পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জন নারী শাসক দীর্ঘ সময় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন তাদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়া অন্যতম। ছয় দশকের শাসনকালে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আধুনিকায়ন শুরু করেন। তার কল্যাণে ব্রিটিশদের উপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে অনেক যুগান্তকারী উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। একজন নারী হয়েও ৬৪ বছর যাবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একহাতে ধারণ করা ভিক্টোরিয়ার সুখ্যাতি সেকালে ইউরোপের গন্ডি পেরিয়ে সুদূর আফ্রিকা ও এশিয়াতে পৌঁছায়। ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের মানুষের নিকট সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পান। কারণ ১৮৭৬ সাল থেকে ১৯০১ সাল অবধি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সম্রাজ্ঞীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মৃত্যুর পর লর্ড কার্জন ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় তার স্মরণে ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ করেন। এটি ছাড়াও অবিভক্ত বাংলার ত্রিপুরা খ্যাত বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র ১৮৯৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। রানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানার্থে নামকরণ করায় ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর‘ উপাধি প্রদান করে। আর এতে করে বোঝাই যাচ্ছে, অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতবর্ষে রানী ভিক্টোরিয়ার প্রভাব কতটুক ছিলো।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রানীর ব্যক্তিজীবন, শাসনকার্য পরিচালনাসহ আরও অনেক অজানা তথ্য আছে যা আমাদের জানা প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ রানী ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১৮ বছর বয়সে রাজমুকুট অর্জন করেন ভিক্টোরিয়া
১৮১৯ সালের ২৪ মে লন্ডনের কেনসিংটন প্যালেসে জন্মগ্রহণ করেন আলেক্সান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়া। তার বাবা এডওয়ার্ড ছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ সন্তান। অন্যদিকে তার মা প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া ছিলেন এক জার্মান ডিউকের কন্যা। কিশোরী বয়সে একদিন আলেক্সান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়ার জীবনে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। ১৮৩৭ সালের ২০ জুন সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে জেগে বিছানা থেকে নামার আগেই তাকে জানানো হয় তার চাচা, তৎকালীন রাজা চতুর্থ উইলিয়াম আগের রাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর কিছুক্ষণ পর লর্ড কনিংহাম নিশ্চিত করেন নিয়মানুসারে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের নতুন রানী হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়েছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আলেক্সান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়ার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে রাজমুকুট পরানো হয় তাকে।
রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ ছেলে এডওয়ার্ডের কন্যা হিসেবে সিংহসানের পঞ্চম দাবিদার ছিলেন ভিক্টোরিয়া। কিন্তু অল্প বয়সে তার বাবা, ভাই এবং সর্বশেষ তার চাচা উইলিয়াম মারা যাওয়ায় সিংহাসনের গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে বাধ্য হন তিনি। রাজমুকুট পেয়ে মোটেও খুশি হতে পারছিলেন না ভিক্টোরিয়া। একে তো বয়স কম, দ্বিতীয়ত রাজার মৃত্যু এবং নতুন রানী হিসেবে সিংহাসনে আরোহনকে কেন্দ্র করে রাজপ্রসাদে চলমান ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাকে।
শাসনকার্য বুঝে নিতে রানী ভিক্টোরিয়া প্রাসাদের মন্ত্রীদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে নিজের উচ্চতার কারণে বিপাকে পড়েন। মাত্র ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে তিনি যখন সভায় যোগদান করেন তখন অনেকেই তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। যদিও প্রথমদিনের এমন প্রতিকূলতা তাকে মোটেও ভীতসন্ত্রস্ত করেনি। বরঞ্চ তিনি নিজের জন্য বড় উচ্চতার চেয়ার আনার নির্দেশ দেন। আর এতে করে মন্ত্রীরাও খানিকটা বুঝতে পারেন নতুন রানীর সঙ্গে বোঝাপড়া খুব সহজ হবে না।
ভিক্টোরিয়ার শৈশব
ভিক্টোরিয়ার বয়স যখন মাত্র ৮ মাস তখন নিউমনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তার পিতা এডওয়ার্ড মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তার শৈশব কাটে মা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপদেষ্টা জন কনরয়ের অধীনে। কনরয় সবসময় ভিক্টোরিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইতেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে রাজা উইলিয়ামের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একসময় রাজা তাকে রাজপ্রাসাদের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেন। সেই সাথে প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ সভায় তার যোগদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এতে করে শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্য পরিচয়ে প্রাসাদে বসবাস করছিলেন ছোট্ট আলেক্সান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়া এবং তার মা প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া। রাজা উইলিয়ামের নির্দেশে মা-মেয়ের জন্য শুধুমাত্র একটি কক্ষ বরাদ্দ করেছিল প্রাসাদ কর্তৃপক্ষ। ঐ একটি কক্ষেই দিনযাপন শুরু হয় দুজনের। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি প্রয়াত এডওয়ার্ডের স্ত্রী সন্তানের উপর রাজার এমন বিরূপ আচরণ। শিশু বয়সে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত না করলেও অন্যদের তুলনায় একেবারে ব্যতিক্রম নিয়মে শিক্ষাগ্রহণ করতে বাধ্য হন ভিক্টোরিয়া। তার উপর মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলার জন্য নতুন নতুন নিয়মের মধ্যদিয়ে তার দিনের সময়সূচী নির্ধারণ করা হতো। এমনকি নিজ কক্ষের বাইরে একা হাঁটা নিষিদ্ধ ছিলো তার জন্য।
ভিক্টোরিয়া রানী হওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে উপদেষ্টা জন কনরয়ের ক্ষমতা কমিয়ে আনেন। এছাড়াও তখন মায়ের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। মূলত ছোটবেলায় নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করে তাকে ঘরবন্দী রাখার কারণে প্রতিশোধস্বরূপ তিনি এমনটা করেন বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের। যদিও ২ বছর পর লজ্জিত হয়ে উপদেষ্টা জন কনরয় পদত্যাগ করে ইতালিতে পালিয়ে যান। পরবর্তী জীবনে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে রানী ভিক্টোরিয়া বলেন,
শিশু হিসেবে অখুশি জীবনযাপন? আসলে আমি তখনও বুঝতে পারিনি সুখী জীবনযাপন বলতে মানুষ কী বোঝায়।
রানী ভিক্টোরিয়া একাধিক ভাষায় অভিজ্ঞতা
জন্মের পর থেকে ভিক্টোরিয়া কেনসিংটন প্রাসাদেই বড় হয়েছেন। ঐ প্রাসাদে রাজপরিবারের শিশু, কিশোরদের পাঠদান প্রক্রিয়াকে ‘কেনসিংটন সিস্টেম’ বলা হতো। ভবিষ্যতে বিভিন্ন উপনিবেশিক অঞ্চলে ভ্রমণের সুবিধার্থে সাধারণ বিষয়ের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখানো হতো। এই কারণে তিনি নিজেও লাতিন, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষা শেখেন।
অন্যদিকে মা জার্মান হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকে জার্মান ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন ভিক্টোরিয়া। রাজপ্রাসাদে পড়াশোনার বাইরে বেশিরভাগ সময় নিজ কক্ষে কাটানোর ফলে জার্মান ভাষাচর্চা আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও তার স্বামী প্রিন্স আলবার্টও ছিলেন জার্মান রাজপুত্র। আর এই কারণে সাংসারিক জীবনেও মাত্রাতিরিক্ত জার্মান ভাষায় অভ্যস্ত ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়া। যদিও প্রিন্স আলবার্ট শুদ্ধ ইংরেজিও বলতে পারতেন। তবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে রানী ভিক্টোরিয়া উপনিবেশিক অঞ্চলের চমৎকার কিছু ভাষা শিখেছিলেন।
ভারতবর্ষের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর প্রায়শই এই অঞ্চলে নিযুক্ত স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন ভিক্টোরিয়া। ১৮৮৭ সালের আগস্ট মাসে উইন্ডসর প্রাসাদে একদল ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আবদুল করিমের কাছ থেকে তিনি হিন্দি এবং উর্দু ভাষা শেখেন। এই প্রসঙ্গে রানী ভিক্টোরিয়া তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেন,
আমি চাকদের সঙ্গে কথাবলার জন্য অল্প অল্প করে হিন্দুস্তানি ভাষা শিখছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় আগ্রহ সেখানকার ভাষা এবং মানুষ সম্পর্কে জানতে পারা। ব্যক্তিগতভাবে এর আগে আমার কখনো এমন বাস্তবিক অভিজ্ঞতা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে তার প্রশাসনিক সম্পর্ক
ছয় দশকের শাসনামলে তার অধীনে মন্ত্রীসভায় বহু ব্যক্তির উত্থান-পতন ঘটেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রানীর প্রিয় হতে পেরেছেন, কেউ বা বহু রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তার প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেন লর্ড মেলবোর্ন। ১৮ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া যখন ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন তখন লর্ড মেলবোর্ন ছিলেন মন্ত্রীসভার প্রধান। শাসনামলের প্রথমেই রানী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন এই বুড়ো প্রধানমন্ত্রীর কারণে।
লর্ড মেলবোর্ন নানাভাবে অল্পবয়সী ভিক্টোরিয়াকে প্ররোচিত করতে চাইতেন। এমনকি তিনি গুজব রটান যে ভিক্টোরিয়াকে তিনি বিয়ে করতে চলেছেন। বিপত্নীক লর্ড মেলবোর্নের এমন আচরণের কারণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রানীকে মিসেস মেলবোর্ন হিসেবে কটাক্ষ করতো অনেকে। আর এসবের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে রানী ভিক্টোরিয়া জনসম্মুখে ঘোষণা দেন লর্ড মেলবোর্নকে তিনি শুধুমাত্র নিজের পিতার চোখে দেখেন। পরবর্তীতে বেঞ্জামিন ডিসরেলি নামক একজন মন্ত্রীও রানীকে কব্জা করার জন্য চিঠি ও কবিতা লিখে পাঠাতেন।
রানী ভিক্টোরিয়া একাধারে গ্র্যান্ডমাদার অব ইউরোপ হিসেবেও বিখ্যাত
২১ বছরের বৈবাহিক জীবনে রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্টের ঘরে সর্বমোট ৯ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে তার ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই ইউরোপের বিভিন্ন রাজপরিবারে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এতে করে তার বংশধররা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদদের মতে জার্মানি, গ্রিস, রাশিয়া, রোমানিয়া, নরওয়ে এবং সুইডেনের রাজপরিবারে সবমিলিয়ে রানী ভিক্টোরিয়ার নাতিনাতনি ছিলেন ৪২ জন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা জার্মানির কায়সার উইলহেম, রাশিয়ার তাসারিনা আলেক্সান্দা, ব্রিটেনের পঞ্চম জর্জ সবাই ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি-নাতনি। কায়সার উইলেহম তখন বলেছিলেন যদি তার দাদি বেঁচে থাকতো তবে কখনোই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হতো না। অন্তত তিনি কখনোই নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করার মতো অপমানজনক কাজ মেনে নিতেন না।
রানী ভিক্টোরিয়া ছয়বার হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফিরেন
রাজপরিবারের কলহ নতুন কিছু নয়। ইতিহাস বলে প্রায় সকল সাম্রাজ্যের রাজপরিবারে কলহ, ষড়যন্ত্র লেগেই থাকতো। আর সিংহসনে বসার বাসনা রাজপরিবারের সবার মাঝেই কম-বেশি কাজ করে। যদিও রানী ভিক্টোরিয়াকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে রাজপরিবারের কাউকে সরাসরি জড়িত থাকতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ ধারণা করা হয় তার পরে সিংহাসনের উত্তরসূরিরা গোপনে এসব করাতেন।
১৮৪০ সালের জুনে প্রথম সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় ভিক্টোরিয়া প্রিন্স আলবার্টের সঙ্গে ভ্রমণ করছিলেন। ঠিক সন্ধ্যায় তাদের লক্ষ্য করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। প্রিন্স আলবার্ট খুব অল্প সময়ের মধ্যে চালককে দিয়ে গাড়ি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। কয়েক মুহূর্ত দেরি হলে হয়তো গুলিবিদ্ধ হতেন রানী ভিক্টোরিয়া। এই ঘটনার পর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এডওয়ার্ড অক্সফোর্ড নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও আদালতে উন্মাদ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মুক্ত করে দেন রানী ভিক্টোরিয়া।
অতঃপর ১৮৫০ সালে রানী নিজেই নিজের বাহন চালিয়ে বাকিংহাম প্যালেস অতিক্রম করছিলেন। সে সময় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য রবার্ট পেট রানীর মাথায় বেত্রাঘাত করে। পরবর্তীতে তদন্ত করে জানা যায় বেতটির ওজন ৩ আউন্সের কম ছিলো বলে রানীর তেমন ক্ষতি হয়নি। অন্যথায় বড়সড় বিপদ হতে পারতো। একইভাবে ১৮৪২, ১৮৪৯ ও ১৮৭২ সালে একাধিকবার রানী ভিক্টোরিয়া নিজের বাহনে হামলার শিকার হন।
১৮৩৮ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সময়টাতে ভিক্টোরিয়া একজন উত্যক্তকারীর পাল্লায় পড়েন। সংবাদপত্রের শিরোনামে ঐ ছেলেকে ‘দ্য বয় জোনস’ নামে উল্লেখ করা হয়েছিল। এডওয়ার্ড জোনস নামক ঐ ব্যক্তি একাধিকবার বাকিংহাম প্রাসাদের নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে রানীর কক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। আটক হওয়ার পর তার কাছে রানীর অন্তর্বাস পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এডওয়ার্ড জোনস রানী ভিক্টোরিয়াকে গোপনে অনুসরণ করতো।
প্রিন্স আলবার্টের মৃত্যুতে রানীর দীর্ঘ শোক
টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ১৮৬১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্ট। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৪২ বছর। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাজে নিজের সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তিকে হারিয়ে রানী ভিক্টোরিয়া মানসিকভাবেও বিপন্ন হয়ে পড়েন। এছাড়াও তিনি প্রিন্স আলবার্টকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। আলবার্টের শোক কাটিয়ে উঠতে ২ বছরেরও বেশি সময় তিনি রাজকার্যের বাইরে ছিলেন। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে। তিনি কোনোভাবেই শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। এতে করে ব্রিটেনের জনগণের নিকট তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
১৮৭০ এর দশকে রানী ভিক্টোরিয়া ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরেন। এক দশক সময় নিয়েও তিনি প্রিন্স আলবার্টের শোক পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যদিও সে সময় তার একাধিক অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। মূলত মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে রানী এসব সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বলে ধারণা করেন রাজপ্রাসাদের ব্যক্তিবর্গ। প্রিন্স আলবার্টের পর রানীর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সান্নিধ্য পেয়েছিলেন স্কটিশ চাকর জন ব্রাউন। তবে ভিক্টোরিয়া পরবর্তীতে আর কখনোই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। তিনি প্রতিদিন প্রিন্স আলবার্টের ছবি জড়িয়ে ঘুমোতেন এবং কালো পোশাক পরিধান করতেন। কথিত আছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪০ বছর যাবত রানী ভিক্টোরিয়া প্রতিদিন সকালে একটি করে নতুন পোশাক প্রিন্স আলবার্টের স্মরণার্থে রাখতেন।
রানী ভিক্টোরিয়ার সমাধি প্রক্রিয়া
১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি ৮১ বছর বয়সে রানী ভিক্টোরিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তাকে যাতে কবর দেয়া না হয় সে ব্যাপারে আগেই সতর্ক করেছিলেন তিনি। আর এই কারণে তাকে কফিনে সমাধিস্থ করা হয়। সমাহিত করার প্রক্রিয়াটি ছিলো দীর্ঘ। আর্দ্রতাহীন কফিনের মেঝেতে কয়লা ছড়িয়ে সেখানে তাকে বদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে সমাহিত করার পূর্বে তার চুল কেটে সাদা সিল্কের গাউন পরানো হয়েছিল। রাজপরিবারের ডিউকগণ এবং নতুন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড তার মরদেহ কফিনে রাখেন। অতঃপর তারা রানীর কক্ষ ত্যাগ করেন।
রানীর চাকররা তার ইচ্ছানুযায়ী গোপন সকল জিনিস একে একে তার কফিনে রাখেন। তিনি এমন কিছু গোপন জিনিস সংরক্ষণ করেছিলেন যেগুলোর খবর স্বয়ং তার সন্তানরাও জানতেন না। ব্যক্তিগত চাকর জন ব্রাউনের মায়ের বিয়ের আংটি, ব্রাউনের একটি রুমাল, ছবি এবং খানিকটা চুল কফিনে জায়গা পেয়েছিল। সেই সাথে বিয়ের পর্দা দিয়ে রানীর মুখ ঢেকে দেয়া হয়। সকল কার্যক্রম শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি রানীকে উইন্ডসর প্রাসাদের পাশে স্বামীর সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
রানি ভিক্টোরিয়ার আর কাহিনী জানতে সংগ্রহ করতে পারেন “রানি ভিক্টোরিয়া ও করিম কাহিনি” বইটি