ ভ্যান বিঠোফন
বিশ্বখ্যাত সুরস্রষ্টা বিঠোফন শেষ বয়সে কানে শুনতে পেতেন না। মৃত্যুর আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা নিয়ে নানাজন নানা কথা বলে থাকেন। কেউ বলে, তিনি বলেছিলেন, “স্বর্গে গিয়ে আমি শুনতে পারবো“। আবার অনেকের মতে তার শেষ কথা ছিল, “আমাকে স্মরণ রেখো বন্ধুরা, সকল কৌতুকের অবসান ঘটলো অবশেষে“। আবার অনেকে বলেন, তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে এক কম্পোজার ১২ বোতল মদ আনেন। এটা দেখে বিঠোফনের মন খারাপ হলো। বললেন, “কী কষ্ট, কী কষ্ট, অনেক দেরি হয়ে গেছে“।
জর্জ হ্যারিসন
পৃথিবীখ্যাত বিটলস ব্যাণ্ডের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন ৫৮ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। দিনটা ছিলো ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর। তাঁর স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসনের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর মৃত্যুর আগের শেষ কথা ছিলো, “তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো“।
সম্রাট আওরঙ্গজেব
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মৃত্যুর আগে খুব অনুতপ্ত ছিলেন। পুত্রের কাছে লেখা সর্বশেষ চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমার জীবনে অনেক পাপ করেছি। জানি না, কত শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করছে“।
ফিচার ইমেজ: Famous People