খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ফোন করলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পারমাণবিক পরীক্ষা পাকিস্তানের জন্য কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনুরোধ করলেন পাকিস্তান যেন এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কিন্তু কোনো কিছুতেই থামানো গেল না পাকিস্তানের পারমাণবিক কার্যক্রম। পুরোদমে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল পারমাণবিক কর্মসূচির দিকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বেশ আগে থেকেই পাকিস্তানের ওপর কড়া নজর রাখছিল। সারা বিশ্বেরই তখন নজর ছিল পাকিস্তানের প্রতি। কারণ কিছুদিন আগেই প্রতিবেশী দেশ ভারত পাকিস্তানকে চাপে রেখে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ভারতকে শুধু প্রতিবেশী বললে বোধহয় সঠিক সংজ্ঞায়নটা হবে না। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশ দুটি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করে চলেছে। শুধু বৈরি সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বেশ কয়েকবার যুদ্ধও বাধিয়েছে দেশ দুটি। ১৯৯৮ সালে সে সময়ও দেশ দুটি এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল যেন যেকোনো সময় যুদ্ধ বেধে যাবে।
এরই মাঝে ১৯৯৮ সালের মে মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা করলেন, ১৪ বছর পর ভারত এই প্রথম একটি সফল পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ১১-১৩ মে পরীক্ষা চালানো হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পারমাণবিক বোমার। আর এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে পোখরান সামরিক রেঞ্জের মাটির তলায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই ভারত বিশ্বের বুকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নাম লেখায়। এর পর পরই বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে।
ভারতের এই পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠা পাকিস্তানের জন্য একদিকে যেমন ছিল হুমকি, অন্যদিকে এটা ছিল তাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত। ভারতের অন্যান্য সামরিক কার্যক্রমের মতো পারমাণবিক কর্মসূচীও যে প্রতিবেশী পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই সবাই দেখতে চাইছিল পাকিস্তান এই হুমকি ও চাপ কীভাবে সামাল দেয়।
পাকিস্তান এই পারমাণবিক হুমকির জবাব না দিয়ে ছাড়বেনা তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল যেন তারা এ ব্যাপারে কোনো রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বেশ সংযত আচরণই করেন। তিনি বলেন,
আমরা দায়িত্বশীলতার সাথে পদক্ষেপ নিতে চাই। আমাদের এই বোমা তৈরির সক্ষমতা আছে, কিন্তু আমরা গত ১৫-২০ বছরেও এর পরীক্ষা চালাইনি। ভারতের পরীক্ষার পরই আমাদেরও এ পরীক্ষা চালাতে হবে- এমন কোনো তাড়াহুড়োও আমরা করছি না।
পাকিস্তানের বাহ্যিক মনোভাব সংযত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে পারমাণবিক কার্যক্রম চালানোর একটা পরিকল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া পাকিস্তান সরকারের উর্ধ্বতন অনেকেই মনে করতেন, ভারতের এই পারমাণবিক কার্যক্রমের বিপরীতে তাদেরও পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো উচিত। একইভাবে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যেও এ ব্যাপারে বেশ সমর্থন ছিল।
তখন ড. সামার মুবারকমান্দ ছিলেন পাকিস্তানের পারমাণু শক্তি কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ওই সময় আবার তাদের প্রধান ছিলেন দেশের বাইরে। তাই জরুরি মুহূর্তে ড. মুবারকমান্দকেই ডেকে পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ড. মুবারকমান্দকে জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তানের এই মুহূর্তে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো উচিত কি না এবং এ ব্যাপারে তার মতামত সম্পর্কে। মুবারকমান্দ জানান,
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ তাদের পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পর্কে যে সমস্ত কথাবার্তা বলছে, তাতে আমরা যদি নিজেরা একটি পারমাণবিক পরীক্ষা না চালাই তাহলে উপমহাদেশে আমাদের সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা এবং প্রভাবে একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
কিন্তু এ ব্যাপারটাও স্পষ্ট ছিল যে, পাকিস্তান যদি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় তাহলে অবধারিতভাবেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে হবে, যা দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মন্ত্রীপরিষদ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি বৈঠকের আহ্বান জানাল। এই সভার বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। এমনকি পাকিস্তানের সাধারণ পার্লামেন্ট সদস্যরাও এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। মন্ত্রীপরিষদের সেই সভাতে সবার একটাই মত ছিল যে, ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার জবাবে তাদেরকে অবশ্যই পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে হবে।
সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে। কিন্তু বিষয়টি গোপন রাখা হলো। ড. মুবারকমান্দের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা পারমাণবিক পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম শুরু করে দিল। পারমাণবিক পরীক্ষার স্থানে সকল প্রকার সরঞ্জাম এবং লোকজন পাঠানো শুরু হয়ে গেল। জায়গাটি ছিল বেলুচিস্তানের চাগি পর্বতমালার একটি প্রত্যন্ত এলাকায়, মাটির নিচে।
পাকিস্তানের জন্য এই পারমাণবিক পরীক্ষা করাটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ একদিকে সারাবিশ্বের হুমকি এবং কড়া হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে, অপরদিকে এই পরীক্ষায় যদি তারা সফল হতে না পারে তাহলে সারা বিশ্বের কাছে তাদের ভাবমূর্তি হবে ক্ষুণ্ণ। এই অবস্থায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন ড. সামার মুবারকমান্দের কাছে, জানতে চাইলেন সফল হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে। ড. মুবারকমান্দ প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, “যদিও আমরা এই পরীক্ষা আগে কখনো করিনি, তবে আমরা নিশ্চিত যে এটা আমরা পারব।” তখন প্রধানমন্ত্রী তাকে বললেন, “আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না, আমাদের প্রতিবেশী আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। কাজেই এতে সফল হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।“
ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে যে পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সে সময় তারা পাকিস্তানের উপর একটি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। আবার মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাবও দেয়, তবুও যেন পাকিস্তান এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। শুধুমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তান যদি তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে তাহলে তাদের উপর মারাত্মক ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
অবশেষে পারমাণবিক পরীক্ষার চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে আসলো। ড. মুবারকমান্দ বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
চূড়ান্ত দিন, ১৯৯৮ সালের ২৭ মে, অবস্থাটা ছিল এই রকম। আমি ঘুরে ঘুরে সব যন্ত্রপাতি, ক্যাবল সংযোগ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ঠিকমতো বসানো হয়েছে কি না তার তদারকি করছিলাম। আমি সেই টানেল আর বাংকারগুলোর ভেতর বার বার ঢুকছি আর বের হচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার ঘরে গিয়ে একটু চা খেয়ে নিচ্ছি।
আমি একবার ভাবলাম, আমি এটা কী করছি? যে পরিমাণ ছুটোছুটি করেছি, তা নিশ্চয়ই ১০-১২ কিলোমিটারের কম হবে না। সন্ধ্যে নাগাদ আমার মনে হলো, এবার ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিই, যথেষ্ট হয়েছে। কারণ পরের দিনই পরীক্ষাটা চালানো হবে। আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। দেখলাম, রাতের আকাশে অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ দেখা যাচ্ছে। মনে হলো যেন সবাই আমরা কী করছি তার ওপর নজর রাখছে।
২৮ মে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। সেটা ছিল খুবই রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিন। বাতাসের গতিও ছিল বেশ ধীর। সবরকম প্রস্তুতি শেষ করে ড. মুবারকমান্দ এবং তার সহযোগীরা অবস্থান নিলেন বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। এরপর যখন নির্ধারিত সময়টা এলো তখন সহযোগীরা ড. মুবারকমান্দকে বোতামটি চাপার জন্য অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মুবারকমান্দ নিজে বোতামটি না চেপে যে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার এই যন্ত্রটি বানিয়েছে তাকেই বোতাম চাপার জন্য অনুরোধ জানাল। এরপর ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে এলেন এবং বললেন, আমরা কি তাহলে কাউন্ট-ডাউন শুরু করব? তখন ড. মুবারকমান্দ তাকে বললেন, “ঐ সমস্ত পুরনো রীতি বাদ দিন। শুধু ‘আল্লাহু আকবার’ বলে বোতামটি চাপ দিন।” অবশেষে তিনি তা-ই করলেন।
এরপর টান টান উত্তেজনা নিয়ে সবাই তাকিয়ে রইল সেই পর্বতটির দিকে। চোখের পলক পড়ছে না কারোরই। কারণ মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যার উপর নির্ভর করছে পাকিস্তানের সফলতা এবং ব্যর্থতা। ১, ২, ৩ সেকেন্ড পার হয়ে গেল। কিছুই ঘটল না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সবাই। বিমর্ষ হয়ে অনেকেই ছুটোছুটি শুরু করে দিলেন। এভাবে ২০ সেকেন্ড পার হয়ে গেল, তবুও কিছুই হলো না। ড. মুবারকমান্দ বললেন, “তখন আমার হার্টবিট অনেক বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না।“
৩০ সেকেন্ড শেষ, কোনো কিছুরই পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। অবশেষে ৩২ সেকেন্ডের মাথায় এক শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হলো। তখন সবাই একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে। নিশ্চিতভাবেই তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, এ তাদের সফলতা। ভূমিকম্পেরও প্রায় তিন সেকেন্ড পর কালচে ধূসর পর্বত রঙ পাল্টে সাদা হয়ে গেল। এবং সেই সাদাটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাম থেকে ডানে, প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। পুরো পর্বতটা তখন যেন বরফে ঢাকা তুষারধবল হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্স তাদের পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল আলজেরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে, সেখানেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল।
এরপর ইসলামাবাদ থেকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের সফল পারমাণবিক পরীক্ষার কথা ঘোষণা করলেন,
নিরাপত্তা হুমকির ব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এত বড় হুমকিকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থেই এই পারমাণবিক প্রকল্প বেছে নেয়া হয়েছে।
পারমাণবিক পরীক্ষার পর এর প্রতিক্রিয়া হলো খুব দ্রুত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রতি নিষেধাজ্ঞা এবং নিন্দা আসতে লাগলো। কিন্তু পাকিস্তান এক্ষেত্রে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
ড. সামার মুবারকমান্দ মনে করেন, পাকিস্তানের এই পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠা প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে দিয়েছে। পারমাণবিক শক্তি অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।