যার কল্যাণে বাংলা গদ্য তার নতুন যাত্রাপথ খুঁজে পায়, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [১৮২০-১৮৯১]। তাঁকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক। কবিতার পাশাপাশি বাংলা গদ্যেরও যে অন্তর্নিহিত ছন্দ থাকা উচিৎ সেটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব বিদ্যাসাগরেরই। বিদ্যাসাগর-পূর্ব সাহিত্যিকরা এই সত্যটি অনুধাবন করতে পারেননি যে গদ্যের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ছন্দ। বিদ্যাসাগর সবার আগে নিয়মিতভাবে সঠিক জায়গায় দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদির ব্যবহার শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই বাংলা গদ্যের নতুন যাত্রা শুরু হয়।
কালের পরিক্রমায় যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার কিংবা সঠিক বানানরীতি অনুসরণের মতো কাজগুলো আপামর জনসাধারণের কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ লেখার সময় ঠিক বানান লিখতে আমাদের অনীহা কাজ করে কিংবা লেখার মাঝে প্রয়োজনীয় জায়গায় যতিচহ্নের ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা তেমন সচেতন নই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুধু একটি ক্ষেত্রেই এই ধরনের ভুলগুলো আমরা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি এবং সেটি হলো পরীক্ষার হলে প্রশ্নটাই যদি আসে এই বিষয়ে।
দাপ্তরিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছাড়া এহেন অজ্ঞতা বা অবহেলার ফলাফল আহামরি কিছু না হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে সামান্য একটি কমার অনুপস্থিতিও বয়ে এনেছিল অভাবনীয় ক্ষতি। এমন কিছু ভুল আর ভুল থেকে জন্ম নেওয়া ইতিহাস পরিবর্তনকারী ঘটনা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
সবজান্তা গুগল
১৯৯৭ সাল। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ল্যারি পেজ এবং সিন অ্যান্ডারসন আরও বেশ কয়েকজন স্নাতক ডিগ্রীধারী শিক্ষার্থীর সাথে বসে আলোচনায় মত্ত। তারা সবাই মাথা খাটাচ্ছিলেন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা ইনডেক্স ওয়েবসাইটের নামের জন্য। হঠাৎ করেই অ্যান্ডারসন মত দিয়ে বসলেন, সাইটের ঠিকানা হবে গুগলপ্লেক্স (googolplex)। এখানে উল্লেখ্য, সুবৃহৎ পরিসরের নাম্বারগুলোর মাঝে গুগলপ্লেক্স অন্যতম।
পেজ, অ্যান্ডারসনের প্রস্তাবিত নাম নিজের মতো করে ছোট করে নিলেন- গুগল (googol)। অ্যান্ডারসন সাথে সাথেই তাদের সাইটের জন্য উক্ত ডোমেইনটি রেজিস্ট্রেশন করার উপযুক্ত কি না যাচাই করতে চলে গেলেন। ইউআরএল (URL) এর প্রাপ্যতা দেখতে গিয়ে তিনি কম্পিউটারে googol এর বদলে ভুলবশত টাইপ করলেন google। এই ডোমেইনটি তখন অবধি নিবন্ধিত না হওয়ায় তিনি সবুজ সংকেত পেলেন এবং বাকি অংশটুকু পাঠকদের নিশ্চিতভাবেই জানা।
নাসার অ্যালগরিদমে ওভারবারের অনুপস্থিতি
ম্যারিনার ১; নাসার তৈরিকৃত এই নভোযানের উদ্দেশ্য ছিল শুক্র গ্রহ সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করা ও শুক্রের ছবি পাঠানো। উৎক্ষেপণের অল্প সময়ের মাঝেই এর সহায়ক অ্যালগরিদমে একটি ওভারবারের অনুপস্থিতি ধরা পড়ে। ওভারবার হলো যেকোনো লেখার উপরে একটি সরলরেখা। অ্যালগরিদমের এই ছোট্ট ভুলের কারণেই যাত্রা শুরুর কিছু সময়ের মাঝেই এটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং এর সলিল সমাধি হয় দক্ষিণ আটলান্টিক উপকূলে।
একটি ওভারবারকে ( ̅) দেখতে ছোট মনে হলেও নাসার মতো জগদ্বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্ম অ্যালগরিদমে এর অনুপস্থিতির মাশুলটা দিতে হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই। ছোট্ট এই ওভারবারের না থাকার কারণে নাসাকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতির। তার চেয়েও বড় কথা, বিশ্বের কাছে নাসা তার প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং সারা পৃথিবীর মানুষকে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল শুক্রের ছবি দেখার জন্য।
অদ্ভুতুড়ে লটারি
২০০৫ সালে রোজওয়েল হোন্ডা ডিলারশিপ তাদের গুরুত্বপূর্ণ ৩০,০০০ ক্রেতার সম্মানার্থে একটি লটারির ঘোষণা করে। সম্মানিত ক্রেতাবৃন্দের মাঝে সৌভাগ্যবান ১ জন পাবেন ১,০০০ ডলার পুরষ্কার। ক্রেতাদের কাছে লটারির টিকেটগুলো পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পায় বিপণন প্রতিষ্ঠান ফোর্স ইভেন্ট। রোজওয়েল কর্তৃক প্রদত্ত বিস্তারিত নিয়ম বুঝে নেওয়াতে গলদ ছিল বিপণন প্রতিষ্ঠানের। এমনকি প্রুফ রিডিংয়ের সময়েও এই ভুল ধরা পড়েনি। ফলাফল হিসেবে ৩০,০০০ দোকানের কাছে পৌঁছে যায় টিকেট, যার প্রতিটিতেই ছিল ১০০০ ডলার পুরষ্কারের কথা। ক্রেতাদের প্রত্যেককে সন্তুষ্ট করতে চাইলে রোজওয়েল কোম্পানিকে খরচ করতে হত ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেটি তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই এর পরিবর্তে তারা প্রত্যেককে উপহারস্বরূপ ৫ ডলারের ওয়ালমার্ট গিফট কার্ড প্রদান করে।
পালং শাক বিভ্রান্তি
১৮৭০ সালে জার্মান রসায়নবিদ এরিক ভন উলফ পালং শাকে বিদ্যমান লৌহের পরিমাণ নিয়ে কাজ করছিলেন। বিশ্লেষণ শেষে তিনি পালং শাকের পুষ্টি গুণাগুণ প্রিন্ট করতে গিয়ে ছোট্ট একটি ভুল করেন। লৌহের পরিমাণ উল্লেখ করার সময় তিনি ভুলবশত দশমিক বিন্দু এক ঘর ডানে বসান। ফলাফল হিসেবে গণিতের নিয়মানুযায়ী পালং শাকের উপস্থিত লৌহের পরিমাণ প্রকৃত পরিমাণের দশ গুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। প্রকৃত পরিমাণ ৩.৫ গ্রাম এরিকের ভুলের কারণে হয়ে যায় ৩৫ গ্রাম এবং সেটি শুধু একটি দশমিক বিন্দুর এক ঘর হেরফেরের দরুন।
পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে জার্মানির আরেক দল গবেষক এই ভুলটি বুঝতে পারেন এবং সঠিক তথ্যটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিধিবাম, ততদিনে মানুষের একটি বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গিয়েছে যে পালং শাক প্রকৃতপক্ষে লাল মাংসের (Red Meat) মতোই লৌহ সমৃদ্ধ একটি খাবার।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পপাই কার্টুনের কথা। বিশ্বখ্যাত এই কার্টুনের নাবিক চরিত্রটিকে এর স্রষ্টা সবুজ পালং শাক ভক্ত হিসেবেই চিত্রিত করেছেন।
নিউ ইয়র্ক শিক্ষা বিভাগের ভুল
মানুষ আর কম্পিউটারের মেলবন্ধনটা বোধহয় সবসময় চমৎকার হয় না। ২০০৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের শিক্ষা বিভাগে কর্মরত হিসাবরক্ষক উইলিয়াম থম্পসন স্বীকার করেন, একটি অতিরিক্ত অক্ষরের কারণে ব্যবহৃত সফটওয়্যারটি একটি ডকুমেন্টের ভুল অর্থ করে বসে। ফলাফল হিসেবে নিউ ইয়র্ক শহরের শিক্ষা বিভাগের যাতায়াত খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত প্রাথমিক যাতায়াত খরচ ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও এই ভুলের কারণে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ২.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে!
কমার ভুলে অভাবনীয় আর্থিক লোকসান
একটি কমা (,) সঠিক স্থানে না দিলে ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে? যদি আপনি আপনার প্রিয়জনের সাথে চ্যাটে কথা বলার ক্ষেত্রে এমন ভুল করে থাকেন তাহলে সর্বোচ্চ তার রাগান্বিত মুখ দেখতে হবে বা হয়তো কিছুটা তর্কাতর্কি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে কমার মতো ছোট্ট একটি যতিচিহ্নের অনুপস্থিতিই বয়ে আনতে পারে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি।
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের অন্তর্গত সবচেয়ে বড় শহর হলো পোর্টল্যান্ড। পোর্টল্যান্ডের একটি ডেইরি ফার্মকে কমার অনুপস্থিতির জন্য ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে। ওকহার্স্ট ডেইরির তিনজন লরি চালক দাবি করেন, তাদের দীর্ঘদিনের অতিরিক্ত সময় কাজ করার পারিশ্রমিক মেটানো হয়নি। অতিরিক্ত সময়ের (Overtime) পাওনা সম্পর্কিত ব্যবস্থাপত্রে কমার ভুল ব্যবহারের কারণে তাদের পক্ষে এই অভিযোগ দাখিল করা সম্ভব হয়। বিবৃতিটি ছিল,
“the canning, processing, preserving, freezing, drying, marketing, storing, packing for shipment or distribution of: 1) agricultural produce; 2) meat and fish products; and 3) perishable foods”
চালকদের পক্ষে অভিযোগ উত্থাপন করা সম্ভব হয় কারণ ‘packing for shipment’ এর পর অথবা ‘or distribution’ এর আগে কোনো কমা ব্যবহার করা হয়নি। এই একটি কমার উল্লেখ থাকলেই আইনটি সন্দেহাতীতভাবে পচনশীল খাদ্যদ্রব্য পরিবহনকারী চালকদের, যোগ্য শ্রমিকদের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারত। এই কমার অনুপস্থিতির কারণেই লরি চালকরা সফলভাবে মামলা দায়ের করে এবং যুক্তরাষ্ট্র আদালতের আপিল বিভাগ শ্রমিকদের পক্ষেই রায় দেন। এই রায়ের ফলে সুবিধাপ্রাপ্ত হন ১২০ জন লরি চালক। ডেভিড ওয়েবার্ট, যিনি বাদী পক্ষের হয়ে মামলাটি লড়েন তার বক্তব্য ছিল, আইনে সঠিক জায়গায় একটি কমার অন্তর্ভুক্তিই আমাদের ভরাডুবি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। যদিও তিনি এই মামলার রায়ের পর খ্যাতনামা গণমাধ্যম বিবিসিকে কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি।
A Manual of Style for Contract Drafting বইয়ের লেখক Ken Adams বলেন,
“যতিচিহ্ন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। সবক্ষেত্রেই যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার হয়তো আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরি করে দেয় না। তবে প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি নিয়ে কাজ করলে আপনি নিশ্চিত নন যে কখন একটি সেমিকোলন কিংবা ড্যাশের এদিক-সেদিকই কত বড় ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হতে পারে!”
ফিচার ইমেজ: bbc.com